সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে
ড. মোহাম্মদ রাফির জন্ম ১৯৫৬ সালে। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং সামাজিক উন্নয়ন ইউনিটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল নামক প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে এবং মেইকেন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। এখন কাজ করছেন বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে। এ ছাড়া ব্র্যাকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে চলেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ ও ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো হিন্দু সমাজের ওপর চলমান সহিংসতাকে কেউ বলছেন সাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলছেন রাজনৈতিক সহিংসতা। আপনি কী মনে করেন?
মোহাম্মদ রাফি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্বাচনের আগে ও পরে যে হামলাগুলো হয়ে গেল, একে রাজনৈতিক সহিংসতা বলা যায়। তবে এর মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয় আছে। সব ঘটনা যে কোনো একটি কারণে ঘটেছে, তা বলা যাবে না। একেক সময় একেকটি বিষয় প্রাধান্যে চলে আসে। সাম্প্রতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে হয়তো নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে অন্য কারণগুলো যে ছিল না, তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হিন্দুরা না থাকলে অনেকে লাভবান হয়।
প্রথম আলো সেটা কেমন? একটু ব্যাখ্যা করেন।
মোহাম্মদ রাফি যেমন, বাংলাদেশের হিন্দুরা তো একটি রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করে। সবাই জানে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ফলে যারা তাদের ভোট পায় না, তারা চায় হিন্দুরা এ দেশ থেকে চলে যাক। ২০০১ সালে আমরা এমনটি দেখেছি। আবার যারা তাদের পক্ষশক্তি, তারা হিন্দুদের পক্ষে আছে, তা দেখাতে চায়। এই দুই পক্ষের রাজনৈতিক লড়াইয়ের বলি হতে পারে হিন্দুরা।
প্রথম আলো অপ্রধান ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক আচরণ ও চাপ তো সারা বছরই থাকে। কিন্তু নির্বাচনের সময় তা এত তীব্র হয়ে ওঠে কেন?
মোহাম্মদ রাফি যেকোনো রাজনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে সব সময় আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় থাকে। যেমন, যারা হিন্দুদের ওপর হামলা করতে চায়, তারা সক্রিয় হওয়ার পর অপর পক্ষ তো মাঠে থাকে। তারা তা প্রতিরোধ করে থাকে। নির্বাচনের সময় এই পাল্টা সক্রিয়তা কমে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগটি সহিংসতাকারীরা নেয়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি সক্রিয় থাকত, তাহলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না।
প্রথম আলো ২০০১ সালের পর তো বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তাদের কাছে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমানো বা প্রতিহিংসার বিষয় ছিল। কিন্তু এখন তো সংখ্যালঘুদের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার সরকার ক্ষমতায়। তাহলে এ ঘটনাগুলো কেন ঘটতে পারল?
মোহাম্মদ রাফি সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার সময় দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছিল। আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি করে ফেলতে পারবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত ছিল না। নতুন সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন কী দাঁড়ায়, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল। ফলে যারা এগুলো ঘটিয়েছে, তারা হয়তো এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়েছে। যখন নির্বাচন শেষ হয়ে গেল, আন্তর্জাতিক সমর্থন অনুকূলে আসতে শুরু করল, তখন সমান্তরালভাবে সহিংসতা কমে যেতে দেখা গেছে।
প্রথম আলো ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের ওপর আপনি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেছেন। সে সময়ের সঙ্গে তুলনা করে যদি বলতেন। এখন সরকার ভিন্ন, কিন্তু প্রশাসন কেন একই আচরণ করল?
মোহাম্মদ রাফি নির্বাচনের সময় সরকারের পক্ষে সব কেন্দ্রে একই রকম নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। যারা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, তাদের পদ্ধতিটা হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান না করে কোনো কিছু বলা যাবে না।
প্রথম আলো দেখা যাচ্ছে, পুলিশের তরফে কোনো প্রতিরোধ হয়নি। যদি হতো, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতাকারীদের সংঘর্ষ হতো। যেমন, অভয়নগরের সাংসদ, পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তার পরও তাঁরা সহিংসতা বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
মোহাম্মদ রাফি যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা তো নিয়ম ও নির্দেশে পরিচালিত হন। ফলে বিষয়টিকে এভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয় কাজ করেছে কি না, তা আমার জানা নেই।
প্রথম আলো আপনার বইয়ে বলেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ সংখ্যাগুরুর মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে পারে। ব্যাখ্যা করবেন?
