নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক
ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে মিথ্যা ও ভীষণ উত্তেজনামূলক গুজব শুধু ঢাকা শহরেই প্রচার করা হইতেছে না_ সমস্ত প্রদেশেই ইহা ছড়ানো হইতেছে। আইন ভঙ্গকারীদের সমর্থন জানানোর জন্য মুসলিম লীগ এমএলএগণকে এবং স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোকেও ভীতি প্রদর্শন করা হইতেছে।
স্বাভাবিক শাসন পরিচালনা কার্যের বিঘ্ন সৃষ্টির জন্যও চেষ্টা চলিতেছে। স্থানীয় ছাত্র মহলকে উত্তেজিত করার জন্য প্রতি মুহূর্তে সুযোগ গ্রহণ করা হইতেছে। তাহাদিগকে এই বলিয়া উৎসাহিত করা হইতেছে যে, ইহা তাহাদের জাতীয় আন্দোলন। আইন ভঙ্গের জন্য তাহাদিগকে চাপ দেওয়া হইতেছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার জন্য প্রদেশের বিভিন্ন স্থানেও তাহারা দল প্রেরণ করিতেছে। উল্লেখিত ঘটনাগুলো এবং সরকারের হাতে যে সমস্ত প্রমাণ রহিয়াছে, তাহাতে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, এই ষড়যন্ত্রের মূলে গভীর উদ্দেশ্য রহিয়াছে এবং ষড়যন্ত্রের নেতাগণ পাকিস্তানের বাহির হইতে উৎসাহ পাইতেছে। এমতাবস্থায় এই সকল সড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রা করার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে সরকার কখনও ইতস্তত করিবেন না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের শুভাথর্ীগণও এই কাজে সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিবেন।_এপিপি"(সূত্র : দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)
নূরুল আমীনের উক্ত ভাষণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব। এ ব্যাপারে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
জনাব কাজী গোলাম মাহবুব বলেন_
"প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীন বেতার বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনের উপর যে কটা করিয়াছেন, আমরা তাহার তীব্র নিন্দা করি। আমরা জনসাধারণের কাছে তাঁর বক্তব্যের আসল রূপ প্রকাশ করিয়া দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।"
জনাব নূরুল আমীন বলিয়াছেন যে, ভাষা বা অপর কোন সমস্যা সম্পর্কে শাসনতন্ত্র মোতাবেক জনমত প্রকাশ করা হইলে তাহার কণ্ঠরোধ করার কোন ইচ্ছা সরকারের নেই। তাঁর কার্যকলাপ এবং ঢাকার বুকে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক হত্যা এবং পুলিশ ও মিলিটারির আচরণই প্রমাণ করিতেছে যে, এই উক্তি সবৈর্্বব মিথ্যা। যে শাসনতন্ত্রের উপর নূরুল আমীন সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাহা ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত দমনমূলক আইন ও অর্ডিন্যান্সেরই সমষ্টি। এই দমনমূলক আইনের বলেই তিনি তাঁহার স্বৈরাচারী শাসন কায়েম রাখিয়াছেন।
জনাব নূরুল আমীন আরও বলিয়াছেন যে, আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের বাহির হইতে প্রেরণা পাইতেছেন। এই উক্তি প্রমাণ করিবার জন্য আমরা তাঁহাকে চ্যালেঞ্জ করিতেছি। বর্তমান আন্দোলন সমগ্র দেশবাসীর আন্দোলন এবং ইহার নেতৃত্ব করিতেছেন বিভিন্ন দল ও মতাবলম্বী কমর্ীবৃন্দ। জনাব নূরুল আমীন তাঁহার ঘৃণ্য কার্যকলাপ আজ আর গোপন রাখিতে পারিতেছেন না, তাই তিনি এবং লীগ নেতৃবৃন্দ মিথ্যা রটনার পথ বাছিয়া লাইয়াছেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, যে জনতা গুলির সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছে তাহারা সেই সমস্ত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হইবে না।
তৃতীয়ত, আইন ও শৃক্মখলা ভঙ্গ করিয়া শান্তি বিনষ্ট করার জন্য কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ ও জনসাধারণের ওপর তিনি যে দোষারোপ করিয়াছেন তাহার ওপর মন্তব্য নি্#৬৩৭৪৩;্রয়োজন। আমরা শুধু এটুকুই বলিতে চাই যে, সরকারের পুলিশ ও মিলিটারিই শান্তিভঙ্গ করিয়াছে এবং বর্তমান বিশৃক্মখলার জন্য সরকারই দায়ী। সংগ্রাম পরিষদ বরাবরই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলিয়া আসিয়াছেন এবং এখনও শান্তিপূর্ণ হরতালের নির্দেশ দিয়াছেন; আমরা সর্বপ্রকার বিশৃক্মখলার বিরোধী।
জনাব নূরুল আমিন আরও বলিয়াছেন যে, ছাত্রগণ জনসভা ও শোভাযাত্রা করার অনুমতি চাহিলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঐরূপ অনুমতি দিতেন। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, সংগ্রাম পরিষদ অনুমতি প্রার্থনা করিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছেন। অতঃপর জনাব নূরুল আমীন 'ব্যবস্থা পরিষদ কর্তৃক বাংলা ভাষার দাবি স্বীকৃত হওয়ার পরও হরতাল পালন' সম্পর্কে যাহা বলিয়াছেন, সে প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট...আমাদের দাবি মানিয়া লইলেই আন্দোলন ান্ত হইবে; অন্যথায় শহীদানের বুকের রক্ত রঞ্জিত শপথ লইয়া জনসাধারণের আগাইয়া চলার অভিযান কিছুতেই ান্ত হইবে না। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন তাঁহার বক্তৃতায় মিলিটারির কাজের সমর্থনে যে সমস্ত উক্তি করিয়াছেন তাহা জনসাধারণের তীব্র ঘৃণারই উদ্রেক করে।
এই ব্যাপারে দুইটি বিষয়ে আমরা জনসাধারণকে সতর্ক করিয়া দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতেছি।
প্রথমত, জনাব একে ফজলুল হককে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসাইবার আহ্বান জানাইয়া প্রকাশিত এশতেহার। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সহিত এই এশতেহারের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের আন্দোলন কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে কেন্দ্র করিয়া নহে, আমাদের আন্দোলন সর্বদলীয়।
দ্বিতীয়ত, প্রাদেশিক লীগ ও বিভিন্ন লীগ নেতৃবৃন্দ এখন কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করিয়া জনসাধারণকে বুঝাইতে চাইতেছেন যে, তাঁহারা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। জনগণ লীগের এই চালে বিভ্রান্ত হইবে না। (চলবে)
No comments