ভালো ফল মানেই কি মানসম্মত শিক্ষা? by আশরাফুল আযম খান
গত কয়েক বছরে দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পাসের হার, সর্বোচ্চ জিপিএ অর্থাৎ জিপিএ ৫ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।
একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারে না এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমছে। ফলাফল প্রকাশে আগের মতো দীর্ঘসূত্রতাও এখন নেই। আগে যেখানে কয়েক মাস সময় লেগে যেত সেখানে পরীক্ষা হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হচ্ছে। ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইলে বা অনলাইনে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা পাস-ফেলের খবর জানতে পারছেন। শুধু ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নয়; শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তিও অনলাইনে করা হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের ডিজিটাল কর্মসূচির কিছুটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের ইতিবাচক প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। পাসের হার এবং জিপিএ বৃদ্ধির এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। গত বছর মে মাসে প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলেও আমরা এ ধরনের ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করি। এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হারও গতবার আগের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি ছিল। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের পক্ষ থেকে ফলাফলে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীরা এ রকম ফল লাভে সক্ষম হচ্ছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি প্রগতিমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার্থীদের অতীতের নকলপ্রবণতা রোধে এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে পরীক্ষা এবং প্রশ্ন পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরীক্ষা ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণীতে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। এ কাজে সাফল্য আনতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার বিষয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দময় ও আকর্ষণীয় করতে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি এবং মাল্টিমিডিয়া কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল সিস্টেমে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিরও উন্নতি করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যেন কোচিংমুখী না হয়ে শ্রেণীকক্ষে প্রত্যাশিত শিক্ষা লাভ করতে পারে, সে লক্ষ্যে কোচিংবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান এবং শিক্ষা প্রদানে আরো বেশি নিবিষ্ট করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। ফলে পাসের হারসহ জিপিএর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বলে সরকার মহল মনে করে। তবে অনেকে সরকারের এ বক্তব্যে পরিতৃপ্ত হতে পারছে না। তারা মনে করছে, পাসের হার এবং জিপিএ বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান বাড়েনি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর পাসের তালিকা দীর্ঘ করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছে না। ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন পদ্ধতি, উত্তরপত্র মূল্যায়নে অবহেলা, শিক্ষার মানের চেয়ে পরিমাণগত দিকে সরকারের অধিক আগ্রহ ইত্যাদির কারণে শিক্ষার মান বা উৎকর্ষ প্রত্যাশিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
পাসের হার বৃদ্ধি ভালো ফলের সূচক হলেও তা শিক্ষার মানোন্নয়নের সমার্থক না-ও হতে পারে। এ কথার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায়, সর্বোচ্চ গ্রেড পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরবর্তী শ্রেণীতে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারছে না। উচ্চশিক্ষার স্তরে ভর্তির জন্য নিজের ন্যূনতম যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাস করা বিদ্যা আর প্রকৃত বিদ্যা এক কথা নয়। বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নকাঠামো বা মান বণ্টন পদ্ধতি যেমন তাতে পাসের জন্য প্রয়োজনীয় শতকরা ৩৩ নম্বর পাওয়া যেকোনো পরীক্ষার্থীর জন্য কঠিন নয়। লিখিত অংশের পাশাপাশি প্রায় সব বিষয়ে ৩৫ থেকে ৫০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি প্রচলিত থাকায় এ পর্যায়ে যে কেউ না পড়েই পরীক্ষা হলের ত্রুটিপূর্ণ আসন বিন্যাস এবং পর্যবেক্ষণের সামান্য শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে একজনেরটা দেখে আরেকজন লিখতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে নকল করার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী তার মেধা, অভিজ্ঞতা ও সৃজনপ্রতিভা কাজে লাগাতে পারলে ভালো ফল অর্জন করতে পারবে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে মেধাহীন শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই ভালো করা সম্ভব নয়। তার পরও কম মেধাবীরা কী উপায়ে ভালো ফল করতে পারছে? তা খতিয়ে দেখা দরকার।
