মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-কলঙ্ক মোচনের রায় আজ-বাচ্চু রাজাকার দিয়ে শুরু
জাতির 'দুর্দিনে যারা শত্রুদের হাতে হাত রেখে খেলেছে করোটি নিয়ে ভুতুড়ে জ্যোৎস্নায়' সেই নরঘাতকদের বিচার দেখার প্রতীক্ষা চার দশকের। নানা অনিশ্চয়তা, হতাশা আর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান পর্ব শুরু হচ্ছে। সেই সঙ্গে শুরু হচ্ছে জাতির কলঙ্ক মোচন শুরুর পর্বও।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রথম রায় ঘোষণা হচ্ছে আজ সোমবার। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিচারের এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে; যদিও শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হতে আরো কিছু সময় লাগবে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ গতকাল রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রায়ের তারিখ জানিয়ে দেন।
ট্রাইব্যুনাল গত ২৬ ডিসেম্বর এক আদেশে যেকোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় রেজিস্ট্রার রায়ের তারিখ সাংবাদিকদের জানান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধে কারো বিচারের এটিই হবে প্রথম রায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদিও দালাল আইনে কিছু লোকের বিচার হয়েছিল; কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ওই আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও কারাবন্দি দালালদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
শহীদ পরিবারসহ গোটা জাতির দীর্ঘদিনের দাবি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। প্রায় ২০ বছর আগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'যুদ্ধাপরাধীদের' বিচারের দাবিতে গঠিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দুর্বার নাগরিক আন্দোলন শুরু হয় তখন। জাহানারা ইমাম, কবি সুফিয়া কামালের মতো নেতৃস্থানীয় অনেকেই আজ নেই। তবে তাঁদের আন্দোলনের বিজয় আজ ঘোষিত হচ্ছে এ রায়ের মধ্য দিয়ে।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্রসংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গড়ে ওঠে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে 'গণ-আদালত'-এ একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় দালাল ও ঘাতক-সহযোগী বাহিনীর প্রধান সংগঠক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের আয়োজন করে। গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর স্থানীয় সহযোগীদের বিচার হয়েছিল দালাল আইনে। শত বছর আগে প্রণীত সাক্ষ্য আইনে এসব বিচার সম্পন্ন হওয়ায় অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বিচারের এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে প্রণয়ন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন। সেই আইনেই এখন বিচার হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম। এর আগে ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ বৈঠকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ও কৌঁসুলি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমসহ ১৪ জনের বিচার চলছে। আরো ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সর্বপ্রথম রায়ের পর্যায়ে যায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। কিন্তু কথিত স্কাইপ সংলাপ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ফলে ওই রায় পিছিয়ে যায়। বর্তমানে সাঈদীর মামলার যুক্তিতর্ক আবার চলছে। শুনানি শেষ হলে যেকোনো দিন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হবে। এরপর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এ মামলার রায় ঘোষণা যেকোনো দিন হবে বলে ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে চলতি বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বাচ্চু রাজাকারের মামলাটি দিয়েই শুরু হয় দুই নম্বর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম।
গত ২৬ ডিসেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে করা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ওই দিন ট্রাইব্যুনাল রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখে আদেশ দেন।
গত বছর ৩ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর থেকে তিনি পলাতক। গত বছর ২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থা বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়। গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারের অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ওই সময় তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই করতে সরকারের খরচে মো. আবদুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছর ৪ নভেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আটটি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
বাচ্চু রাজাকার কোথায় : এ মামলায় বাচ্চু রাজাকার পলাতক। তদন্ত শুরু হওয়ার পর তাঁকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে হঠাৎ জানানো হয়, বাচ্চু রাজাকার পালিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা জারির পর ওই দিন দুপুরে রাজধানীর উত্তরখানের বাসায় তল্লাশি চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার সুনন্দা রায় পরে সাংবাদিকদের তাঁর (বাচ্চু রাজাকার) পালিয়ে যাওয়ার কথা জানান।
জানা গেছে, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি উত্তরখানের ওই বাসায় থাকতেন। পরোয়ানা জারির পর তাঁর বাসা থেকে সামানিয়া জান্নাতি সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাবা নিয়মিত বাসাতেই থাকতেন। ওই দিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর আর ফেরেননি।
এর কয়েক দিন পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) দাবি করে বাচ্চু রাজাকার দিনাজপুরের হিলি বন্দর হয়ে ভারতে চলে গেছেন। বাচ্চু রাজাকারের ছেলে ও শ্যালক তাঁকে পালাতে সহযোগিতা করেছেন বলেও র্যাব জানায়। পরে ছেলে, শ্যালক ও হিলির একজন হোটেল মালিককেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, বাচ্চু রাজাকার কোথায় আছেন। বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন এ ধরনের খবর প্রকাশ হলেও বিদেশে তাঁকে কেউ এ পর্যন্ত দেখেছেন এমন কোনো তথ্য নেই।
কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রায় উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি-রমনা জোন) নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ট্রাইব্যুনাল কম্পাউন্ড, আশপাশের ভবন, হাইকোর্ট মাজার এলাকা, সুপ্রিম কোর্ট এলাকা এবং বাইরে সবখানেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কম্পাউন্ডে অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাঁরা ঢুকবেন তাঁদের গাড়ি পরীক্ষা করা হবে। প্রয়োজনে শরীরও তল্লাশি করা হবে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আজ ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ গতকাল রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রায়ের তারিখ জানিয়ে দেন।
ট্রাইব্যুনাল গত ২৬ ডিসেম্বর এক আদেশে যেকোনো দিন রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় রেজিস্ট্রার রায়ের তারিখ সাংবাদিকদের জানান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধে কারো বিচারের এটিই হবে প্রথম রায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদিও দালাল আইনে কিছু লোকের বিচার হয়েছিল; কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ওই আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও কারাবন্দি দালালদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
শহীদ পরিবারসহ গোটা জাতির দীর্ঘদিনের দাবি একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। প্রায় ২০ বছর আগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'যুদ্ধাপরাধীদের' বিচারের দাবিতে গঠিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দুর্বার নাগরিক আন্দোলন শুরু হয় তখন। জাহানারা ইমাম, কবি সুফিয়া কামালের মতো নেতৃস্থানীয় অনেকেই আজ নেই। তবে তাঁদের আন্দোলনের বিজয় আজ ঘোষিত হচ্ছে এ রায়ের মধ্য দিয়ে।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্রসংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গড়ে ওঠে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে 'গণ-আদালত'-এ একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় দালাল ও ঘাতক-সহযোগী বাহিনীর প্রধান সংগঠক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের আয়োজন করে। গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর স্থানীয় সহযোগীদের বিচার হয়েছিল দালাল আইনে। শত বছর আগে প্রণীত সাক্ষ্য আইনে এসব বিচার সম্পন্ন হওয়ায় অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বিচারের এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে প্রণয়ন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন। সেই আইনেই এখন বিচার হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার কার্যক্রম। এর আগে ২০০৯ সালের ৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ বৈঠকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ও কৌঁসুলি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমসহ ১৪ জনের বিচার চলছে। আরো ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। সর্বপ্রথম রায়ের পর্যায়ে যায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। কিন্তু কথিত স্কাইপ সংলাপ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ফলে ওই রায় পিছিয়ে যায়। বর্তমানে সাঈদীর মামলার যুক্তিতর্ক আবার চলছে। শুনানি শেষ হলে যেকোনো দিন রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হবে। এরপর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এ মামলার রায় ঘোষণা যেকোনো দিন হবে বলে ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে চলতি বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বাচ্চু রাজাকারের মামলাটি দিয়েই শুরু হয় দুই নম্বর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম।
গত ২৬ ডিসেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে করা মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ওই দিন ট্রাইব্যুনাল রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখে আদেশ দেন।
গত বছর ৩ এপ্রিল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর থেকে তিনি পলাতক। গত বছর ২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থা বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়। গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারের অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ওই সময় তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই করতে সরকারের খরচে মো. আবদুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছর ৪ নভেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আটটি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
বাচ্চু রাজাকার কোথায় : এ মামলায় বাচ্চু রাজাকার পলাতক। তদন্ত শুরু হওয়ার পর তাঁকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে হঠাৎ জানানো হয়, বাচ্চু রাজাকার পালিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা জারির পর ওই দিন দুপুরে রাজধানীর উত্তরখানের বাসায় তল্লাশি চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার সুনন্দা রায় পরে সাংবাদিকদের তাঁর (বাচ্চু রাজাকার) পালিয়ে যাওয়ার কথা জানান।
জানা গেছে, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি উত্তরখানের ওই বাসায় থাকতেন। পরোয়ানা জারির পর তাঁর বাসা থেকে সামানিয়া জান্নাতি সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাবা নিয়মিত বাসাতেই থাকতেন। ওই দিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর আর ফেরেননি।
এর কয়েক দিন পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) দাবি করে বাচ্চু রাজাকার দিনাজপুরের হিলি বন্দর হয়ে ভারতে চলে গেছেন। বাচ্চু রাজাকারের ছেলে ও শ্যালক তাঁকে পালাতে সহযোগিতা করেছেন বলেও র্যাব জানায়। পরে ছেলে, শ্যালক ও হিলির একজন হোটেল মালিককেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, বাচ্চু রাজাকার কোথায় আছেন। বাচ্চু রাজাকার পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন এ ধরনের খবর প্রকাশ হলেও বিদেশে তাঁকে কেউ এ পর্যন্ত দেখেছেন এমন কোনো তথ্য নেই।
কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রায় উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি-রমনা জোন) নুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ট্রাইব্যুনাল কম্পাউন্ড, আশপাশের ভবন, হাইকোর্ট মাজার এলাকা, সুপ্রিম কোর্ট এলাকা এবং বাইরে সবখানেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কম্পাউন্ডে অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় গাড়ি নিয়ে যাঁরা ঢুকবেন তাঁদের গাড়ি পরীক্ষা করা হবে। প্রয়োজনে শরীরও তল্লাশি করা হবে।
No comments