মোহাম্মদ রাফি যেমন, একটি পাড়ার হিন্দুদের উৎখাত করতে পারলে তা সেখানকার মুসলমান ক্ষমতাবানেরা দখল করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন বা মতাদর্শিক পার্থক্য কাজ না করে বরং ঐক্য তৈরি হতে পারে। যেমন, একটি গ্রামে ২৫ ঘর মুসলমান এবং পাঁচ ঘর হিন্দু থাকলে হিন্দুদের জমি দখল করার জন্য ২৫ ঘর মুসলমানের মধ্যে ঐক্য তৈরি হতে পারে।
প্রথম আলো হিন্দুদের সম্পত্তি দখলে প্রায় সর্বদলীয় ঐক্য দেখা যায়। আবুল বারকাত ও আপনার গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বেশি থাকেন, হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের হিস্যাও তাঁদের বেশি।
মোহাম্মদ রাফি হ্যাঁ, ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৪৭-এর পর থেকে ধরলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—এই তিনটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে। আওয়ামী লীগ থেকেছে সবচেয়ে কম সময়। ফলে তারা সবচেয়ে কম সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় সমান পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় ৪৪ শতাংশ হিন্দু সম্পত্তি দখল করেছে। অন্যদিকে যারা বিরোধীপক্ষ, তারা কম হলেও সম্পত্তি দখল করেছে। এ ব্যাপারে সব দলকেই দেখা গেলেও একটি বিষয় কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত কি তাহলে রাজনৈতিকভাবে এক হয়ে গেল? তাদের কি কোনো স্বতন্ত্র পরিচিতি
নেই? সেটা অবশ্যই আছে। আওয়ামী লীগ যদি চিন্তা করে কোনটি আমার জন্য লাভজনক, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, নাকি তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক দায় ইত্যাদি রক্ষা করা। এই দুটি বিষয়কে যদি আমরা দুই পাল্লায় রাখি, তাহলে কিন্তু তাদের সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সম্পত্তি দখল করার কথা নয়।
প্রথম আলো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, স্থানীয় সম্পর্কের সংঘাত ও নির্বাচনী রাজনীতি কাজ করে এবং দায়ীরা যে দলেরই হোক, কেউ তাদের শাস্তি দিতে চায় না। এখন পর্যন্ত কি কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয়েছে?
মোহাম্মদ রাফি না, বিচার হয়নি। ২০০১-এর ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা আমার কাছে দুবার এসেছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আমরা কেউ দেখিনি। ওই ঘটনার বিচারও হতে শুনিনি। অবশ্যই বিচারহীনতা যেকোনো অপরাধকে বাড়ায়।
প্রথম আলো উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার সূত্রপাতের মুহূর্ত হিসেবে দেশভাগকে অনেকে দায়ী করেন। কিন্তু বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার ধরনটা কি বদলায়নি?
মোহাম্মদ রাফি দেশভাগের অনেক আগে থেকে এখানে সাম্প্রদায়িকতা যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে রয়েছে। যেমন, চর্যাপদে দেখি বৌদ্ধদের ব্যাপারে হিন্দুদের ঘৃণা। এ দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সময় ব্রাহ্মণেরা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার অনেক ঘটনা আছে। এরপর এই অঞ্চলে মুসলমান শাসকদের আমলে ধর্মান্তরকরণের ইতিহাস সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, তা তো নয়। অনেকে বলে, এখানে তরবারির জোরে ধর্মান্তর হয়েছে। এ কথা পুরোপুরি যেমন ঠিক না, তেমনি একদম ভুলও নয়।
প্রথম আলো দেখা যাচ্ছে, উপকূলীয় ও সীমান্তবর্তী গ্রামে যেখানে হিন্দুদের বসতি বেশি এবং সেখানেই সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর উৎপত্তি বেশির ভাগই শহরে। দুই দেশের সাম্প্রদায়িকতার গড়নে কি কোনো পার্থক্য দেখেন?
মোহাম্মদ রাফি: ১৯৪৭-এর দেশভাগের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা গিয়ে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বসতি গড়েছে। আর ভারত থেকে আসা অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা ঢাকাসহ বড় শহরে বসতি গেড়েছে। ভারতের উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানেরা শ্রমিক হিসেবে শহরাঞ্চলে জড়ো হয়েছে। এখানে পার্থক্য হচ্ছে, শহরাঞ্চলে বসবাস এবং শ্রমিক হওয়ার কারণে ভারতীয় মুসলমানেরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং লড়াই করতে পারছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে তেমনটা আমরা দেখছি না।
প্রথম আলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চোখ দিয়ে দেখলে কে তাদের শত্রু, কে মিত্র?
