মহাজোটের চার বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি by হায়দার আকবর খান রনো
আওয়ামী লীগ ও এর নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের চার বছর পূর্ণ হলো। এই সরকারের মেয়াদকাল আছে আর এক বছরের মতো। চার বছর আগে জনগণ যে আশা নিয়ে বর্তমান সরকারকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিল, সে আশা যে পূরণ হয়নি, তা সাদা চোখেই দেখা যায়।
নির্বাচনী ওয়াদার বড় দাগের কয়েকটি তো চোখে পড়ার মতো। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন, তিনি সস্তা দরে চাল খাওয়াবেন, বিনা পয়সায় সার বিতরণ করবেন, প্রত্যেক পরিবারের একজনের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করবেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস থাকবে না। বোঝাই যায়, এসব ছিল তাৎক্ষণিক ওয়াদা; যা তিনিও জানতেন এবং অভিজ্ঞ মানুষরাও জানতেন যে ওসব ওয়াদা ছিল ভোটে জেতার কৌশল মাত্র। এক অর্থে রাজনৈতিক প্রতারণা।
ইংরেজি প্রবাদে আরেক ধরনের প্রতারণার কথা বলা হয়ে থাকে। বলা হয় যে সংখ্যাতত্ত্ব বা স্ট্যাটিসটিকস হচ্ছে এক ধরনের ফাঁকিবাজি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। সেখানে বর্তমান সরকারের চার বছরের সঙ্গে বিগত বিএনপি আমলের প্রথম চার বছরের একটা তুলনামূলক হিসাবও দেওয়া হয়েছে। এই তুলনা থেকে বোঝা যায় যে সেই আমলের চেয়ে এই আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশি হয়েছে। হয়তো কথাটা সত্য। যেসব সংখ্যাতত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যে ভুয়া, এমন কথা আমি বলছি না। কিন্তু সাধারণভাবে সংখ্যাতত্ত্ব দ্বারা আসল অবস্থাটা বোঝা যায় না। একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, দেশের মাথাপ্রতি বার্ষিক গড় আয় ৪০০ ডলার। এর দ্বারা কিন্তু অধিকাংশ জনগণের আয় কী, তা বোঝা গেল না। কারণ অল্পসংখ্যক লোকের অনেক বেশি আয় আর বেশির ভাগ লোকের আয় গড় আয়ের চেয়ে অনেক নিচে। তাহলে মাথাপিছু আয়- এই সংখ্যা দ্বারা দেশের প্রকৃত চেহারা বোঝা যায় না। সে জন্য বলা হয়, স্ট্যাটিসটিকস বেশ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, বাধা সৃষ্টি করে এবং এক অর্থে প্রতারণাও করে।
এবার দেখা যাক, বাংলাদেশ ব্যাংক কী তথ্য হাজির করেছে। এখনকার চার বছরের (২০০৯ থেকে ২০১২ অর্থবছর) মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৬.২১ শতাংশ। খুব বেশি কিন্তু নয়। এই দশকের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশ করার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে হলে অবশ্যই ৭ শতাংশ বা এর বেশি হারে প্রবৃদ্ধি লাগবে। যা হোক, বিগত বিএনপি আমলের চার বছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল এর চেয়ে সামান্য কম, ০.৭৪ শতাংশ কম।
আগের আমলের তুলনায় এই আমলে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বস্তুত রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণেই বেড়েছে এই রিজার্ভ। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে (বিএনপি আমলে) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২.৯৩ বিলিয়ন ডলার। আর এখন রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ১২.৭০ বিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধি হয়েছে চার গুণেরও বেশি। এর মূল কারণ রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ঘটেছে সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। ২০০২-০৫ অর্থবছরের সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ১২.৭৮ বিলিয়ন ডলার। আর এই সময়, অর্থাৎ ২০০৯-২০১২ অর্থবছরের সময় রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫.১৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের খুব একটা কৃতিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। উপরোক্ত দুই সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে পৌনে তিন গুণেরও বেশি। ২০০৪-০৫ অর্থবছরের শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছিল ২৮.৩২ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০৯-১২ অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৭৮.৯৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই সময়কালে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে সমপরিমাণ।
এখানে এই কথাটা বলা দরকার যে বর্তমান মহাজোটের শাসনামলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হলো রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাড়তি খরচ। অন্যথায় রিজার্ভ আরো বেশি হতো। রেন্টাল বিদ্যুতের যে প্রকল্প, তা ছিল দারুণভাবে অবিবেচনাপ্রসূত এবং অনেকের সন্দেহ যে এর দ্বারা কাউকে কাউকে আর্থিকভাবে লাভ করিয়ে দেওয়ার একটা গোপন উদ্যোগ ছিল। রেন্টালের দ্বারা বিদ্যুৎ তেমন বাড়েনি, কিন্তু জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়েছে অতিরিক্ত। ফলে অর্থনীতির ওপর, রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে।
আগেই বলেছি, এ রকম সংখ্যাতত্ত্ব দ্বারা কখনোই পুরো চিত্রটি পাওয়া যায় না। এখনো বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বছরে তিন থেকে চার মাস অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে কোনোমতে বাঁচার চেষ্টা করে। কত কোটি মানুষ রাতের বেলায় ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, এর কোনো স্ট্যাটিসটিকস নেই। পাঁচ বছর পরপর ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, দেশে কী ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে। চোখ ঝলসানো হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও শপিংমল রাজধানীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, দেশের উন্নয়নেরও স্বাক্ষর বহন করছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু লোকের হাতে প্রচুর টাকা জমেছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে একটি উৎকট ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে, মুৎসুদ্দি ও লুটেরা চরিত্র যাদের পুঁজি সঞ্চয়ের প্রধান ভিত্তি। এরা অবশ্য কিছু কিছু শিল্প ও ব্যাংকিং খাতেও গেছে। এই আওয়ামী-মহাজোটের আমলেও কোনো কোনো মন্ত্রী ব্যাংকের মালিক হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন। এই ধনিক শ্রেণীর চোখ ঝলসানো বিলাসিতা ও অপচয় আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য রীতিমতো পাপ। তবে এই ধনিক শ্রেণীর পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কিছুটা বিস্তার ঘটেছে, সংখ্যায় ও বিত্তসম্পদে। কিন্তু এর নিচেই যে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে তাদের উন্নয়ন কোথায়? ঢাকা শহরেই ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী, নগরজীবনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেখানে পানির জন্য হাহাকার পড়ে।
বাংলাদেশের মধ্যেই রয়েছে দুই দেশ। ধনীর বাংলাদেশ ও গরিবের বাংলাদেশ। এ যাবৎ সব সরকার একটি সমৃদ্ধির জন্য আরেকটিকে চুষে ছোবড়া বানিয়ে দিচ্ছে। আজকের শেখ হাসিনার সরকার বা গতকালকের খালেদা জিয়ার সরকার- কেউই ব্যতিক্রম নয়।
এই সরকারের আমলে গার্মেন্টশ্রমিকরা কয়েকবার অভ্যুত্থান করেছে। বিশেষ করে ২০১০ সালের শ্রমিক অভ্যুত্থান বড় ধরনের শ্রেণীসংগ্রামের ঘটনা। সরকারের পুলিশ প্রশাসন বর্বর আক্রমণ চালিয়েছিল শ্রমিকদের ওপর। মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে দৈহিক অত্যাচার চালিয়েছিল তুহিন চৌধুরীকে, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জেলে আটক রেখেছিল মন্টু ঘোষকে, নারী রাজনৈতিক নেত্রী মাশরুফা মিশুকে দিনের পর দিন রিমান্ডে রেখেছে, শত শত নারীশ্রমিককে ধরে নিয়ে বর্বর দৈহিক অত্যাচার করেছে র্যাব ও পুলিশ। তাজরীনের ১২৪ শ্রমিক মারা গেলেও মালিক শ্রেণীর সরকার হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী মালিককে গ্রেপ্তার করেনি। গার্মেন্টে যে শ্রমদাসত্ব চলছে এবং কারখানাগুলো যে মৃত্যুকূপ, তা সরকারের, শ্রমমন্ত্রীর- কারোরই চোখে পড়ে না। বরং প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এনে মালিককে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এক বক্তৃতায় বলেছেন, গার্মেন্টে আগুন ও বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা- সবই নাকি করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে। অথচ কে না জানে যে তাজরীনে অগি্নকাণ্ড ও শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী স্বয়ং মালিক এবং তাঁর অতি মুনাফার লোভ। আর বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে তো প্রধানমন্ত্রীর নিজ দলের ছেলেরা- ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের তাণ্ডব, সন্ত্রাস, হত্যা, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অবশ্য নতুন কিছু নয়। দলীয় সন্ত্রাস, দলবাজি ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায় যা হচ্ছে বাজিকরদের খেলা, এর পরিণতিতে শুধু যে বিপুল ভোটে বিজয়ী মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে তা-ই নয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত এবং লুণ্ঠিত হয়েছে। গুম, খুন, ক্রসফায়ার এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকারকে আর গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না।
বর্তমান সরকারের একমাত্র কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক প্রলম্বিত হয়েছে। ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু শুরু করতেও যথেষ্ট দ্বিধাভাব অথবা চরম অমনোযোগিতা যে ছিল, এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমে যে তদন্ত সংস্থা করা হলো, দেখা গেল এর প্রধান যে ব্যক্তি তিনি নাকি জামায়াতিদেরই একজন। বড় অদ্ভুত লাগে! কী করে এমনটা হতে পারে! সরকারের পক্ষ থেকে চরম অমনোযোগিতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। দুই বছর পর বিচারকের ক্ষমাহীন মূর্খতা ও শেষ পর্যন্ত তাঁর পদত্যাগ কিছুটা হলেও জটিলতা সৃষ্টি করেছে।
এই সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট ইত্যাদি ইস্যুতে সমঝোতা তৈরি হলেও এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদার হলেও তিস্তা চুক্তি হয়নি, সীমান্তে বিএসএফের গুলি ও হত্যা বন্ধ হয়নি এবং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প থেকে ভারতকে এখনো নিবৃত্ত করা যায়নি।
মহাজোটের শাসনামলে ঘুষ-দুর্নীতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। হলমার্ক ও অন্যান্য ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং এর সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকার ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এর আগে থেকেই চলে আসছিল শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং এর ফলে পথে বসেছে কয়েক লাখ মধ্যবিত্ত যুবক। সবশেষে পদ্মা সেতু দুর্নীতি ধসিয়ে দিয়েছে সরকারের ভাবমূর্তি। প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বিশ্বব্যাংককেই অভিযুক্ত করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতির আখড়া এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হাতিয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেভাবে না বললেও নিজস্ব স্টাইলে সত্য কথাটি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, সেভাবে আর কোনো সরকারপ্রধান বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন, 'বিশ্বব্যাংকের কি অডিট হয়?' 'ওরা কত কমিশন খেয়েছে?' স্পষ্টতই বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এ ধরনের বাক্যে। আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম। তিনি যখন ঘোষণা দিলেন যে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, আমরা আরো উৎসাহিত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম প্রধানমন্ত্রী সেই অবস্থানে থাকলেন না। একে একে তাদের শর্ত মেনে আত্মসমর্পণ করলেন। আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরাতে বাধ্য হলেন। উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বাধ্য হলেন দীর্ঘ ছুটি নিতে। দুর্নীতি দমন কমিশন, যার আবার নিজস্ব মেরুদণ্ডই নেই, সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো অবস্থান নেওয়ার সৎসাহসটুকু যাদের নেই, তারা স্বীকার করল, দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির তদন্তে অংশ নিল বিশ্বব্যাংকের খুব উঁচু পর্যায়ের এক প্যানেল। তবুও শেষ পর্যন্ত দুইয়ের মধ্যে মতের মিল হলো না। দুদক তথা সরকার জিদ ধরল সাবেক দুই মন্ত্রী আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে অভিযুক্ত করা যাবে না। সৈয়দ আবুল হোসেনের অতীত রেকর্ড আবার ভালো নয়। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে কী চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, বিশ্বব্যাংক তার অবস্থানের পক্ষে কী সাক্ষ্য-প্রমাণ-তথ্য হাজির করেছে, সে সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। জনগণকে যত অন্ধকারে রাখা হবে তত জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে। বস্তুত হচ্ছেও তাই। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অনেক সত্য-মিথ্যা গল্প ও গুজব বাতাসে ছড়াচ্ছে; যা কখনোই দেশের জন্য শুভ হতে পারে না।
এই আমলের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত বিষয় হলো ১৫তম সংশোধনী। হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর ১৯৭২-এর সংবিধান সহজেই চলে এসেছিল। অবশ্য পরবর্তী সংশোধনীগুলো যথা 'ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম' এ ধারা বহাল ছিল। কিন্তু আদি সংবিধানের ৩৮ ধারা পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বললেন যে জামায়াত এখন নিষিদ্ধ দল। কিন্তু এই অবস্থানে শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল ও সরকার থাকল না। তিনি নতুন করে সংশোধনী আনলেন। এরশাদ প্রবর্তিত ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকল, জিয়া প্রবর্তিত সংবিধানের মাথায় বিসমিল্লাহ লেখা থাকল আগের মতো। বিসমিল্লাহ রাখার বিধানটি ধর্মানুরাগ নয়, বরং ভণ্ডামি। এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আর নিষিদ্ধ থাকল না। শেখ হাসিনা মৌলবাদীদের সঙ্গে আবারও আপস করলেন, যেমন করেছিলেন ২০০৬ সালে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও এর নেত্রী খালেদা জিয়া তো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ঘর করছেন। আগেও মন্ত্রিসভা করেছেন এবং এখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এই প্রশ্নে খালেদা জিয়ার অবস্থান অধিকতর ঘৃণ্য।
১৫তম সংশোধনীর আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে একদা আওয়ামী লীগই কিন্তু আন্দোলন করেছিল। এসব বুর্জোয়া দলের নীতি পরিবর্তন করতে এবং পাল্টাযুক্তি সাজাতে কোনো দ্বিধা থাকে না। অন্তত দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখার জন্য হাইকোর্ট যে তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, সেটাও গ্রাহ্যের মধ্যে নিল না ক্ষমতাসীন সরকার।
এই বিষয়টি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। এক বছর পর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি কেমন হবে- তা অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। আরো আশঙ্কা হচ্ছে, এই সুযোগে অন্ধকারের শক্তি চেপে বসতে পারে, যা দেশের জন্য কখনোই মঙ্গল হতে পারে না।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখকএবার দেখা যাক, বাংলাদেশ ব্যাংক কী তথ্য হাজির করেছে। এখনকার চার বছরের (২০০৯ থেকে ২০১২ অর্থবছর) মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৬.২১ শতাংশ। খুব বেশি কিন্তু নয়। এই দশকের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশ করার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে হলে অবশ্যই ৭ শতাংশ বা এর বেশি হারে প্রবৃদ্ধি লাগবে। যা হোক, বিগত বিএনপি আমলের চার বছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল এর চেয়ে সামান্য কম, ০.৭৪ শতাংশ কম।
আগের আমলের তুলনায় এই আমলে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বস্তুত রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণেই বেড়েছে এই রিজার্ভ। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে (বিএনপি আমলে) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২.৯৩ বিলিয়ন ডলার। আর এখন রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ১২.৭০ বিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধি হয়েছে চার গুণেরও বেশি। এর মূল কারণ রেমিট্যান্স বৃদ্ধি। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ঘটেছে সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। ২০০২-০৫ অর্থবছরের সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ১২.৭৮ বিলিয়ন ডলার। আর এই সময়, অর্থাৎ ২০০৯-২০১২ অর্থবছরের সময় রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫.১৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের খুব একটা কৃতিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। উপরোক্ত দুই সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে পৌনে তিন গুণেরও বেশি। ২০০৪-০৫ অর্থবছরের শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছিল ২৮.৩২ বিলিয়ন ডলার। আর ২০০৯-১২ অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৭৮.৯৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই সময়কালে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে সমপরিমাণ।
এখানে এই কথাটা বলা দরকার যে বর্তমান মহাজোটের শাসনামলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির একটা বড় কারণ হলো রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাড়তি খরচ। অন্যথায় রিজার্ভ আরো বেশি হতো। রেন্টাল বিদ্যুতের যে প্রকল্প, তা ছিল দারুণভাবে অবিবেচনাপ্রসূত এবং অনেকের সন্দেহ যে এর দ্বারা কাউকে কাউকে আর্থিকভাবে লাভ করিয়ে দেওয়ার একটা গোপন উদ্যোগ ছিল। রেন্টালের দ্বারা বিদ্যুৎ তেমন বাড়েনি, কিন্তু জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়েছে অতিরিক্ত। ফলে অর্থনীতির ওপর, রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে।
আগেই বলেছি, এ রকম সংখ্যাতত্ত্ব দ্বারা কখনোই পুরো চিত্রটি পাওয়া যায় না। এখনো বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বছরে তিন থেকে চার মাস অখাদ্য, কুখাদ্য খেয়ে কোনোমতে বাঁচার চেষ্টা করে। কত কোটি মানুষ রাতের বেলায় ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, এর কোনো স্ট্যাটিসটিকস নেই। পাঁচ বছর পরপর ঢাকা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, দেশে কী ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে। চোখ ঝলসানো হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও শপিংমল রাজধানীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে, দেশের উন্নয়নেরও স্বাক্ষর বহন করছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু লোকের হাতে প্রচুর টাকা জমেছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে একটি উৎকট ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে, মুৎসুদ্দি ও লুটেরা চরিত্র যাদের পুঁজি সঞ্চয়ের প্রধান ভিত্তি। এরা অবশ্য কিছু কিছু শিল্প ও ব্যাংকিং খাতেও গেছে। এই আওয়ামী-মহাজোটের আমলেও কোনো কোনো মন্ত্রী ব্যাংকের মালিক হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন। এই ধনিক শ্রেণীর চোখ ঝলসানো বিলাসিতা ও অপচয় আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য রীতিমতো পাপ। তবে এই ধনিক শ্রেণীর পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কিছুটা বিস্তার ঘটেছে, সংখ্যায় ও বিত্তসম্পদে। কিন্তু এর নিচেই যে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে তাদের উন্নয়ন কোথায়? ঢাকা শহরেই ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী, নগরজীবনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেখানে পানির জন্য হাহাকার পড়ে।
বাংলাদেশের মধ্যেই রয়েছে দুই দেশ। ধনীর বাংলাদেশ ও গরিবের বাংলাদেশ। এ যাবৎ সব সরকার একটি সমৃদ্ধির জন্য আরেকটিকে চুষে ছোবড়া বানিয়ে দিচ্ছে। আজকের শেখ হাসিনার সরকার বা গতকালকের খালেদা জিয়ার সরকার- কেউই ব্যতিক্রম নয়।
এই সরকারের আমলে গার্মেন্টশ্রমিকরা কয়েকবার অভ্যুত্থান করেছে। বিশেষ করে ২০১০ সালের শ্রমিক অভ্যুত্থান বড় ধরনের শ্রেণীসংগ্রামের ঘটনা। সরকারের পুলিশ প্রশাসন বর্বর আক্রমণ চালিয়েছিল শ্রমিকদের ওপর। মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে দৈহিক অত্যাচার চালিয়েছিল তুহিন চৌধুরীকে, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জেলে আটক রেখেছিল মন্টু ঘোষকে, নারী রাজনৈতিক নেত্রী মাশরুফা মিশুকে দিনের পর দিন রিমান্ডে রেখেছে, শত শত নারীশ্রমিককে ধরে নিয়ে বর্বর দৈহিক অত্যাচার করেছে র্যাব ও পুলিশ। তাজরীনের ১২৪ শ্রমিক মারা গেলেও মালিক শ্রেণীর সরকার হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী মালিককে গ্রেপ্তার করেনি। গার্মেন্টে যে শ্রমদাসত্ব চলছে এবং কারখানাগুলো যে মৃত্যুকূপ, তা সরকারের, শ্রমমন্ত্রীর- কারোরই চোখে পড়ে না। বরং প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এনে মালিককে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এক বক্তৃতায় বলেছেন, গার্মেন্টে আগুন ও বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা- সবই নাকি করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে। অথচ কে না জানে যে তাজরীনে অগি্নকাণ্ড ও শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী স্বয়ং মালিক এবং তাঁর অতি মুনাফার লোভ। আর বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে তো প্রধানমন্ত্রীর নিজ দলের ছেলেরা- ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের তাণ্ডব, সন্ত্রাস, হত্যা, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অবশ্য নতুন কিছু নয়। দলীয় সন্ত্রাস, দলবাজি ও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায় যা হচ্ছে বাজিকরদের খেলা, এর পরিণতিতে শুধু যে বিপুল ভোটে বিজয়ী মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে তা-ই নয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত এবং লুণ্ঠিত হয়েছে। গুম, খুন, ক্রসফায়ার এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকারকে আর গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না।
বর্তমান সরকারের একমাত্র কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক প্রলম্বিত হয়েছে। ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু শুরু করতেও যথেষ্ট দ্বিধাভাব অথবা চরম অমনোযোগিতা যে ছিল, এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমে যে তদন্ত সংস্থা করা হলো, দেখা গেল এর প্রধান যে ব্যক্তি তিনি নাকি জামায়াতিদেরই একজন। বড় অদ্ভুত লাগে! কী করে এমনটা হতে পারে! সরকারের পক্ষ থেকে চরম অমনোযোগিতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। দুই বছর পর বিচারকের ক্ষমাহীন মূর্খতা ও শেষ পর্যন্ত তাঁর পদত্যাগ কিছুটা হলেও জটিলতা সৃষ্টি করেছে।
এই সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট ইত্যাদি ইস্যুতে সমঝোতা তৈরি হলেও এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত বন্ধুত্বের সম্পর্ক জোরদার হলেও তিস্তা চুক্তি হয়নি, সীমান্তে বিএসএফের গুলি ও হত্যা বন্ধ হয়নি এবং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প থেকে ভারতকে এখনো নিবৃত্ত করা যায়নি।
মহাজোটের শাসনামলে ঘুষ-দুর্নীতির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। হলমার্ক ও অন্যান্য ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং এর সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়িত থাকার ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এর আগে থেকেই চলে আসছিল শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি এবং এর ফলে পথে বসেছে কয়েক লাখ মধ্যবিত্ত যুবক। সবশেষে পদ্মা সেতু দুর্নীতি ধসিয়ে দিয়েছে সরকারের ভাবমূর্তি। প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক কর্তৃক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বিশ্বব্যাংককেই অভিযুক্ত করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতির আখড়া এবং সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হাতিয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেভাবে না বললেও নিজস্ব স্টাইলে সত্য কথাটি যেভাবে তুলে ধরেছিলেন, সেভাবে আর কোনো সরকারপ্রধান বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন, 'বিশ্বব্যাংকের কি অডিট হয়?' 'ওরা কত কমিশন খেয়েছে?' স্পষ্টতই বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এ ধরনের বাক্যে। আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম। তিনি যখন ঘোষণা দিলেন যে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে, আমরা আরো উৎসাহিত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম প্রধানমন্ত্রী সেই অবস্থানে থাকলেন না। একে একে তাদের শর্ত মেনে আত্মসমর্পণ করলেন। আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরাতে বাধ্য হলেন। উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বাধ্য হলেন দীর্ঘ ছুটি নিতে। দুর্নীতি দমন কমিশন, যার আবার নিজস্ব মেরুদণ্ডই নেই, সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো অবস্থান নেওয়ার সৎসাহসটুকু যাদের নেই, তারা স্বীকার করল, দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির তদন্তে অংশ নিল বিশ্বব্যাংকের খুব উঁচু পর্যায়ের এক প্যানেল। তবুও শেষ পর্যন্ত দুইয়ের মধ্যে মতের মিল হলো না। দুদক তথা সরকার জিদ ধরল সাবেক দুই মন্ত্রী আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে অভিযুক্ত করা যাবে না। সৈয়দ আবুল হোসেনের অতীত রেকর্ড আবার ভালো নয়। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে কী চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছে, বিশ্বব্যাংক তার অবস্থানের পক্ষে কী সাক্ষ্য-প্রমাণ-তথ্য হাজির করেছে, সে সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। জনগণকে যত অন্ধকারে রাখা হবে তত জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে। বস্তুত হচ্ছেও তাই। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অনেক সত্য-মিথ্যা গল্প ও গুজব বাতাসে ছড়াচ্ছে; যা কখনোই দেশের জন্য শুভ হতে পারে না।
এই আমলের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত বিষয় হলো ১৫তম সংশোধনী। হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর ১৯৭২-এর সংবিধান সহজেই চলে এসেছিল। অবশ্য পরবর্তী সংশোধনীগুলো যথা 'ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম' এ ধারা বহাল ছিল। কিন্তু আদি সংবিধানের ৩৮ ধারা পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছিল। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বললেন যে জামায়াত এখন নিষিদ্ধ দল। কিন্তু এই অবস্থানে শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল ও সরকার থাকল না। তিনি নতুন করে সংশোধনী আনলেন। এরশাদ প্রবর্তিত ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম বহাল থাকল, জিয়া প্রবর্তিত সংবিধানের মাথায় বিসমিল্লাহ লেখা থাকল আগের মতো। বিসমিল্লাহ রাখার বিধানটি ধর্মানুরাগ নয়, বরং ভণ্ডামি। এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আর নিষিদ্ধ থাকল না। শেখ হাসিনা মৌলবাদীদের সঙ্গে আবারও আপস করলেন, যেমন করেছিলেন ২০০৬ সালে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও এর নেত্রী খালেদা জিয়া তো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ঘর করছেন। আগেও মন্ত্রিসভা করেছেন এবং এখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এই প্রশ্নে খালেদা জিয়ার অবস্থান অধিকতর ঘৃণ্য।
১৫তম সংশোধনীর আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে একদা আওয়ামী লীগই কিন্তু আন্দোলন করেছিল। এসব বুর্জোয়া দলের নীতি পরিবর্তন করতে এবং পাল্টাযুক্তি সাজাতে কোনো দ্বিধা থাকে না। অন্তত দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখার জন্য হাইকোর্ট যে তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, সেটাও গ্রাহ্যের মধ্যে নিল না ক্ষমতাসীন সরকার।
এই বিষয়টি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। এক বছর পর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি কেমন হবে- তা অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। আরো আশঙ্কা হচ্ছে, এই সুযোগে অন্ধকারের শক্তি চেপে বসতে পারে, যা দেশের জন্য কখনোই মঙ্গল হতে পারে না।
No comments