আশেক আলী খান- স্মরণ by নীলুফার বেগম
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা ক্ষণজন্মা, ত্যাগী ও ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁরা নিজের সুখ ও আরাম-আয়েশের চেয়ে পরের উপকার বিশেষ করে নিজ এলাকাবাসীর জন্য কল্যাণকর কাজ করতে পছন্দ করেন ও ভালবাসেন। তেমন একজন মানুষ ছিলেন মরহুম আশেক আলী খান, চাঁদপুর জেলার প্রথম মুসলমান গ্র্যাজুয়েট (বাংলা একাডেমী,
চরিতাভিধান, পৃঃ সংখ্যা-৭৬) তাঁর জন্ম হয় ১৮৯১ সালে চাঁদপুর জেলার গুলবাহার গ্রামে। তাঁর পিতা আইনউদ্দিন খান ও মাতার নাম আলেক জান বিবি ওরফে টুনি বিবি। তিনি ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত চাঁদপুর বাবুরহাট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। উল্লেখ্য, ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রচলন হয় ব্রিটিশ ভারতে। ঐ স্কুলে পড়াকালীন তাঁর ক্লাসে তিনিই একমাত্র মুসলমান ছাত্র ছিলেন এবং ক্লাসে সবার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন । এরপর ঢাকা কলেজে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে অনার্স কোর্স শেষ করতে পারেননি। পড়ায় বিরতি দিয়ে পর পর দুটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে কলকাতায় সিটি কলেজে বিএ ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএ পাস করেন। বিএ পরীক্ষার ফল পত্র পত্রিকায় বের হবার পর তিনি ৫০টি খাম ও পোস্ট কার্ডে লেখা চিঠি পেয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ, দেরাগাজীখান, পাঞ্জাব, চন্দনপুর, অসম, পাবনা ইত্যাদি বিভিন্ন মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের থেকে।
বিএ পাস হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পাওয়া লোভনীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি শিক্ষকতাকে বেছে নিলেন পেশা হিসেবে। বিটি পড়ে ফার্স্ট ক্লাস পেলেন ১৯১৯ সালে। প্রথমে চাঁদপুর গনি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। এই স্কুলের সরকারী মঞ্জুরি তিনি করিয়েছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। তখনকার দিনে স্কুলের সরকারী মঞ্জুরি পাওয়াটা ছিল কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। তিনি এই দুরূহ কাজটি সমাধা করে ঐ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে আরও সুপরিচিত হলেন। সেই সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ধীশক্তি প্রমাণ করলেন। এরপরে সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুল হিসেবে বৃহৎ বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ও সাধারণ লোকের আর্থ-সামাজিক করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখলেন। পরে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকতা করেন ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল জেলা স্কুলে ও সর্বশেষ ঝালকাঠির সরকারী স্কুলে। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দূরবস্থার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে পরিচিত হলেন। এই অবস্থা তাঁর মনে দাগ কাটল ভীষণভাবে। সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করাকালীন নিম্ন বর্ণ হিন্দু ও অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ একাধিকবার নিয়েছিলেন। সেজন্য তৎকালীন সংশ্লিষ্ট উন্নাসিক উর্ধতন কর্মকর্তার শ্যান দৃষ্টিতে পড়ে তাঁর পদোন্নতি বন্ধ ছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
আশেক আলী খান অমায়িক, বিনয়ী, ধীরস্থির ও ধৈর্যশীল লোক ছিলেন। জীবনাচরণে ও কথাবার্তার সর্বক্ষেত্রে তাঁর সরলতা লক্ষণীয় ছিল। সন্তান ও নাতি-নাতনির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল সহজ ও মধুর। সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ন্যায়পরায়নতা, সত্যবাদিতা ও দৃঢ়সংকল্প তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর চরিত্রে কোন রকমের দ্বিধা ও জড়তা ছিল না। এলাকার জনগণের মঙ্গলের জন্য যা ভাবতেন, যা বিশ্বাস করতেন তা কথায় ও কাজে প্রকাশ করতেন আবার তা বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে যেতেন। কোন বাঁধাই মানতেন না। একজন ধর্মপরায়ণ ও পরহেজগার লোক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাসেবী, গ্রামপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক ও মানব দরদী আশেক আলী খান ১৯৭৪ সালে ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : আশেক আলী খানের মেয়ে, সাবেক যুগ্ম সচিব
বিএ পাস হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পাওয়া লোভনীয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি শিক্ষকতাকে বেছে নিলেন পেশা হিসেবে। বিটি পড়ে ফার্স্ট ক্লাস পেলেন ১৯১৯ সালে। প্রথমে চাঁদপুর গনি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। এই স্কুলের সরকারী মঞ্জুরি তিনি করিয়েছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। তখনকার দিনে স্কুলের সরকারী মঞ্জুরি পাওয়াটা ছিল কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। তিনি এই দুরূহ কাজটি সমাধা করে ঐ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে আরও সুপরিচিত হলেন। সেই সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ধীশক্তি প্রমাণ করলেন। এরপরে সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুল হিসেবে বৃহৎ বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ও সাধারণ লোকের আর্থ-সামাজিক করুণ অবস্থা স্বচক্ষে দেখলেন। পরে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকতা করেন ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল জেলা স্কুলে ও সর্বশেষ ঝালকাঠির সরকারী স্কুলে। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দূরবস্থার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে পরিচিত হলেন। এই অবস্থা তাঁর মনে দাগ কাটল ভীষণভাবে। সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করাকালীন নিম্ন বর্ণ হিন্দু ও অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ একাধিকবার নিয়েছিলেন। সেজন্য তৎকালীন সংশ্লিষ্ট উন্নাসিক উর্ধতন কর্মকর্তার শ্যান দৃষ্টিতে পড়ে তাঁর পদোন্নতি বন্ধ ছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
আশেক আলী খান অমায়িক, বিনয়ী, ধীরস্থির ও ধৈর্যশীল লোক ছিলেন। জীবনাচরণে ও কথাবার্তার সর্বক্ষেত্রে তাঁর সরলতা লক্ষণীয় ছিল। সন্তান ও নাতি-নাতনির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল সহজ ও মধুর। সৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ন্যায়পরায়নতা, সত্যবাদিতা ও দৃঢ়সংকল্প তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর চরিত্রে কোন রকমের দ্বিধা ও জড়তা ছিল না। এলাকার জনগণের মঙ্গলের জন্য যা ভাবতেন, যা বিশ্বাস করতেন তা কথায় ও কাজে প্রকাশ করতেন আবার তা বাস্তবায়ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে যেতেন। কোন বাঁধাই মানতেন না। একজন ধর্মপরায়ণ ও পরহেজগার লোক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাসেবী, গ্রামপ্রেমিক, সমাজ সংস্কারক ও মানব দরদী আশেক আলী খান ১৯৭৪ সালে ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : আশেক আলী খানের মেয়ে, সাবেক যুগ্ম সচিব
No comments