ভারত মহাসাগরের পাড়ে তিন পা by মোস্তাফা জব্বার
ততণে আশরাফ ও সাহিদ ভিসা নিয়ে বাইরে এলো। ওরা কথা বলতে থাকল সুনীল এবং মফিদ নামের মালদ্বীপের অধিবাসী দু'জনের সঙ্গে। ওদের পরামর্শে আমরা জনপ্রতি ২০ রম্নফাইয়া দিয়ে ফেরি পার হলাম।
জীবনে প্রথম কোন বিমানবন্দর থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে আসতে হলো। সিঙ্গাপুর ও হংকং বিমানবন্দর সমুদ্রে তৈরি করা_কিন্তু তার জন্য গভীর সমুদ্রে ফেরিতে ভাসতে হয় না। ফেরি পার হওয়ার পর আর সুনীলকে দেখা গেলনা। ফেরিঘাটে মফিদকে পাওয়া গেল এবং সে জানাল আমাদের জন্য ঠিক করা সেন্ট্রাল হোটেলে সিট নেই_আমাদের হোস্ট প্যালেসে যেতে হবে। আমরা ৪০ রম্নফাইয়া করে দিয়ে টেক্সিতে যখন হোস্ট প্যালেস নামক একটি হোটেলে এলাম, যাকে আমার একটি গেস্ট হাউস মনে হলো, তখন মনে হলো মাত্র ৩০০ মিটার পথ এসেছি আমরা। মনটা বেশ খারাপ হলো। কারণ এই অপচয়টা আমরা না করলেই পারতাম। মনে হলো আমাদের ঠকানো হয়েছে। ৩০০ মিটার পথ আমরা লাগেজ টেনেও আসতে পারতাম। যাহোক হোটেলে একটি বাঙালী ছেলেকে পাওয়া গেল। সম্ভবত বাড়ি লক্ষ্মীপুর। নাম মুনির। সে বাংলা ভাষায় জানাল, আমরা দালালের খপ্পরে পড়েছি। মফিদ হোটেলের দালাল। এই হোটেলের ভাড়া সকালের নাস্তাসহ ৭৬ ডলার। কিন্তু মফিদ আমাদের কাছে ১০৬ ডলার দাবি করল। আমাদের সঙ্গে মহিলা ও শিশু ছিল বলে আমরা মফিদের সঙ্গে কোন তর্ক না করেই তার কথামতো দু'টি রম্নম নিয়ে মহিলা ও শিশুদের শুতে পাঠালাম। ততণে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটায় পেঁৗছে গেছে। আমরা ঠিক করলাম, ভোর ছটার পরে রম্নম ভাড়া নেব। তখন ছ'টা বাজতে মিনিট তিরিশেক বাকি আছে। এর ফলে একদিনের ভাড়া কম লাগবে। তিরিশ মিনিট লবিতে কাটানো কোন বিষয় নয়। কিন্তু তখনই ঘটল বিপর্যয়। হোটেলের মালিক জানাল, আমরা লবিতে থাকতে পারব না। লাগেজগুলো সে ভেতরে রেখে আমাদের লবি থেকে রাসত্মায় বের হতে বলল। জীবনে প্রথমবারের মতো কোন হোটেলের লবি থেকে বহিষ্কৃত হলাম। সম্ভবত কাজটি মফিদের। কারণ আমরা তার কথামতো রম্নম ভাড়া নিইনি। এমনকি সে রিসোর্ট ভাড়া করার জন্য আমাদের কাছে অগ্রিম টাকা চেয়েছিল, সেটিও আমরা দিইনি। এজন্য রেগে গিয়ে সে আমাদের ওপর অমানবিক ঝালটা মিটিয়েছে। আমরা যখন বের হই তখন বাঙালী ছেলেটির চোখ ছলছল করছে। ছোট চাকরি করে, ওর বলার কিছু নেই, তবুও চোখের পানি আটকাতে পারেনি। ওকে সানত্ম্বনা দিয়ে আমরা সাগর পাড়ের দিকে হাঁটতে থাকলাম। মুনিরের মালিক হোটেলের দরজায় তালা দিয়ে চলে গেছে। আমরা একশ' গজ দূরের সমুদ্রসৈকতে জনগণের জন্য তৈরি করা কংক্রিটের বেঞ্চে এসে বসলাম। কংক্রিটের বেঞ্চে শুতে একেবারে খারাপ লাগলনা। ভারত মহাসাগরের পাড়ে এই অভিজ্ঞতাটি সারা জীবনের একটি বড় সঞ্চয়। আমি শফিক ভাই, সাহিদ, আশরাফ, রম্নবেল_ সবারই মনের মাঝে জ্বালা। এরই মাঝে আবার একটু ভয়ও আছে। হোটেলের ছেলেটি বলছিল, এখানে স্থানীয় তরম্নণরা কাটার পার্টি নামে খ্যাত। ওরা বিদেশীদের এন্টি কাটার দিয়ে আঘাত করে এবং ছিনতাই করে। আমরা টের পেলাম আমাদের চাইতে একশ' গজ দূরে