দেউলিয়া মাস্টারমশাই by ফসিহ বণিক
দেউলিয়া মাস্টারমশাই যদি ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা দেশ গড়ার ছবক দেন তখন কেমন লাগে! আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা হয়েছে দেউলিয়া মাস্টারমশাইয়ের ক্লাসের কাঁচুমাচু করা ছাত্রের মতো। তবে যারা এসব মাস্টারের কথায় কম কান দেন তাদের কথা আলাদা।
দেখুন না (!) আইএমএফ আমাদের সরকারকে ছবক দিল যে, ঋণের অর্থ পেতে হলে জ্বালানির ওপর থেকে ভর্তুকি কমাতে হবে। তাদের উপদেশ অবনত মস্তকে শিরোধার্য করে নিরন্তর বেফাঁস উক্তি করার জন্য খ্যাত অর্থমন্ত্রী তাদের প্রস্তাবেই মাথা কাত করলেন। জ্বালানির দাম বাড়ালে যে যাতায়াত ভাড়াসহ পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বাসাভাড়া বেড়ে যাওয়া তথা জীবনযাত্রার আরেক দফা ব্যয় বৃদ্ধি ঘটবে আর সে বাড়তি ব্যয় মেটানোর অর্থ মানুষ কীভাবে পাবে, সেসব দরকারি বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা সরকার ভেবেছেন কি? নির্বাচনী বছরে আরেক দফা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লে তার পরিণাম ফল যে ক্ষমতাসীনদেরই ভুগতে হবে সে হিসাবটি সম্ভবত আমাদের অর্থমন্ত্রীর না করলেও চলে। কিন্তু যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগেরও হাল ধরে আছেন তাকে তো অন্তত এ নিয়ে ভাবা উচিত। এভাবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে চলার কোনো যুক্তি হয় না এখন। বিশেষত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শ যে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্দ ফল প্রসব করেছে, সেটা তো অনেক অর্থনীতিবিদই স্বীকার করেন। যে নিউলিবারেল নীতির ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের নীতি-কৌশল উন্নয়নশীল বিশ্বকে গেলায়_ সেটি দাতাদেশ বা উন্নত দেশগুলোর কী হাল করেছে তা কি আমরা দেখছি না? তাদের এই নিউলিবারেল নীতির কারণে বিশ্বে বড়লোকদের সম্পদ বাড়ছে আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্রের সম্পদও কমে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী একশ' জনের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ১.৯ ট্রিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা দুটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিরাষ্ট্রীয়করণের যে নীতি উন্নয়নশীল দুনিয়ার দেশগুলোকে মানতে বাধ্য করে, তার পরিণতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি বৃদ্ধি পায় বেকারত্ব। এতে এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। উন্নত দেশগুলোতেও নিউলিবারেল নীতি প্রয়োগের একই ফল আমরা ভিন্নরূপে দেখতে পাচ্ছি। রিগ্যানের আমল থেকে পর্যায়ক্রমে বড়লোকদের ওপর কর হার কমানো ও বুশের আমলে কর অবকাশ দেওয়া এবং ব্যবসার লাভের ক্ষেত্রে বিধিবিধানগুলো হয় ঢিলেঢালা করা অথবা একেবারে তুলে দেওয়ার পরিণতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন দীর্ঘকালের জন্য আইসিওতে প্রবেশ করেছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে তো প্রতিদিনই উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ এই ভ্রান্ত তত্ত্ব দিয়ে ফ্রেডেরিখ হায়েক ও মিল্টন ফ্রিডম্যানরা অথনৈতিক তত্ত্ব জগতে দুই দশকের বেশি সময় ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ওই তত্ত্বের উদ্গাতা এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় পদে থাকা তাদের অনুসারীরা নিউলিবারেল নীতি কার্যকর করলে বিনিয়োগ, আয়, কর্মসংস্থান শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পাবে বলে যুক্তি দিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের ওই বস্তাপচা বা কর্তাভজা অথবা আরও স্পষ্টভাবে বললে বড়লোকদের পায়রোবি করা নীতি-কৌশল সামগ্রিকভাবে মানুষের আয় কমিয়েছে, বেকারত্বের সংখ্যা রকেটের গতিতে বৃদ্ধি করেছে, উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হ্রাস করেছে। এর পরিণতিতে বিশ্ব ২০০৮ সাল থেকে মন্দায় হাবুডুবু খাচ্ছে। ইমারজিং কান্ট্রি ছাড়াও আমরাসহ কয়েকটি দেশ এতদিন ওদের পরামর্শ পুরোপুরি মেনে নেইনি বলে বা মানতে হয়নি বলে উন্নতি করতে পেরেছি এই মন্দার মধ্যেও। কিন্তু এখন আইএমএফ আবার আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হওয়ায় দেশ অস্থিতিশীলতার পাকে পড়ে ফের অনুন্নয়নের ধারায় পিছলে যায় কি-না সেটা নিয়েই যত শঙ্কা। এসব দেউলিয়া মাস্টারদের পরামর্শ যত কম শোনা যায় ততই মঙ্গল। নচেৎ ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের আঙুল কামড়াতে হতে পারে।
No comments