মোহাম্মদ রাফি আমার মনে হয় না একজন বুদ্ধিমান সংখ্যালঘু বিষয়টিকে এভাবে দেখে। তারা দেখে কে আমার জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই হিসাব থেকেই তারা কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তির প্রতি সমর্থন জানায়। কেননা, সব রাজনৈতিক দলই তাদের কমবেশি ক্ষতি করেছে।
প্রথম আলো আপনার আগের গবেষণায় সুপারিশ করেছিলেন, সহিংসতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের একটি যৌথ শক্তিতে পরিণত হতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব?
মোহাম্মদ রাফি হ্যাঁ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, হিন্দুরা নিজেরা যদি সংগঠিত হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়লে, সহিংসতার শিকার হলে ভারতে চলে যায়। কিন্তু ভারতের মুসলমানেরা তো সহিংসতার কবলে পড়লে পাকিস্তানে চলে যায় না। তারা লড়াই করে টিকে থাকে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে তারা। নীরব থেকে আরও বিপন্ন হলে তারা কী করবে, সেটা বিবেচনার বিষয় হয়। কিন্তু তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ‘করতে হবে’, ‘দিতে হবে’-জাতীয় কথা তাদের কাছ থেকে কম শুনি। উপকূল বা সীমান্ত এলাকার হিন্দুরা না হয় বড় ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচি নিতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা শহরের দেড় কোটি অধিবাসীর মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ লাখও হিন্দু ধর্মাবলম্বী থাকে, তাদের মধ্যে দুই লাখ মানুষও যদি সারা দেশের সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামত, তাহলে পুরো ঘটনাই অন্য রকম হয়ে যেত।
প্রথম আলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চ রয়েছে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
মোহাম্মদ রাফি তাদের আন্দোলন অনেক দুর্বল। এটা দিলে ভালো হয়, এটা করা উচিত না—এমন কণ্ঠে তারা আন্দোলন করছে। সম্মিলিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ হলে হামলাকারী পক্ষ বা রাষ্ট্র সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবত। ফলে অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাদের পক্ষে যারা আসবে, তাদের সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু তারা নিজেদের যাতে ওই আন্দোলনে প্রাধান্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব মুসলমান তো খারাপ নয়। সংখ্যালঘুরা যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মাঠে নামে, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক মুসলমানকেও পাওয়া যাবে। তাই এই আন্দোলনে সবার আসার সুযোগও রাখতে হবে, একে নিছক সম্প্রদায়নির্ভর জোট করে রাখলে চলবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ রাফি ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ ও ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো হিন্দু সমাজের ওপর চলমান সহিংসতাকে কেউ বলছেন সাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলছেন রাজনৈতিক সহিংসতা। আপনি কী মনে করেন?
মোহাম্মদ রাফি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্বাচনের আগে ও পরে যে হামলাগুলো হয়ে গেল, একে রাজনৈতিক সহিংসতা বলা যায়। তবে এর মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয় আছে। সব ঘটনা যে কোনো একটি কারণে ঘটেছে, তা বলা যাবে না। একেক সময় একেকটি বিষয় প্রাধান্যে চলে আসে। সাম্প্রতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে হয়তো নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তবে অন্য কারণগুলো যে ছিল না, তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হিন্দুরা না থাকলে অনেকে লাভবান হয়।
প্রথম আলো সেটা কেমন? একটু ব্যাখ্যা করেন।
মোহাম্মদ রাফি যেমন, বাংলাদেশের হিন্দুরা তো একটি রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করে। সবাই জানে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ফলে যারা তাদের ভোট পায় না, তারা চায় হিন্দুরা এ দেশ থেকে চলে যাক। ২০০১ সালে আমরা এমনটি দেখেছি। আবার যারা তাদের পক্ষশক্তি, তারা হিন্দুদের পক্ষে আছে, তা দেখাতে চায়। এই দুই পক্ষের রাজনৈতিক লড়াইয়ের বলি হতে পারে হিন্দুরা।
প্রথম আলো অপ্রধান ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক আচরণ ও চাপ তো সারা বছরই থাকে। কিন্তু নির্বাচনের সময় তা এত তীব্র হয়ে ওঠে কেন?
মোহাম্মদ রাফি যেকোনো রাজনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে সব সময় আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় থাকে। যেমন, যারা হিন্দুদের ওপর হামলা করতে চায়, তারা সক্রিয় হওয়ার পর অপর পক্ষ তো মাঠে থাকে। তারা তা প্রতিরোধ করে থাকে। নির্বাচনের সময় এই পাল্টা সক্রিয়তা কমে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়। এই সুযোগটি সহিংসতাকারীরা নেয়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি সক্রিয় থাকত, তাহলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না।
প্রথম আলো ২০০১ সালের পর তো বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তাদের কাছে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমানো বা প্রতিহিংসার বিষয় ছিল। কিন্তু এখন তো সংখ্যালঘুদের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার সরকার ক্ষমতায়। তাহলে এ ঘটনাগুলো কেন ঘটতে পারল?