কিছু লোক কথা বলছে। কিছুটা ভয় কাজ করছিল। ওরাই আবার কাটার পার্টি নয় তো! ঠিক তখনই ফেরেশতার মতো উদয় হলো কাওসার। পাবনার ছেলে কাওসার আমরা যেখানে বসেছিলাম তার পাশের হোটেলের নাইটগার্ড। সে আমাদের কথা শুনে তার হোটেলে নিয়ে গেল। সবাইকে বসতে দিল। এমনকি দুটি চেয়ার একত্র করে আমরা শুতেও পারলাম। আমার জন্য সে একটি ফান্টার টিন আনল। জাতিগত টান যে কত বড় তার প্রমাণ রাখল সে যখন আরও জানাল যে, কোন একটি গেস্ট হাউজে অতি অল্প পয়সায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে সে। সাগরের যে লেগুনটির পাড়ে আমরা বসে ছিলাম সেটি বাঁধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা। ততণে ওই লেগুনে বোরখা পরা মহিলারা দলে দলে নামতে শুরম্ন করেছে। ভোরের আলো ফুটছে। দুনিয়ার কোন বিচে আমি স্থানীয়দের এমন আগ্রহ দেখিনি। এখানেই দেখলাম, ওরা অনেক সময় ধরে সমুদ্রস্নান উপভোগ করল।আমরা জানতাম, কাওসারের গেস্ট হাউস নয়, আসলে একটা ভাল হোটেল খুঁজছি আমরা। আমি হোটেল খুঁজতে বের হয়ে পড়লাম। আমার ধারণা কোনভাবেই হোটেলবিহীন শহর হতে পারে না মালে। হোস্ট প্যালেস বা সেন্ট্রালই দু'টি হোটেল নয়-আরও হোটেল নিশ্চয়ই আছে। বড় বড় দালানগুলো দেখে আমি হোটেল খুঁজতে থাকলাম। দেখলাম আশরাফ, রম্নবেল আর স্বপনও রাসত্মায়। ওদেরকে নিয়ে হাঁটার সময় পেলাম আরেকটি বাঙালী ছেলেকে। ওকে জানালাম, আমরা হোটেল খুঁজছি। সে আমাদের নিয়ে সরাসরি যে হোটেলটিতে পেঁৗছাল তার নাম হোটেল বাণী। সে দরোজায় টোকা দিতেই একটি অল্পবয়েসি মালদ্বীপের মেয়ের সাথে কথা বলে আমরা ৯০ ডলারে ভাড়া ঠিক করে রম্নম দেখলাম এবং দারম্নণ খুশি হলাম। মেয়েটির নাম রাই। হিন্দিতে এর অর্থ রাধা। কিন্তু আমি জানি রাধা হিসেবে তার নাম রাখা হয়নি। কারণ সে মুসলমান। পরে জেনেছি ওর নাম রাইডা। মালদ্বীপে নামের প্রথম দুটি শব্দ ডাকনাম হয়ে যায়। ওই হোটেলেরই আরেকটি মেয়ের নাম নাইমা। ওর ডাক নাম নাই। আমি ওকে জানালাম, তোমার নামের অর্থ, তুমি নাই। মেয়েটি হেসেছিল। রাইডার বাবা নেই। সে এ লেভেল পাস করে সংসারের প্রয়োজনে চাকরিতে ঢুকেছে। মালেতেই থাকে। রাই আমাদের জন্য ভোররাতেই রম্নম খুলে দিল। একদিনের অতিরিক্ত ভাড়া নিল না_এমনকি মালদ্বীপ সরকারের রম্নম ট্যাক্সও না। এমনকি আমাদের সবার জন্য সকালের নাসত্মা ফ্রি দিল।
তখনই আমার মনে হলো, দুনিয়াতে মফিদরা যেমন আছে তেমনি আছে রাইরা। একটি দেশে দুটি মানুষের দুই ধরনের মনোভাব আমাদের সবার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দিল। এরপর আমরা দুটি রাত ছিলাম, তিনটি দ্বীপে ঘুরতে গেছি। সর্বত্রই পেয়েছি অফুরনত্ম ভালবাসা। রাইডা ও নাইমার মতো মালদ্বীপবাসী, গণেশের মতো ভারতীয় ও রবির মতো শ্রীলঙ্কাবাসীর ভালবাসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশীর ভালবাসা। মালের অতি কাছের দ্বীপ হুলহুমালে বা ভিলিগিলিস্নতে যেমন পেয়েছি বাংলাদেশীদের পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা তেমনি কাডো বান্ডোস থেকে আমাদের ফিরতে দেরি হয়েছে বাংলাদেশীদের আতিথেয়তার সম্মান