নারী নির্যাতন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১ শিরোনামে যে জরিপটি করেছে, তাতে দেশে নারী নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে নারীরা ঘরে নিরাপদ এবং বাইরেই বেশি নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু বিবিএসের জরিপটি সেই ধারণাকে উল্টে দিয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ঘরে আরও নির্দিষ্ট করে বললে স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন ৮৭.৬ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ৮১.২ শতাংশ মানসিক, ৫৩.২ শতাংশ অর্থনৈতিক, ৩৬.৫ শতাংশ যৌন এবং ৬৪.৬ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন ভোগ করে থাকেন। এ ছাড়া ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের অধিকার না থাকা কিংবা ১৯.১ শতাংশের নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে না পারাও আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর করুণ চিত্রই তুলে ধরে। প্রথমেই বিবিএসকে ধন্যবাদ দিতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এ রকম একটি নির্মম সত্য সামনে নিয়ে আসার জন্য। বিভিন্ন মহল থেকে যখন নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের গালভরা বুলি আওড়ানো হয়, তখন এই জরিপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে সেই বুলি ও বাস্তবতার মধ্যে দুস্তর ফারাক আছে। আবার এ কথাও সত্য, নারী নির্যাতন রোধ কিংবা নারীর উন্নয়নের দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, সমাজেরও। আমাদের সমাজমানস নানা সংস্কার ও বিধিনিষেধের জালে এমনভাবে তৈরি, যেখানে যুক্তি, জ্ঞান ও সভ্যতার আলো সহজে প্রবেশ করতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে আমাদের সেকেলে শিক্ষাব্যবস্থা ও বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনের পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও কম দায়ী নয়। নারীর প্রতি সংঘটিত সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে একাধিক আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। প্রথমত, আইনি প্রতিকার চাওয়ার জন্য যে অভয় পরিবেশ থাকা দরকার, সেই পরিবেশটি প্রায় অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফরিয়াদি কেবল ন্যায়বিচার থেকেই বঞ্চিত হন না, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে লাঞ্ছনা-নিগ্রহের শিকার হন। ঘরে ও ঘরের বাইরে এই নারীর ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে, এর প্রতিকার পেতে হলে এটিকে নিছক ব্যক্তিগত, পারিবারিক ঘটনা বলে পাশ কাটানো যাবে না। একই সঙ্গে এটি যে ঘৃণ্য অপরাধ, সেটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সালিসের নামে অপরাধকে ধামাচাপা ও অপরাধীকে রক্ষার অপচেষ্টা চালানো হয়। এসব আইনের শাসনেরই পরিপন্থী নয়, মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। নারী নির্যাতনের এই ভয়াল চিত্র নারীর জন্য যেমন অবমাননাকর, তার চেয়েও বেশি লজ্জাজনক পুরুষের জন্য। তাই, এই ভয়াল সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ সবাইকে এককাট্টা হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি নারীর সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে আমরা এই সমাজটিকে সভ্য বলে দাবি করতে পারব না।
No comments