মোহাম্মদ রাফি সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার সময় দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছিল। আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি করে ফেলতে পারবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত ছিল না। নতুন সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন কী দাঁড়ায়, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল। ফলে যারা এগুলো ঘটিয়েছে, তারা হয়তো এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়েছে। যখন নির্বাচন শেষ হয়ে গেল, আন্তর্জাতিক সমর্থন অনুকূলে আসতে শুরু করল, তখন সমান্তরালভাবে সহিংসতা কমে যেতে দেখা গেছে।
প্রথম আলো ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের ওপর আপনি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেছেন। সে সময়ের সঙ্গে তুলনা করে যদি বলতেন। এখন সরকার ভিন্ন, কিন্তু প্রশাসন কেন একই আচরণ করল?
মোহাম্মদ রাফি নির্বাচনের সময় সরকারের পক্ষে সব কেন্দ্রে একই রকম নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। যারা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, তাদের পদ্ধতিটা হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান না করে কোনো কিছু বলা যাবে না।
প্রথম আলো দেখা যাচ্ছে, পুলিশের তরফে কোনো প্রতিরোধ হয়নি। যদি হতো, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতাকারীদের সংঘর্ষ হতো। যেমন, অভয়নগরের সাংসদ, পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তার পরও তাঁরা সহিংসতা বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
মোহাম্মদ রাফি যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা তো নিয়ম ও নির্দেশে পরিচালিত হন। ফলে বিষয়টিকে এভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয় কাজ করেছে কি না, তা আমার জানা নেই।
প্রথম আলো আপনার বইয়ে বলেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ সংখ্যাগুরুর মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে পারে। ব্যাখ্যা করবেন?
মোহাম্মদ রাফি যেমন, একটি পাড়ার হিন্দুদের উৎখাত করতে পারলে তা সেখানকার মুসলমান ক্ষমতাবানেরা দখল করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন বা মতাদর্শিক পার্থক্য কাজ না করে বরং ঐক্য তৈরি হতে পারে। যেমন, একটি গ্রামে ২৫ ঘর মুসলমান এবং পাঁচ ঘর হিন্দু থাকলে হিন্দুদের জমি দখল করার জন্য ২৫ ঘর মুসলমানের মধ্যে ঐক্য তৈরি হতে পারে।
প্রথম আলো হিন্দুদের সম্পত্তি দখলে প্রায় সর্বদলীয় ঐক্য দেখা যায়। আবুল বারকাত ও আপনার গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বেশি থাকেন, হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের হিস্যাও তাঁদের বেশি।
মোহাম্মদ রাফি হ্যাঁ, ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৪৭-এর পর থেকে ধরলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—এই তিনটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে। আওয়ামী লীগ থেকেছে সবচেয়ে কম সময়। ফলে তারা সবচেয়ে কম সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় সমান পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় ৪৪ শতাংশ হিন্দু সম্পত্তি দখল করেছে। অন্যদিকে যারা বিরোধীপক্ষ, তারা কম হলেও সম্পত্তি দখল করেছে। এ ব্যাপারে সব দলকেই দেখা গেলেও একটি বিষয় কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াত কি তাহলে রাজনৈতিকভাবে এক হয়ে গেল? তাদের কি কোনো স্বতন্ত্র পরিচিতি
নেই? সেটা অবশ্যই আছে। আওয়ামী লীগ যদি চিন্তা করে কোনটি আমার জন্য লাভজনক, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, নাকি তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক দায় ইত্যাদি রক্ষা করা। এই দুটি বিষয়কে যদি আমরা দুই পাল্লায় রাখি, তাহলে কিন্তু তাদের সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সম্পত্তি দখল করার কথা নয়।
প্রথম আলো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, স্থানীয় সম্পর্কের সংঘাত ও নির্বাচনী রাজনীতি কাজ করে এবং দায়ীরা যে দলেরই হোক, কেউ তাদের শাস্তি দিতে চায় না। এখন পর্যন্ত কি কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয়েছে?
মোহাম্মদ রাফি না, বিচার হয়নি। ২০০১-এর ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা আমার কাছে দুবার এসেছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেদন আমরা কেউ দেখিনি। ওই ঘটনার বিচারও হতে শুনিনি। অবশ্যই বিচারহীনতা যেকোনো অপরাধকে বাড়ায়।
প্রথম আলো উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার সূত্রপাতের মুহূর্ত হিসেবে দেশভাগকে অনেকে দায়ী করেন। কিন্তু বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার ধরনটা কি বদলায়নি?