দিতে গিয়ে। বান্ডোসে অবশ্যই আমরা মালদ্বীপের পর্যটন সাফল্যের চাবিকাঠি দেখেছি। আমরা দেখেছি হাজার হাজার পর্যটক কেন হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে দিনের পর দিন মালদ্বীপে পড়ে থাকে। এই টুরিস্টদের মালেতে দেখা যায় না। স্বচ্ছ নীল পানি, জীবনত্ম রঙিন কোরাল এবং চমৎকার নিসর্গের জন্য রিসোর্টগুলো বিদেশীদের এত প্রিয়। কোন কোন রিসোর্ট দিনে ছয় হাজার ডলার পর্যনত্ম ভাড়া নিতে পারে। কারণ এমনটি আর কোন দেশে নেই। কিন্তু এর পরেও কথা আছে।
মালদ্বীপের এই দ্বীপগুলো থেকে বাংলাদেশের শেখার আছে। এই দ্বীপগুলো আমাদের নিঝুম দ্বীপ, দুবলার চর, হাতিয়া বা সেন্টমার্টিনের চাইতে সুন্দর নয়। বরং এগুলোকে মানুষের হাতে কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছে। মালদ্বীপের দ্বীপগুলো এত ছোট যে একটি রিসোর্ট করতেই জায়গা শেষ হয়ে যায়। আমরা সেন্টমার্টিনের মতো দ্বীপকে এমন রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। সেন্ট মার্টিনে কয়েকটি রিসোর্ট হতে পারে। এতে আমাদের পর্যটন আয় হবে বহুগুণ। অন্যদিকে মালদ্বীপে আমাদের যে জনগোষ্ঠী আছে তাদের প্রশিতি করে এদের আয় বাড়ানো যায়। আমরা যখন হুলহুমালে দ্বীপে যাই তখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয় প্রায় জনা চলিস্নশেক বাঙালীর। ওরা বাংলাদেশীদের ওখানে বসবাস করার যে বিবরণ দিয়েছে তা ভয়ঙ্কর এবং এজন্য বাংলাদেশ দূতাবাস সম্পর্কে সংসদীয় তদনত্ম হওয়া উচিত। বাংলাদেশীরা জানাল, ওরা অনেকে মাসের পর মাস বেতন পায় না। ওদের সামর্থ্য থাকে না মালিকের বিরম্নদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার। ওদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হয়। দিবেহীরা (মালদ্বীপিয়) যখন-তখন বাংলাদেশীদের ওপর চড়াও হয়। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে কোন অভিযোগ করলে তার জন্য কোন ব্যবস্থা তো নেয়া হয়ই না বরং কোন কোন সাধারণ কাজ যেমন পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানো ইত্যাদি কাজের জন্য ঘুষ দিতে হয়।
অন্যদিকে আমরা মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পের সুযোগ নিয়ে ভোগ্যপণ্য, মানবসম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি করতে পারি। মালদ্বীপ সার্কভুক্ত ও মুসলমান দেশ হবার সুবাদে ও এই অঞ্চলের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা নিতে পারে। মালদ্বীপ কার্যত শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে এসব সেবা নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ যেমন করে নিজের দেশের পর্যটনের বিকাশে মালদ্বীপের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে তেমন করে দেশটিকে একটি রফতানি বাজার হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে। মালদ্বীপের শিায়ও বাংলাদেশ অবদান রাখতে পারে। আমাদের দেশে মালদ্বীপের তরম্নণদের শিা দান ছাড়াও বাংলাদেশী পুঁজি দিয়ে মালদ্বীপে উচ্চ শিার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি সত্য যে, এর কোনটাই হচ্ছে না।
