মুদ্রানীতি : প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ by ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
এ লেখাটি মূলত মুদ্রানীতি ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক নিয়ে। এখানে টেকসই প্রবৃদ্ধি ও সুষম উন্নয়নের জন্য মুদ্রানীতির কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য অনেক ক্ষুদ্রাকার দেশের মতো বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে একটি উন্মুক্ত অর্থনীতির দেশ। কিন্তু এ দেশটির ছোট ভূমিতে একটি বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের কিছু কারণ বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ এখন 'টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট' হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার অভিজ্ঞতা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো জনবহুল ছোট্ট ভূখণ্ডে কোনো আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান হলে পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশেও সেটা সম্ভব হবে।
১. বাজার অর্থনীতিতে সরকারের নীতিবিষয়ক বিতর্ক
বাজার অর্থনীতিতে অনেকেই সরকারের ভূমিকা ও নীতির সমালোচনা করে থাকেন দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।
ক. সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়, সরকার যা করতে পারে এর চেয়ে বেসরকারি খাত ভালো করতে পারে।
খ. সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনা কাঠামো ও সরকারি নীতিগুলোর পদক্ষেপ দিন দিন সামাজিক কল্যাণ কমিয়ে দিচ্ছে, অথবা সম্পদ একটি গ্রুপের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রায়ই অন্য একটি কম যোগ্য গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
এর পরও সরকারি নীতি ও ভূমিকার বিষয়গুলো সামনে চলে আসছে, বিশেষত নিম্নলিখিত কয়েকটি কারণে :
ক. বাজারের ব্যর্থতা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সব সময় কল্যাণমুখী ও বৃহত্তর গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়ে থাকে না।
খ. বিশেষ স্বার্থান্বেষী গ্রুপ বাজার বাধাগ্রস্ত করে; মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়, যারা অযৌক্তিকভাবে মুনাফা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে।
গ. প্রাইভেট খাতের দুর্নীতি বৃদ্ধির জন্য দেনদরবারের ফলে সম্পদ ও শ্রম নষ্ট হয়, ব্যক্তিগত আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।
২. মুদ্রানীতির সমস্যা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ক. সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয় মুদ্রানীতির বিবর্তনে দুটি বিষয় মুখ্য হয়ে উঠেছে: এর মধ্যে রয়েছে সরকারের ব্যয়ের সম্প্রসারণমূলক নীতি (তথাকথিত অর্থনীতিবিদ কিন্স-এর স্বর্ণযুগ) থেকে শুরু করে নব্য উদারনীতিবাদের সংকোচনমূলক নীতি পর্যন্ত, যা কখনো কখনো আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক স্থিতিশীলতা ও কাঠামো সমন্বয়ের যুক্তিতে এই নীতিকে উৎসাহী করে।
খ. কিন্তু বর্তমানে উদ্বেগের কারণে একটি ভালো সরকারের জন্য প্রচেষ্টা থাকা উচিত বিশেষজ্ঞের মত এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ও জবাবদিহিতার মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করা। মুদ্রানীতি তৈরির ক্ষেত্রে অধিক প্রতিনিধিত্ব ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। এর পক্ষে সব চেয়ে বড় যুক্তি হলো, অর্থনৈতিক পলিসি এমনসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে, যেগুলো শুধু মুদ্রানীতির কারিগরি ও গতানুগতিক ছক দিয়ে বোধগম্য ও সমাধান হবে না। অর্থনীতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী বিষয়ে, যেমন মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির বেলায়, যা কিনা কারিগরি দিক ছাড়াও মূল্যবোধ ও জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যা রাজনীতিবিদদের জন্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
৩. মুদ্রানীতির লক্ষ্য
মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের আপেক্ষিক মূল্য (অথবা লভ্যাংশ) পরিবর্তন করে (যেমন টাকা, বন্ড, বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদি)।
ক. মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য
১. মূল্য স্থিতিশীল রাখা, ২. উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে সহায়তা করা এবং ৩. উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা।
খ. মুদ্রানীতির প্রত্যক্ষ লক্ষ্য
১. রিজার্ভ অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং ২. ব্যাপক (Broad) অর্থ ব্যবস্থাপনা।
গ. নীতিবিষয়ক মূল লক্ষ্য
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ২. প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি।
ঘ. মুদ্রানীতির মাধ্যম
১. ব্যাংক রেট, ২. ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, ৩. সংবিধিবদ্ধ লিকুইডিটি রেশিও, ৪. ওপেন মার্কেট অপারেশন এবং ৫. মরাল সুয়েসন।
৪. মূল্যস্ফীতির হার
মুদ্রানীতির ধরন পরিবর্তনের যে ঐতিহাসিক ধারণা এবং পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে এর প্রভাব, তা একটি প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে- কিভাবে মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে; উৎপাদন, মুদ্রা বিনিময় ও সুদের হারের ওপর প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে জুতসই ভূমিকা রাখতে শুধু মূল্যস্ফীতি হারের নিয়ন্ত্রণের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। মুদ্রা সরবরাহ, বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হারের সমন্বয় হওয়া উচিত মুদ্রানীতির মধ্যে। বাংলাদেশে ২০০৩ সালে বৈদেশিক মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হারের প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ বহু উদীয়মান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হারকে নমিন্যাল এঙ্কর (নামমাত্র খুঁটি) হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ইস্যুগুলো হলো :