মোহাম্মদ রাফি দেশভাগের অনেক আগে থেকে এখানে সাম্প্রদায়িকতা যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে রয়েছে। যেমন, চর্যাপদে দেখি বৌদ্ধদের ব্যাপারে হিন্দুদের ঘৃণা। এ দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সময় ব্রাহ্মণেরা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার অনেক ঘটনা আছে। এরপর এই অঞ্চলে মুসলমান শাসকদের আমলে ধর্মান্তরকরণের ইতিহাস সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, তা তো নয়। অনেকে বলে, এখানে তরবারির জোরে ধর্মান্তর হয়েছে। এ কথা পুরোপুরি যেমন ঠিক না, তেমনি একদম ভুলও নয়।
প্রথম আলো দেখা যাচ্ছে, উপকূলীয় ও সীমান্তবর্তী গ্রামে যেখানে হিন্দুদের বসতি বেশি এবং সেখানেই সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর উৎপত্তি বেশির ভাগই শহরে। দুই দেশের সাম্প্রদায়িকতার গড়নে কি কোনো পার্থক্য দেখেন?
মোহাম্মদ রাফি: ১৯৪৭-এর দেশভাগের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা গিয়ে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বসতি গড়েছে। আর ভারত থেকে আসা অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা ঢাকাসহ বড় শহরে বসতি গেড়েছে। ভারতের উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানেরা শ্রমিক হিসেবে শহরাঞ্চলে জড়ো হয়েছে। এখানে পার্থক্য হচ্ছে, শহরাঞ্চলে বসবাস এবং শ্রমিক হওয়ার কারণে ভারতীয় মুসলমানেরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং লড়াই করতে পারছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে তেমনটা আমরা দেখছি না।
প্রথম আলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চোখ দিয়ে দেখলে কে তাদের শত্রু, কে মিত্র?
মোহাম্মদ রাফি আমার মনে হয় না একজন বুদ্ধিমান সংখ্যালঘু বিষয়টিকে এভাবে দেখে। তারা দেখে কে আমার জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই হিসাব থেকেই তারা কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তির প্রতি সমর্থন জানায়। কেননা, সব রাজনৈতিক দলই তাদের কমবেশি ক্ষতি করেছে।
প্রথম আলো আপনার আগের গবেষণায় সুপারিশ করেছিলেন, সহিংসতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের একটি যৌথ শক্তিতে পরিণত হতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব?
মোহাম্মদ রাফি হ্যাঁ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, হিন্দুরা নিজেরা যদি সংগঠিত হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়লে, সহিংসতার শিকার হলে ভারতে চলে যায়। কিন্তু ভারতের মুসলমানেরা তো সহিংসতার কবলে পড়লে পাকিস্তানে চলে যায় না। তারা লড়াই করে টিকে থাকে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে তারা। নীরব থেকে আরও বিপন্ন হলে তারা কী করবে, সেটা বিবেচনার বিষয় হয়। কিন্তু তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ‘করতে হবে’, ‘দিতে হবে’-জাতীয় কথা তাদের কাছ থেকে কম শুনি। উপকূল বা সীমান্ত এলাকার হিন্দুরা না হয় বড় ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচি নিতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা শহরের দেড় কোটি অধিবাসীর মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ লাখও হিন্দু ধর্মাবলম্বী থাকে, তাদের মধ্যে দুই লাখ মানুষও যদি সারা দেশের সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামত, তাহলে পুরো ঘটনাই অন্য রকম হয়ে যেত।
প্রথম আলো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চ রয়েছে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
মোহাম্মদ রাফি তাদের আন্দোলন অনেক দুর্বল। এটা দিলে ভালো হয়, এটা করা উচিত না—এমন কণ্ঠে তারা আন্দোলন করছে। সম্মিলিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ হলে হামলাকারী পক্ষ বা রাষ্ট্র সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবত। ফলে অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাদের পক্ষে যারা আসবে, তাদের সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু তারা নিজেদের যাতে ওই আন্দোলনে প্রাধান্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব মুসলমান তো খারাপ নয়। সংখ্যালঘুরা যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মাঠে নামে, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক মুসলমানকেও পাওয়া যাবে। তাই এই আন্দোলনে সবার আসার সুযোগও রাখতে হবে, একে নিছক সম্প্রদায়নির্ভর জোট করে রাখলে চলবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ রাফি ধন্যবাদ।
No comments