শ্রীলঙ্কা : আমার নিজের কাছে শ্রীলঙ্কাকে দেখে ভীষণ গর্ব হয়েছে। বিশেষত, তারা যে দতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে তামিল টাইগার নামক জঙ্গীবাদকে মোকাবেলা করেছে তার নজির এই অঞ্চলে বিরল। ভারত এর চাইতে বহুগুণ বড় দেশ হবার পরেও তাদের জন্য জঙ্গীবাদ বড় ধরনের হুমকি। পাকিসত্মান এরই মাঝে জঙ্গীবাদী দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ জঙ্গীবাদকে অতিক্রম করতে পারছে না। তামিল টাইগারদের বিরম্নদ্ধে তার সাফল্যের জন্যই আমরা আমাদের সফরের সময় দেখলাম শ্রীলঙ্কার নতুন নেতা রাজাপাকশের প্রবল জনপ্রিয়তা। হবারই কথা।
এর আগে আমি আপনাদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে থাইল্যান্ডের অগ্রগতি সম্পর্কে জানিয়েছি। এবার আমি আপনাদের শ্রীলঙ্কায় নিয়ে যাব। বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে আমাদের কাছে শ্রীলঙ্কাকে মনে হয়েছে অনেক উপযুক্ত স্থান যেখানে আমরা আমাদের বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের তুলনা করতে পারব। বিশেষ করে একটি যুদ্ধবিধ্বসত্ম দেশ কেমন করে তার সামনে চলার পথটাকে ধরে রাখতে পারে শ্রীলঙ্কা হচ্ছে তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টানত্ম।
ছয় আগস্ট ২০০৯ রাত থেকে মালেতে থাকার পর নয় আগস্ট ২০০৯ মালদ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কায় আসার শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের ফাইট আমরা দুপুরে পেলাম। মধ্যরাতে মালদ্বীপে নামার দুঃস্বপ্ন তখনও মাথা থেকে বিদায় হয়নি-তবে অনেকটা কেটে গেছে। বাণী হোটেলের আতিথেয়তার সঙ্গে তার কর্মকর্তা রাইদা, নাইমা ও রবির আচরণ ও হোটেলটির বাড়ির মতো পরিবেশ আমাদের সবাইকেই মালের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছে। আসার সময় মনে হচ্ছিল আরও দু'চারদিন থাকলে ভাল হতো।
কলম্বোতে আমাদের হোটেলও ঠিক করা ছিল। ওখানে আমরা খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ অতিথি। তাই কদরের কমতি ছিল না কলম্বোতে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কায় এমনকি আমরা বিমানবন্দর থেকে হোটেল ট্রান্সফারের বুকিংও ছিল। শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশীদের কোন ভিসা লাগে না। ফলে বিমানবন্দরেও কোন ঝামেলা নেই। কেউ আমাদের হোটেলের নামও জিজ্ঞেস করলনা। বিমানবন্দরটি ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, হংকং, সিউল বা এমনকি ঢাকার মতো এত বড় নয়। একটাই টার্মিনাল। তবে আধুনিক।
বিমানবন্দরে আমরা হিল্টন হোটেলের লিমোজিন পেলাম, যাতে প্রায় এক ঘণ্টায় আমরা কলম্বো হিল্টনে পেঁৗছালাম। কলম্বোর গলে ফেস এলাকার প্রানত্মে রাষ্ট্রপতির সচিবালয় ঘেঁষে হিল্টন একটি অভিজাত হোটেল। তার পাশেই বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র। দশতলার জানালায় দাঁড়িয়ে কলম্বো সমুদ্রবন্দর আর গলেফেসের সমুদ্র দু'টিই অপরূপ দেখা যায়। (চলবে)
No comments