আমাদের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভালো ফল লাভ করলেও এ পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত অধিকাংশ প্রান্তিক দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণী পাস করেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মতো সাধারণ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না। দুটি বাক্যে নিজের কথা গুছিয়ে লিখতে পারে না। উচ্চশ্রেণীতে ভর্তি হলেও শিক্ষার বিষয়গুলো সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারে না। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই বুয়েট, মেডিক্যাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ন্যূনতম পাস নম্বর অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ভর্তি হলেও পরবর্তী উচ্চ শিক্ষা স্তরে গিয়ে অনেকে ইংরেজি ভাষা বা বুনিয়াদী শিক্ষা ভালো না হওয়ায় অকৃতকার্য হয় অথবা কোনো রকমে তৃতীয় শ্রেণী নিয়ে পাস করে। একটি দেশের শিক্ষার মান যাচাইয়ের প্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো সে দেশের ঘোষিত শিক্ষার সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হলো তা নিরুপণ করা। প্রায় প্রতিটি দেশের শিক্ষা পরিকল্পনা বা শিক্ষানীতিতে এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষিত থাকে। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন হলো এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিমাপ বা যাচাই করার কার্যকর পদ্ধতি বা উপায়। বাংলাদেশের পরীক্ষা পদ্ধতি তা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এখনো নানা ত্রুটি বিদ্যমান। বর্তমানে প্রবর্তিত সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে যথাযথভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না বলে অনেকের বিশ্বাস।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
পাসের হার বৃদ্ধি ভালো ফলের সূচক হলেও তা শিক্ষার মানোন্নয়নের সমার্থক না-ও হতে পারে। এ কথার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায়, সর্বোচ্চ গ্রেড পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই পরবর্তী শ্রেণীতে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারছে না। উচ্চশিক্ষার স্তরে ভর্তির জন্য নিজের ন্যূনতম যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাস করা বিদ্যা আর প্রকৃত বিদ্যা এক কথা নয়। বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নকাঠামো বা মান বণ্টন পদ্ধতি যেমন তাতে পাসের জন্য প্রয়োজনীয় শতকরা ৩৩ নম্বর পাওয়া যেকোনো পরীক্ষার্থীর জন্য কঠিন নয়। লিখিত অংশের পাশাপাশি প্রায় সব বিষয়ে ৩৫ থেকে ৫০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পদ্ধতি প্রচলিত থাকায় এ পর্যায়ে যে কেউ না পড়েই পরীক্ষা হলের ত্রুটিপূর্ণ আসন বিন্যাস এবং পর্যবেক্ষণের সামান্য শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে একজনেরটা দেখে আরেকজন লিখতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে নকল করার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী তার মেধা, অভিজ্ঞতা ও সৃজনপ্রতিভা কাজে লাগাতে পারলে ভালো ফল অর্জন করতে পারবে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে মেধাহীন শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই ভালো করা সম্ভব নয়। তার পরও কম মেধাবীরা কী উপায়ে ভালো ফল করতে পারছে? তা খতিয়ে দেখা দরকার।
আমাদের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভালো ফল লাভ করলেও এ পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত অধিকাংশ প্রান্তিক দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণী পাস করেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মতো সাধারণ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না। দুটি বাক্যে নিজের কথা গুছিয়ে লিখতে পারে না। উচ্চশ্রেণীতে ভর্তি হলেও শিক্ষার বিষয়গুলো সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারে না। জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই বুয়েট, মেডিক্যাল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ন্যূনতম পাস নম্বর অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ভর্তি হলেও পরবর্তী উচ্চ শিক্ষা স্তরে গিয়ে অনেকে ইংরেজি ভাষা বা বুনিয়াদী শিক্ষা ভালো না হওয়ায় অকৃতকার্য হয় অথবা কোনো রকমে তৃতীয় শ্রেণী নিয়ে পাস করে। একটি দেশের শিক্ষার মান যাচাইয়ের প্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো সে দেশের ঘোষিত শিক্ষার সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হলো তা নিরুপণ করা। প্রায় প্রতিটি দেশের শিক্ষা পরিকল্পনা বা শিক্ষানীতিতে এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষিত থাকে। পরীক্ষা বা মূল্যায়ন হলো এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিমাপ বা যাচাই করার কার্যকর পদ্ধতি বা উপায়। বাংলাদেশের পরীক্ষা পদ্ধতি তা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এখনো নানা ত্রুটি বিদ্যমান। বর্তমানে প্রবর্তিত সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে যথাযথভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না বলে অনেকের বিশ্বাস।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
No comments