রাজনীতির বাইরে থাকুক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের নানামুখী ষড়যন্ত্রের অংশ হলো স্কাইপে বিচারকের কথিত কথোপকথন নিয়ে ধূব্রজাল সৃষ্টি। এ নিয়ে দেশে ও বিদেশে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে জামায়াত। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) নামের একটি সংগঠন সম্প্রতি এ দাবি তুলেছে।
জামায়াতের ১০ জন নেতা যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় স্কাইপ ষড়যন্ত্রে জামায়াতে ইসলামীর যোগসাজশ রয়েছে বলেও বিবৃতিতে দাবি করেছে আইসিএসএফ। জামায়াতকে দায়ী করে বিবৃতিতে আরো বলা হয়, 'নিজেদের অপরাধ আড়াল এবং বিচার প্রক্রিয়া স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে জামায়াত নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে।'
এ কথা সত্য যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে জামায়াত-শিবির চক্র ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র করে চলছে। তারই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত কথোপকথন ও ই-মেইল হ্যাক এবং তা বিভিন্নভাবে বিকৃত করে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করেছে তারা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কথিত ওই কথোপকথনে এমন কোনো কিছু নেই, যা বিচার প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার যে দাবি এখন জামায়াত করছে, সে দাবিরও কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। তা ছাড়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা জামায়াতের সহযোগিতায় যা করেছে, তা যে সুপরিকল্পিত সাইবার অপরাধ, এ বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত এ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে সাইবার অপরাধ যারা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার যে দাবি এখন জামায়াত করছে, সে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩-এর ধারা ৬-এর অধীনে উপধারা-৬-তে বলা আছে, 'ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারপতি যেকোনো কারণে তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীদের সাক্ষ্য পুনরায় শুনতে বাধ্য নন।' ওই আইনে বলা হয়েছে, 'মামলায় যেটুকু সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, ঠিক সে পর্যায় থেকে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাবে।' বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে এখন বারবার বলা হচ্ছে, ৪০ বছর ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কেন করা হয়নি? তাদের এমন বক্তব্য সম্প্রতি খণ্ডন করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'যাঁরা বলেন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা ঠিক নয়। ১৯৭২ সালে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস অর্ডার জারি করার পর যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন অভিযোগে ৩৭ হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার জনের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করা হয়।' তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, 'তখন বিচারের জন্য ৭৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ওইসব ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন ও ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে যে কথা বিরোধীরা বলেন তা খণ্ডন করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ৩৭ হাজারের মধ্যে যে ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালগুলোতে তাদের বিচার চলছিল। শুধু রাজনৈতিক কারণে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কিন্তু কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমন ২৩ হাজার মানুষকে সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করা হয়। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রাথমিক উদ্যোগ ব্যাহত হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আইনটি বাতিল করে দিয়ে বিচারের কাজ সরাসরি বন্ধ করে দেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে যেই ১০-১২ হাজার লোক আটক ছিলেন, তাঁদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকটি মামলার বিচারকাজ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন এ বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং আরো জোরদার করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত তাদের বিদেশি মিত্রদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রবাসী জামায়াত নেতাদের উদ্যোগে গঠিত 'সেইভ বাংলাদেশ' নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার ব্যানারে এসব তৎপরতা চালানো হচ্ছে। জামায়াত মনে করে, বিদেশি সরকারগুলো চাপ দিলে বাংলাদেশ সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হতে পারে। এমনকি আপসও করতে পারে সরকার। পঞ্চাশের দশকে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড একই প্রক্রিয়ায় বৃহৎ শক্তির চাপে ধাপে ধাপে বাতিল করা হয় বলে জামায়াত এখন ঠিক ওই প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী আসলে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন ঘরানার রাজনৈতিক দল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপমহাদেশের ২৪টি দেশে ইখওয়ানের মতাদর্শীরা বর্তমান। অভিন্ন মতাদর্শের এসব দল একেক দেশে একেক নামে পরিচিত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় জামায়াতে ইসলামী নামে সংগঠিত এসব দল।
তুরস্ক, মিসর ও তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাসীন দলগুলো ইখাওয়ানপন্থী। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ কে পার্টি, মিসরের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, তিউনিসিয়ার শাসক দল আন্নাহাদা ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী একই মতাদর্শের। এসব দেশ থেকে এখন জামায়াতের পক্ষে প্রবল চাপ আসছে।