ক. মুদ্রাস্ফীতি আরো ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। সম্প্রতি খাদ্য নয়, এমন পণ্যেরও দুই সংখ্যার (ডাবল ডিজিট) মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।
খ. মুদ্রাস্ফীতিতে প্রভাব ফেলেছে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের চড়ামূল্য এবং জ্বালানি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী বস্তুর মূল্য (যেসব উৎপাদনমুখী শিল্পে ব্যবহার হয়ে থাকে)।
গ. রিজার্ভ মানি ও ব্রড মানি বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাত থেকে উচ্চমাত্রায় সরকারের গৃহীত ঋণ মুদ্রাস্ফীতি উস্কে দিয়েছে। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করছে, যা প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে 'ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট' সৃষ্টি করেছে, যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ছয় মাসমেয়াদি যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে, সেখানে জোর দেওয়া হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে, অভ্যন্তরীণ অর্থবাজারে তারল্য সংকট দূর করতে এবং ফরেন রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং এই উদ্দেশ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অব্যাহত রাখা হয়েছে ব্রড মানি এবং প্রাইভেট সেক্টর ঋণবৃদ্ধির হার কমাতে, যাতে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে রাখা যায়। স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে মূল্যস্ফীতির হার কমানোই ছিল মুদ্রানীতির বিশেষ উদ্দেশ্য, অন্যান্য উদ্দেশ্য গৌণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির এই অবস্থান সামষ্টিক স্থিতিশীলতা, টেকসই প্রবৃদ্ধি ও দরিদ্রবান্ধব উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এটা প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে না, সম্পদ চলে যাবে ধনীদের হাতে। দরিদ্রবান্ধব নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির ক্রমাগত বাস্তবায়ন করার ফলে বৃহৎ ব্যবসার তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় অধিক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে এটা দৃশ্যমান হয়েছে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার
বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান পালনীয় নীতি হলো, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো এবং টাকার অবমূল্যায়নের বিরূপ প্রভাব ঠেকানো।
ক. কিছু মুখ্য ইস্যু
১. ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, ২. টাকার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের হার স্থিতিশীল রাখা, টাকার অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন প্রতিরোধ করা, ৩. আমদানির উচ্চ ব্যয় বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলে, ৪. উচ্চ রেমিট্যান্সের কারণে মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলে এবং ৫. টাকার বিনিময়ের সূচকের উচ্চ ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতির প্রবণতাকে সংযত করা।
খ. বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতার জন্য পদক্ষেপ :
১. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি: রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগ আয় বাড়ানো।
২. বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা : বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় ও বিক্রয়।
৩. বাংলাদেশ ব্যাংককে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হবে রপ্তানি বাজারে মুখ্য প্রতিযোগী দেশের মুদ্রা বিনিময় হারের ওঠানামার প্রতি, যাতে বাংলাদেশ তার প্রতিযোগিতার অবস্থান বুঝতে পারে।
৪. আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সাপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ আইএমএফ অনেক শর্ত জুড়ে দেয়, যার সব বিবেচনাযোগ্য নয় এবং অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৬. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে নমিনাল এঙ্করগুলোর (নামমাত্র খুঁটি, যেমন মূল্যস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার) প্রতি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন (অটোনমি)। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সত্যিকারে স্বায়ত্তশাসিত (প্রকৃত অর্থে অটোনোমাস) না হয়, তাহলে সরকারের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ এবং প্রাইভেট সেক্টরগুলোর অযৌক্তিক কার্যকলাপের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি ও কাজ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অভিমত এবং অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয় কি না, সেটাও দেখতে হবে; নতুবা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে না। সে জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষতা, নিষ্ঠা ও নিষ্ঠা অর্জন একান্ত প্রয়োজন।
৭. উদীয়মান দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন পদক্ষেপ
