জুবায়ের থেকে বিশ্বজিৎ by সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ

জুবায়ের ও বিশ্বজিৎ_ পার্থক্য অনেক। জুবায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিশ্বজিৎ দর্জির দোকানদার। জুবায়ের এক সময় ছাত্রলীগ করতেন। যে দল যে দাবিই করুক না কেন, বিশ্বজিৎ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। জুবায়ের গ্রুপিং রাজনীতির শিকার। বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে সে প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু দু'জনকেই ২৪ বছরে কাটা পড়তে হয়েছে মৃত্যুর দুয়ারে। মৃৃত্যু ও মৃত্যুর ধরন তাদের এক কাতারে এনে দিয়েছে। দু'জনেই খুন হয়েছেন ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রবাজিতে। জুবায়ের ও বিশ্বজিৎ_ উভয়ের খুনিরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। 'প্রতিহিংসার রাজনীতি' তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে। উভয়েই 'প্রতিপক্ষ' হিসেবে চিহ্নিত হয়ে নিজেদের জীবন খুইয়েছেন!
এই 'প্রতিপক্ষ' ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটা সবাই জানেন যে, বিশ্বজিতের ক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষের প্রশ্ন তোলা বাতুলতা মাত্র। কিন্তু জুবায়েরের ক্ষেত্রে মোটেও তা নয়। জুবায়েরের একটা প্রত্যক্ষ পক্ষ ছিল অবশ্যই। পছন্দ-অপছন্দের এই পক্ষাবলম্বন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার জন্য যে তাকে প্রাণ দিতে হবে_ সেটা কে ভেবেছিল! জুবায়ের যে ভাবেননি_ এটা নিশ্চিত। কারণ যখন তিনি খুন হন তখন কোনো রকম রাজনীতির সঙ্গেই তার আর যুক্ততা ছিল না। ঘটনার জের তার পুরো জীবনকেই স্তব্ধ করে দিল! কিন্তু রাজনীতি করলেই কেন এমন নৃশংস আক্রোশের শিকার হতে হবে? আজকের দিনে এই প্রশ্নের খুবই জরুরি সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
পরিষ্কার হওয়া দরকার_ ছাত্র রাজনীতি ছিল, আছে এবং থাকতেই হবে। রাজনীতির যেহেতু প্রয়োজন আছে, সেহেতু ছাত্ররাজনীতির সেই রাজনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন আছে। মারামারি-কাটাকাটি-হানাহানি কোনো রাজনৈতিক সংজ্ঞায়নের মধ্যে পড়ে না। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত, তাদের সমস্যাটা মানসিকতার। কেন ক্ষমতাসীনরা বা ক্ষমতালিপ্সুরাই এসবে জড়িত_ এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এরা আসলে সিস্টেমের দাস। এই সিস্টেমের কারণে অসংখ্য জুবায়ের-বিশ্বজিৎ প্রাণ খুইয়েছে। জুবায়ের-বিশ্বজিৎ উদাহরণ মাত্র। এই সিস্টেমকে রাষ্ট্রের মস্ত বড় শক্তিশালী এক কাঠামো টিকিয়ে রেখেছে। সুতরাং সিস্টেমটা বদলাতে পারলে মানসিকতাটাও বদলে যাবে। অথবা মানসিকতার বদল ঘটলে সিস্টেমটাও বদলে ফেলা সম্ভব। তার জন্য উপযুক্ত নৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন। আর সে দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে।
বিশ্বজিতের মৃত্যু দৃশ্য এবং মৃত্যুদশা আমরা দেখেছি। বিশ্বজিৎকে যেভাবে মারা হয়েছে, মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোনো ক্রিকেট খেলার ধুন্ধুমার চার-ছক্কার হাইলাইট দেখছিলাম! মৃত্যু এতটা মর্মপীড়াদায়ক হয়! কিন্তু জুবায়েরের মৃত্যুদৃশ্য তো আমরা দেখিনি। নির্জন জঙ্গলে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে মারা হয়েছিল। তবু চোখ বন্ধ করে বলা যেতে পারে, বিশ্বজিতের মৃত্যুদৃশ্যের সঙ্গে জুবায়েরের কোনো দূরত্ব হয়তো নেই, পার্থক্য নেই। এই ঘটনা দুটি মুখোমুখি সংঘর্ষ ছিল না। অস্ত্রের সামনে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন তারা। কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। পৃথিবীকে নিশ্চয়ই তাদের তখন নির্মম এক জেলখানা মনে হচ্ছিল। হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র এই 'পৃথিবী' (দেশ)!
আরেকটি ক্ষেত্রে জুবায়ের-বিশ্বজিৎ অভিন্ন। পত্রিকার পাতায় খবর, বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের রক্ষার চেষ্টা চলছে। আর জুবায়েরের সব হত্যাকারী তো গ্রেফতার হয়ইনি, উল্টো গ্রেফতারকৃতরা ছাড়া পেয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি জুবায়েরকে আক্রমণ করা হয়। ৯ জানুয়ারি সকালে মারা যান তিনি। সেদিন থেকেই ছাত্র আন্দোলন শুরু। 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর'_ এ ব্যানারে সেই 'সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন' সারাদেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল_ অপরাধীদেরও বিচার বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সম্ভব। কিন্তু ওই যে, হায় সেলুকাস! দেখতে দেখতে জুবায়ের হত্যা ও সেই সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের এক বছর হয়ে গেল। কিন্তু খুনিদের রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার নিশ্চিত হলো না। আশাভঙ্গের এই কালেও প্রচণ্ড আশাবাদী মানুষ ৯ জানুয়ারি জুবায়েরের মৃত্যু দিবসকে 'সন্ত্রাসবিরোধী দিবস' আখ্যা দিয়ে লড়াইটা জারি রাখতে চায়। এই লড়াই আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোকে অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে রক্ষায় পথিকৃৎ হয়ে উঠুক।
sc.joydip@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.