ইখওয়ানপন্থী ইসলামিক সরকারগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে জামায়াত। জামায়াত অভিযোগ করছে, তারা নির্যাতনের শিকার। তাদের দাবি, তারা একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ করেনি। সম্প্রতি তুরস্কের কাদিকয় স্কয়ারে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের দাবিতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামপন্থী সাদাত পার্টি এ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশ প্রবাসী জামায়াত নেতাদের ইন্ধনেই হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী জামায়াতের অব্যাহত প্রচার ও কয়েকটি দেশের লবিংয়ের কারণেই মুসলিম বিশ্বের কিছু নেতা একে মুসলিম নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাঁর মতে, জামায়াতের সংগঠনগুলোর অপপ্রচারের পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি নেই সরকারের। সরকার মুসলিম বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে পারেনি যে যুদ্ধাপরাধের বিচার মুসলিম দমন নয়। এটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কৃতকর্মের বিচার।
সম্প্র্রতি সেইভ বাংলাদেশের ব্যানারে জামায়াতের ১০০ প্রবাসী নেতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সংস্থাটি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে জামায়াতকে দমন করা হচ্ছে। সে যা-ই হোক, মনে রাখতে হবে, দেশবাসী যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ সম্পন্ন দেখতে চায়। এ বিচারকাজ বিলম্বিত করা ঠিক হবে না।
বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বিএনপির সাহায্য-সহানুভূতি পেয়ে আসছে। তা ছাড়া পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত নিজেদের করে নিয়েছে। হাজার হাজার ক্যাডার সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত করেছে। সর্বোপরি এরা দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে শক্তিশালী গণমাধ্যম সৃষ্টি করে নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
নানা কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কোনো দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে উন্নত হয় না। উন্নত হয় সে দেশের জনগণের মানসিকতার কারণে। আবার একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে, যখন সে দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি চরম আকার ধারণ করে। এ বিভক্তি মিটিয়ে ফেলার জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে রাজনীতির বাইরে রাখা। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভেদের সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা। কোনো বিবেকবান মানুষ একাত্তরের নৃশংসতাকে ক্ষমা করতে পারে না। চোখের সামনে যে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, নির্যাতন হয়েছে তা কোনো ধর্ম বা আদর্শই মেনে নিতে পারে না। পৃথিবীর অন্য সব মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি জনগণের কিছুটা আগ্রহ আছে। কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতি যুদ্ধাপরাধীদের দখলে থাকার কারণে এসব দলের তরুণ সদস্যদের প্রতি সাধারণ জনগণের ঘৃণা মাঝেমধ্যে বিস্ফোরিত হচ্ছে। আবার এসব দলের যুদ্ধাপরাধী নেতারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য দলীয় কর্মীদের মধ্যে দেশের প্রতি, দেশের স্বাধীনতার প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে এবং তা বর্তমান সরকারের মেয়াদেই শেষ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে জাতির মধ্যে বিভক্তির বিষবাষ্প থেকেই যাবে। এ বিভক্তিরেখা না মুছলে জনগণ দেশে বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমা করবে না। তাই অন্য কোনো বিষয়ে না হোক, অন্তত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা উচিত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এ কথা সত্য যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে জামায়াত-শিবির চক্র ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র করে চলছে। তারই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘন, ব্যক্তিগত কথোপকথন ও ই-মেইল হ্যাক এবং তা বিভিন্নভাবে বিকৃত করে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করেছে তারা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত কথিত ওই কথোপকথনে এমন কোনো কিছু নেই, যা বিচার প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার যে দাবি এখন জামায়াত করছে, সে দাবিরও কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। তা ছাড়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা জামায়াতের সহযোগিতায় যা করেছে, তা যে সুপরিকল্পিত সাইবার অপরাধ, এ বিষয়ে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত এ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে সাইবার অপরাধ যারা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
বিচার কার্যক্রম নতুন করে শুরু করার যে দাবি এখন জামায়াত করছে, সে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩-এর ধারা ৬-এর অধীনে উপধারা-৬-তে বলা আছে, 'ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারপতি যেকোনো কারণে তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীদের সাক্ষ্য পুনরায় শুনতে বাধ্য নন।' ওই আইনে বলা হয়েছে, 'মামলায় যেটুকু সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, ঠিক সে পর্যায় থেকে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাবে।' বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে এখন বারবার বলা হচ্ছে, ৪০ বছর ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কেন করা হয়নি? তাদের এমন বক্তব্য সম্প্রতি খণ্ডন করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'যাঁরা বলেন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা ঠিক নয়। ১৯৭২ সালে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস অর্ডার জারি করার পর যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন অভিযোগে ৩৭ হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার জনের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করা হয়।' তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, 'তখন বিচারের জন্য ৭৩টি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ওইসব ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬৮ জনকে যাবজ্জীবন ও ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে যে কথা বিরোধীরা বলেন তা খণ্ডন করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ৩৭ হাজারের মধ্যে যে ১০ থেকে ১২ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালগুলোতে তাদের বিচার চলছিল। শুধু রাজনৈতিক কারণে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কিন্তু কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমন ২৩ হাজার মানুষকে সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করা হয়। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার বাতিল করে দেওয়া হয়। এতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রাথমিক উদ্যোগ ব্যাহত হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আইনটি বাতিল করে দিয়ে বিচারের কাজ সরাসরি বন্ধ করে দেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে যেই ১০-১২ হাজার লোক আটক ছিলেন, তাঁদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকটি মামলার বিচারকাজ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন এ বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং আরো জোরদার করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত তাদের বিদেশি মিত্রদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রবাসী জামায়াত নেতাদের উদ্যোগে গঠিত 'সেইভ বাংলাদেশ' নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার ব্যানারে এসব তৎপরতা চালানো হচ্ছে। জামায়াত মনে করে, বিদেশি সরকারগুলো চাপ দিলে বাংলাদেশ সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হতে পারে। এমনকি আপসও করতে পারে সরকার। পঞ্চাশের দশকে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড একই প্রক্রিয়ায় বৃহৎ শক্তির চাপে ধাপে ধাপে বাতিল করা হয় বলে জামায়াত এখন ঠিক ওই প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী আসলে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন ঘরানার রাজনৈতিক দল। উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপমহাদেশের ২৪টি দেশে ইখওয়ানের মতাদর্শীরা বর্তমান। অভিন্ন মতাদর্শের এসব দল একেক দেশে একেক নামে পরিচিত। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় জামায়াতে ইসলামী নামে সংগঠিত এসব দল।
তুরস্ক, মিসর ও তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাসীন দলগুলো ইখাওয়ানপন্থী। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ কে পার্টি, মিসরের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, তিউনিসিয়ার শাসক দল আন্নাহাদা ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী একই মতাদর্শের। এসব দেশ থেকে এখন জামায়াতের পক্ষে প্রবল চাপ আসছে।
ইখওয়ানপন্থী ইসলামিক সরকারগুলোর কাছে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে জামায়াত। জামায়াত অভিযোগ করছে, তারা নির্যাতনের শিকার। তাদের দাবি, তারা একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ করেনি। সম্প্রতি তুরস্কের কাদিকয় স্কয়ারে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের দাবিতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামপন্থী সাদাত পার্টি এ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশ প্রবাসী জামায়াত নেতাদের ইন্ধনেই হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী জামায়াতের অব্যাহত প্রচার ও কয়েকটি দেশের লবিংয়ের কারণেই মুসলিম বিশ্বের কিছু নেতা একে মুসলিম নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করছেন। তাঁর মতে, জামায়াতের সংগঠনগুলোর অপপ্রচারের পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি নেই সরকারের। সরকার মুসলিম বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে পারেনি যে যুদ্ধাপরাধের বিচার মুসলিম দমন নয়। এটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কৃতকর্মের বিচার।
সম্প্র্রতি সেইভ বাংলাদেশের ব্যানারে জামায়াতের ১০০ প্রবাসী নেতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সংস্থাটি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে জামায়াতকে দমন করা হচ্ছে। সে যা-ই হোক, মনে রাখতে হবে, দেশবাসী যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ সম্পন্ন দেখতে চায়। এ বিচারকাজ বিলম্বিত করা ঠিক হবে না।
বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বিএনপির সাহায্য-সহানুভূতি পেয়ে আসছে। তা ছাড়া পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত নিজেদের করে নিয়েছে। হাজার হাজার ক্যাডার সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত করেছে। সর্বোপরি এরা দেশের অভ্যন্তরে এবং বহির্বিশ্বে শক্তিশালী গণমাধ্যম সৃষ্টি করে নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
নানা কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কোনো দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে উন্নত হয় না। উন্নত হয় সে দেশের জনগণের মানসিকতার কারণে। আবার একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে, যখন সে দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি চরম আকার ধারণ করে। এ বিভক্তি মিটিয়ে ফেলার জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে রাজনীতির বাইরে রাখা। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভেদের সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা। কোনো বিবেকবান মানুষ একাত্তরের নৃশংসতাকে ক্ষমা করতে পারে না। চোখের সামনে যে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, নির্যাতন হয়েছে তা কোনো ধর্ম বা আদর্শই মেনে নিতে পারে না। পৃথিবীর অন্য সব মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি জনগণের কিছুটা আগ্রহ আছে। কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতি যুদ্ধাপরাধীদের দখলে থাকার কারণে এসব দলের তরুণ সদস্যদের প্রতি সাধারণ জনগণের ঘৃণা মাঝেমধ্যে বিস্ফোরিত হচ্ছে। আবার এসব দলের যুদ্ধাপরাধী নেতারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য দলীয় কর্মীদের মধ্যে দেশের প্রতি, দেশের স্বাধীনতার প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে এবং তা বর্তমান সরকারের মেয়াদেই শেষ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে জাতির মধ্যে বিভক্তির বিষবাষ্প থেকেই যাবে। এ বিভক্তিরেখা না মুছলে জনগণ দেশে বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমা করবে না। তাই অন্য কোনো বিষয়ে না হোক, অন্তত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা উচিত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments