বাজার নিয়ন্ত্রণহীন- গণবিতরণ ব্যবস্থা না থাকায় by মিজান চৌধুরী
সরকারী গণবিতরণ ব্যবস্থা সক্রিয় না থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। গণবিতরণ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় সরকারের অনেক কথা আমলে নিচ্ছে না ব্যবসায়ী মহল।
ফলে প্রায় সময় অতিনিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এক সময় গণবিতরণ ব্যবস্থাপনা ভাল থাকলেও গত কয়েক বছরে পর্যায়ক্রমে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ফলে ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও আটা ময়দা গণবিতরণ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এই ব্যবস্থাপনায় চালের বাজার অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হলেও অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিরাজ করছে।গণবিতরণ ব্যবস্থায় এক সময় সরকারের হাতে রেশনিং ব্যবস্থা, চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে ১৫টি সরকারী চিনির কল, ভোজ্যতেলের জন্য সরকারী মিল, আটা ও ময়দার জন্য সরকারী কারখানা এবং টিসিবির মতো শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা ছিল। চালের বাজারের জন্য খাদ্য অধিদফতরের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়।
দু'একটি ক্ষেত্রে গণবিতরণ পদ্ধতি থাকলেও ব্যবস্থাপনায় দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। টিসিবি থাকলেও পুরো সক্রিয় নয়। সরকারের প্রথম বছরে এই সংস্থাকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেনি। লোকবলের অভাব, দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, সিদ্ধানত্ম নিতে বিলম্বের মতো নানা সমস্যায় এই সংস্থা নিমজ্জিত। গণবিতরণ ব্যবস্থা পরিচালনা করার ক্ষমতা টিসিবির নেই।
সরকারের হাতে ১৫ চিনির কল রয়েছে। চিনির বাজার সহনশীল রাখতে চিনির কলগুলো কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতি বছর এই মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার সঙ্গে লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলছে। সংশিস্নষ্ট সূত্র মতে, বছর শেষে এই চিনিকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই শ' কোটি টাকায়। বছরে চিনির চাহিদা কমপক্ষে ১২ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সরকারী চিনি কলে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। পাশাপাশি বেসরকারী পাঁচটি মিলে বর্তমান বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৪ লাখ টন। চিনি ও খাদ্য শিল্পকর্পোরেশনের সূত্র মতে, নর্থ বেঙ্গল ও সেতাবগঞ্জ চিনি কলের বয়স ৭৬ বছর, পাবনা চিনি কলের ১১ বছর এবং অন্যান্য চিনি কলের বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হবে। সাধারণ হিসাবে যে কোন মেশিন ২০ বছরের উপরে হলে উৎপাদন ক্ষমতা কমে আসে। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৫ বছরে দেশে নতুন করে ২০ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা বাড়বে। সে অনুযায়ী সরকারের গণবিতরণ ব্যবস্থাপনার উপকরণ খুবই করম্নণ অবস্থা। যে টুকু উৎপাদন করা হচ্ছে সরকারীভাবে তা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবতে পারছে না সরকার।
ভোজ্যতেল ও আটা ময়দার মিল সরকারের হাতে নেই। বেসরকারী খাতে ভোজ্যতেলের মিল বিক্রি করে দেয়া হয়। এরপর পুরো ভোজ্যতেলের বাজার চলে যায় প্রাইভেট কোম্পানির হাতে। পুরনো ঢাকায় সরকারের আটা ও ময়দার মিলটি বছরের পর বছর ধরে বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আটা ও ময়দার বাজারে ওই মিল কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
একমাত্র চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওএমএস কর্মসূচী, কাবিখা, টিআরসহ বিভিন্ন কর্মসূচী চালু রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এই কর্মসূচীর ওপর জোর দেয়া হয়েছে। টিআর খাতে ৪ লাখ মেট্রিক টন, ভিজিএফ খাতে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, কাবিখা খাতে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন এবং ভিজিডি খাতে ২ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া এ খাতে গণবিতরণ ব্যবস্থা আরও জোরদার ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে এক লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ১৩৭টি ও সারাদেশে ২ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার ৩৩৩টি গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
গণবিতরণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারম্নক খান জনকণ্ঠকে জানান, চিনির কলগুলো আধুনিকায়নের ব্যাপারে থাইল্যান্ডের রাজার উপদেষ্টা ও চিনি বিশেষজ্ঞ ড. তেরাপলের সঙ্গে আমি থাইল্যান্ডে বৈঠক করেছি। তিনি বলেছেন, দায়িত্ব পেলে এই মিলগুলো থেকে উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া সম্ভব হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে চিনি উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা উলেস্নখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চিনির কলগুলো সংস্কারের ব্যাপারে থাইল্যান্ডের বৈঠকের বিষয় আমি শিল্পমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। একদিকে রাজস্ব আদায় অন্যদিকে পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা_উভয় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরপরও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে অনেক পণ্যের দাম আমাদের কম আছে। টিসিবিকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক সময় টিসিবি, রেশনিং, কসকর সব পদ্ধতি ছিল। কিন্তু ওইসব কর্মকা-ে প্রচুর দুর্নীতিও হয়েছে। সে বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হচ্ছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা সেখানে দায়িত্ব পালন করবে। গণবিতরণ ব্যবস্থায় সিস্টেমলসসহ আরও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। এরপরও সরকার একটি রিফাইনারি মিলের সঙ্গে চুক্তি করেছে। আগামী মার্চ থেকে ওই রিফাইনারি মিল বোতলজাত তেল সরকারকে সরবরাহ করবে। এর আগে পামতেলের ব্যাপারে একটি মিলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সরকার তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাজার গবেষণাবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক কে. এ. এস মুর্শেদ জনকণ্ঠকে জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। বাজারে নজরদারি ও অতিগরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বৃদ্ধি ছাড়া বাজারে বেশি হাত দিতে গেলে সমস্যা হবে। গণবিতরণ ব্যবস্থা জোরদার করতে বিশাল ব্যয়বহুল বাজেট দরকার। তিনি বলেন, এই ব্যয় মেটানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ব্যবস্থাপনার জন্য শক্তি ও সংগঠনের প্রয়োজন। হঠাৎ করে এ ধরনের ব্যবস্থায় যেতে পারবে না। সরকারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে কেনাকাটা ও বিতরণ ব্যাপক অপচয় ও দুর্নীতির সম্ভাবনা বেশি। আনত্মর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়তই জিনিসপত্রের দাম ওঠানামা করছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কেনাকাটা সম্ভব নয়। তবে গরিব মানুষের নিত্যপণ্য চাল, ডাল, আটা ও কেরোসিন এসব পণ্যের বাজারে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।
No comments