ক. বাংলাদেশসহ উদীয়মান (উন্নয়নশীল) দেশগুলোকে গতানুগতিক ধারার বাইরে মুদ্রানীতিকে নিয়ে যেতে হবে নিম্নলিখিত কারণে :
১. এ দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা সীমিত।
২. উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এই দেশগুলোর পণ্য ও সেবাবাজার আন্তর্জাতিক বাজার দ্বারা বেশি প্রভাবিত।
৩. এই দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সরবরাহ ও চাহিদার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিশৃঙ্খলা-অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। ৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু নীতির বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অভাব দেশকে আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
৫. আইনশৃঙ্খলার দুর্বল পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের সম্পদের অধিকার খর্ব, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি দুর্নীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে।
খ. মুদ্রানীতি দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন সফলতায় অবদান রাখতে পারে
১. দরিদ্রবান্ধব সরকারি নীতিকে সমর্থন করে।
২. অতি মাত্রায় দ্রুত মূল্যস্ফীতির ওঠা ও নামাকে এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। ৩. ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও টাকার বিনিময় হার স্থির রাখতে সহায়তার মাধ্যমে।
৪. অগ্রাধিকার দেওয়া উৎপাদনশীল খাতগুলোর জন্য ঋণ ও পুঁজি সংস্থানের মাধ্যমে। ৫. ব্যাংক, নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্রদের এবং নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বহির্ভূতদের আর্থিক সেবা, ঋণ ও পুঁজি সংস্থানের মাধ্যমে। ৬. করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি: সামাজিক খাত, পরিবেশ সংরক্ষণ, অনগ্রসর অঞ্চলের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ, পুঁজি ও আর্থ-সামাজিক সেবা প্রদান করার মাধ্যমে।
সুতরাং বাংলাদেশের মতো দেশের উচিত, প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে মুদ্রানীতি গ্রহণ করা এবং বহুমাত্রিক সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশের জন্য প্রচলিত ধারণার বাইরে দরিদ্রবান্ধব মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ শুধু সম্পদের অভাব বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবই নয়; বরং বিশেষ করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই হবে প্রধান অন্তরায়।
৮. সরকারের আয় ও ব্যয়-সংক্রান্ত নীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে নিবিড় সংযোগ আছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকাররা, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের বেন বারনানকে এবং কানাডার মার্ক কার্নি তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন, কী করে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি, শুধু এ দুটি বিষয়ের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারা যায়।
যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রয়াস ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততা থাকে তবে বাংলাদেশে কার্যকর ও যথাযথ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
১. বাজার অর্থনীতিতে সরকারের নীতিবিষয়ক বিতর্ক
বাজার অর্থনীতিতে অনেকেই সরকারের ভূমিকা ও নীতির সমালোচনা করে থাকেন দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে।
ক. সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়, সরকার যা করতে পারে এর চেয়ে বেসরকারি খাত ভালো করতে পারে।
খ. সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনা কাঠামো ও সরকারি নীতিগুলোর পদক্ষেপ দিন দিন সামাজিক কল্যাণ কমিয়ে দিচ্ছে, অথবা সম্পদ একটি গ্রুপের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রায়ই অন্য একটি কম যোগ্য গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
এর পরও সরকারি নীতি ও ভূমিকার বিষয়গুলো সামনে চলে আসছে, বিশেষত নিম্নলিখিত কয়েকটি কারণে :
ক. বাজারের ব্যর্থতা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সব সময় কল্যাণমুখী ও বৃহত্তর গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়ে থাকে না।
খ. বিশেষ স্বার্থান্বেষী গ্রুপ বাজার বাধাগ্রস্ত করে; মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়, যারা অযৌক্তিকভাবে মুনাফা ও সম্পদ কুক্ষিগত করে।
গ. প্রাইভেট খাতের দুর্নীতি বৃদ্ধির জন্য দেনদরবারের ফলে সম্পদ ও শ্রম নষ্ট হয়, ব্যক্তিগত আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।
২. মুদ্রানীতির সমস্যা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ক. সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয় মুদ্রানীতির বিবর্তনে দুটি বিষয় মুখ্য হয়ে উঠেছে: এর মধ্যে রয়েছে সরকারের ব্যয়ের সম্প্রসারণমূলক নীতি (তথাকথিত অর্থনীতিবিদ কিন্স-এর স্বর্ণযুগ) থেকে শুরু করে নব্য উদারনীতিবাদের সংকোচনমূলক নীতি পর্যন্ত, যা কখনো কখনো আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক স্থিতিশীলতা ও কাঠামো সমন্বয়ের যুক্তিতে এই নীতিকে উৎসাহী করে।
খ. কিন্তু বর্তমানে উদ্বেগের কারণে একটি ভালো সরকারের জন্য প্রচেষ্টা থাকা উচিত বিশেষজ্ঞের মত এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ও জবাবদিহিতার মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করা। মুদ্রানীতি তৈরির ক্ষেত্রে অধিক প্রতিনিধিত্ব ও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। এর পক্ষে সব চেয়ে বড় যুক্তি হলো, অর্থনৈতিক পলিসি এমনসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে, যেগুলো শুধু মুদ্রানীতির কারিগরি ও গতানুগতিক ছক দিয়ে বোধগম্য ও সমাধান হবে না। অর্থনীতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী বিষয়ে, যেমন মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির বেলায়, যা কিনা কারিগরি দিক ছাড়াও মূল্যবোধ ও জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যা রাজনীতিবিদদের জন্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
৩. মুদ্রানীতির লক্ষ্য
মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) বিভিন্ন ফিনান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের আপেক্ষিক মূল্য (অথবা লভ্যাংশ) পরিবর্তন করে (যেমন টাকা, বন্ড, বৈদেশিক মুদ্রা ইত্যাদি)।
ক. মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য
১. মূল্য স্থিতিশীল রাখা, ২. উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে সহায়তা করা এবং ৩. উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা।
খ. মুদ্রানীতির প্রত্যক্ষ লক্ষ্য
১. রিজার্ভ অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং ২. ব্যাপক (Broad) অর্থ ব্যবস্থাপনা।
গ. নীতিবিষয়ক মূল লক্ষ্য
১. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ২. প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি।
ঘ. মুদ্রানীতির মাধ্যম
১. ব্যাংক রেট, ২. ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও, ৩. সংবিধিবদ্ধ লিকুইডিটি রেশিও, ৪. ওপেন মার্কেট অপারেশন এবং ৫. মরাল সুয়েসন।
৪. মূল্যস্ফীতির হার
মুদ্রানীতির ধরন পরিবর্তনের যে ঐতিহাসিক ধারণা এবং পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে এর প্রভাব, তা একটি প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে- কিভাবে মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে; উৎপাদন, মুদ্রা বিনিময় ও সুদের হারের ওপর প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে জুতসই ভূমিকা রাখতে শুধু মূল্যস্ফীতি হারের নিয়ন্ত্রণের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। মুদ্রা সরবরাহ, বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির হারের সমন্বয় হওয়া উচিত মুদ্রানীতির মধ্যে। বাংলাদেশে ২০০৩ সালে বৈদেশিক মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হারের প্রবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ বহু উদীয়মান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হারকে নমিন্যাল এঙ্কর (নামমাত্র খুঁটি) হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ইস্যুগুলো হলো :
ক. মুদ্রাস্ফীতি আরো ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। সম্প্রতি খাদ্য নয়, এমন পণ্যেরও দুই সংখ্যার (ডাবল ডিজিট) মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।
খ. মুদ্রাস্ফীতিতে প্রভাব ফেলেছে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের চড়ামূল্য এবং জ্বালানি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী বস্তুর মূল্য (যেসব উৎপাদনমুখী শিল্পে ব্যবহার হয়ে থাকে)।
গ. রিজার্ভ মানি ও ব্রড মানি বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাত থেকে উচ্চমাত্রায় সরকারের গৃহীত ঋণ মুদ্রাস্ফীতি উস্কে দিয়েছে। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করছে, যা প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে 'ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট' সৃষ্টি করেছে, যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ছয় মাসমেয়াদি যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে, সেখানে জোর দেওয়া হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে, অভ্যন্তরীণ অর্থবাজারে তারল্য সংকট দূর করতে এবং ফরেন রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং এই উদ্দেশ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অব্যাহত রাখা হয়েছে ব্রড মানি এবং প্রাইভেট সেক্টর ঋণবৃদ্ধির হার কমাতে, যাতে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে রাখা যায়। স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে মূল্যস্ফীতির হার কমানোই ছিল মুদ্রানীতির বিশেষ উদ্দেশ্য, অন্যান্য উদ্দেশ্য গৌণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির এই অবস্থান সামষ্টিক স্থিতিশীলতা, টেকসই প্রবৃদ্ধি ও দরিদ্রবান্ধব উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এটা প্রবৃদ্ধি সহায়ক হবে না, সম্পদ চলে যাবে ধনীদের হাতে। দরিদ্রবান্ধব নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির ক্রমাগত বাস্তবায়ন করার ফলে বৃহৎ ব্যবসার তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় অধিক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে এটা দৃশ্যমান হয়েছে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার
বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান পালনীয় নীতি হলো, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমানো এবং টাকার অবমূল্যায়নের বিরূপ প্রভাব ঠেকানো।
ক. কিছু মুখ্য ইস্যু
১. ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, ২. টাকার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের হার স্থিতিশীল রাখা, টাকার অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন প্রতিরোধ করা, ৩. আমদানির উচ্চ ব্যয় বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলে, ৪. উচ্চ রেমিট্যান্সের কারণে মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলে এবং ৫. টাকার বিনিময়ের সূচকের উচ্চ ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতির প্রবণতাকে সংযত করা।
খ. বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতার জন্য পদক্ষেপ :
১. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি: রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগ আয় বাড়ানো।
২. বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা : বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় ও বিক্রয়।
৩. বাংলাদেশ ব্যাংককে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে হবে রপ্তানি বাজারে মুখ্য প্রতিযোগী দেশের মুদ্রা বিনিময় হারের ওঠানামার প্রতি, যাতে বাংলাদেশ তার প্রতিযোগিতার অবস্থান বুঝতে পারে।
৪. আইএমএফের ব্যালান্স অব পেমেন্টের সাপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ আইএমএফ অনেক শর্ত জুড়ে দেয়, যার সব বিবেচনাযোগ্য নয় এবং অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৬. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে নমিনাল এঙ্করগুলোর (নামমাত্র খুঁটি, যেমন মূল্যস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার) প্রতি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন (অটোনমি)। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সত্যিকারে স্বায়ত্তশাসিত (প্রকৃত অর্থে অটোনোমাস) না হয়, তাহলে সরকারের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ এবং প্রাইভেট সেক্টরগুলোর অযৌক্তিক কার্যকলাপের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি ও কাজ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অভিমত এবং অগ্রাধিকার প্রতিফলিত হয় কি না, সেটাও দেখতে হবে; নতুবা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে না। সে জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দক্ষতা, নিষ্ঠা ও নিষ্ঠা অর্জন একান্ত প্রয়োজন।
৭. উদীয়মান দেশগুলোর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন পদক্ষেপ
ক. বাংলাদেশসহ উদীয়মান (উন্নয়নশীল) দেশগুলোকে গতানুগতিক ধারার বাইরে মুদ্রানীতিকে নিয়ে যেতে হবে নিম্নলিখিত কারণে :
১. এ দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা সীমিত।
২. উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এই দেশগুলোর পণ্য ও সেবাবাজার আন্তর্জাতিক বাজার দ্বারা বেশি প্রভাবিত।
৩. এই দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সরবরাহ ও চাহিদার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিশৃঙ্খলা-অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। ৪. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু নীতির বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অভাব দেশকে আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
৫. আইনশৃঙ্খলার দুর্বল পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের সম্পদের অধিকার খর্ব, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি দুর্নীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে।
খ. মুদ্রানীতি দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন সফলতায় অবদান রাখতে পারে
১. দরিদ্রবান্ধব সরকারি নীতিকে সমর্থন করে।
২. অতি মাত্রায় দ্রুত মূল্যস্ফীতির ওঠা ও নামাকে এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। ৩. ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও টাকার বিনিময় হার স্থির রাখতে সহায়তার মাধ্যমে।
৪. অগ্রাধিকার দেওয়া উৎপাদনশীল খাতগুলোর জন্য ঋণ ও পুঁজি সংস্থানের মাধ্যমে। ৫. ব্যাংক, নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্রদের এবং নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বহির্ভূতদের আর্থিক সেবা, ঋণ ও পুঁজি সংস্থানের মাধ্যমে। ৬. করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি: সামাজিক খাত, পরিবেশ সংরক্ষণ, অনগ্রসর অঞ্চলের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ, পুঁজি ও আর্থ-সামাজিক সেবা প্রদান করার মাধ্যমে।
সুতরাং বাংলাদেশের মতো দেশের উচিত, প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে মুদ্রানীতি গ্রহণ করা এবং বহুমাত্রিক সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশের জন্য প্রচলিত ধারণার বাইরে দরিদ্রবান্ধব মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ শুধু সম্পদের অভাব বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবই নয়; বরং বিশেষ করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই হবে প্রধান অন্তরায়।
৮. সরকারের আয় ও ব্যয়-সংক্রান্ত নীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে নিবিড় সংযোগ আছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকাররা, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের বেন বারনানকে এবং কানাডার মার্ক কার্নি তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন, কী করে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি, শুধু এ দুটি বিষয়ের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারা যায়।
যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রয়াস ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততা থাকে তবে বাংলাদেশে কার্যকর ও যথাযথ নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
No comments