উজান গাঙের নাইয়া...বাঙালীর অনত্মবর্ীণায় সুরগাথা- রাজধানীতে লোকসঙ্গীত উৎসব by সৈয়দ সোহরাব

লোকসঙ্গীত বাঙালীর অনত্মবর্ীণায় সৃষ্ট এক অপরূপ সুরগাথা। সমাজচিত্রের এক সবাক প্রতিবিস্ব বলা যেতে পারে এ লোকজগানকে। যার মধ্যে খুজে পাওয়া যায় আঞ্চলিক আচারাদির পরিচয় পারিপাশ্বর্িকতার বর্ণনা ও সামাজিক ধ্যানধারণাসহ সহজ-সরল মানুষের মানসপটের বিবরণ।


যা আবহমানকাল ধরেই এই বাংলায় পরিবেশিত হয়ে আসছে। প্রকৃত সংরৰণের অভাবে এই সুরগাথা প্রচারিত হতে হতে এখন কিছুকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যা এখনও টিকে আছে, তা হারিয়ে যাওয়া সম্পদের তুলনায় বেশ সামান্যই। সেই হারিয়ে যাওয়া লোকপুনরম্নদ্ধার, সংগ্রহ, সংরৰণ, চর্চা, গবেষণা ও বিকাশের অঙ্গীকার নিয়ে দীর্ঘ ১২ বছর বা এক যুগ যাবত কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত পরিষদ। পরিষদের যুগপূর্তি এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়মিত মাসিক অনুষ্ঠানের ১০০ পর্বের পূর্তি উপলৰে মাসব্যাপী বিভাগীয় লোকসঙ্গীত উৎসব ২০১০-এর আয়োজন করেছে পরিষদ। মাসব্যাপী এ লোক উৎসবের দু'দিনব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো রাজধানী ঢাকায়। রবিবার ছিল উদ্বোধনী পর্বের সমাপনী দিন। উদ্বোধনী পর্বের দু'দিনই ৬টি বিভাগের লোকসঙ্গীত নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সমাপনী দিনে আরও আয়োজন ছিল উপমহাদেশের কালজয়ী শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের মৃতু্যবার্ষিকী ও পলস্নীকবি জসীম উদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলৰে তাঁদের গান নিয়ে লোকসঙ্গীতের আয়োজন এবং ঢাকার আঞ্চলিক (লোকগান) গানের মনোমুগ্ধকর বর্ণাঢ্য পরিবেশনা। ঢাকায় আঞ্চলিক গানের সমাপনী দিনের এই উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন আইন ও সংসদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন। উৎসবটি উদ্বোধন করেন দেশের চার গুণী ব্যক্তিত্ব। তাঁরা হলেন বরেণ্য মরমী গীতিকবি সাবির আহমেদ চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক সাংবাদিক কামাল লোহানী, বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান ও বিটিভির মহাপরিচালক কবি কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করেন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, স্বাগত বক্তৃতা দেন সাধারণ সম্পাদক নাসরিন ফেরদৌস চমন।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী পরিষদের কার্যক্রম ও উৎসব প্রসঙ্গে বলেন গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের এই গান আমাদের প্রাণের জিনিস। এক সময় এ গানের প্রসিদ্ধি ও কৌলিন্য ছিল, যা এখন হারাতে বসেছে। এক সময় শিল্পী আব্বাস উদ্দিন, শিল্পী আব্দুল আলীমের মতো খ্যাতিমান ও দরদী কণ্ঠের গায়কদের গানে মাতোয়ারা থাকত সারা বাংলা। কিন্তু একটা সময় কেউ কেউ যেনতেনভাবে গান লিখে লোকগান নামে গাইতে থাকল, ফলে আমাদের লোকসম্পদ নামে বিবেচিত লোকগানগুলো তার কৌলিন্য হারাতে থাকল। সেই কৌলিন্য রৰার জন্য এবং হারিয়ে যাওয়া গানগুলো উদ্ধারের জন্য আমরা কাজ করে চলেছি। আমাদের সংগঠনের শিল্পীদের প্রথমে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয় সেই নষ্ট গানগুলো (যেন তেনভাবে লেখা) কখনও গাইতে পারবে না।
লোকসঙ্গীতের পর্বে ঢাকার আঞ্চলিক গানের ৰেত্রে পরিষদের শিল্পীরা বেশ মজার মজার গান গেয়ে শোনান। ঢাকার আঞ্চলিকতা নিয়ে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর লেখা হাটে মাঠে ঘাটে বাটে... এবং রানধুনিরা রান্ধে বাড়ে খানেওয়ালায় খায়...গান দু'টি পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতাদের বেশ আনন্দ দেয়। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী গেয়ে শোনান পলস্নীকবি জসীম উদ্্দীনের লেখা ও সুজন বন্ধুরে আমার যাবার বেলায়..., তুমি কোনবা দেশে রইলারে চান..., সহ বেশ কয়েকটি গান। এ পর্বে আরও গান গেয়ে শোনান বিপুল ভট্টাচার্য, আবু বকর সিদ্দিক, মলয় কুমার গাঙ্গুলী দীপ্তি রাজবংশী।
ঢাকার আঞ্চলিক গানের পর্বের আগে কিংবদনত্মি শিল্পী আব্বাস উদ্দীন ও পলস্নীকবি জসীম উদ্্দীনের গান নিয়ে আয়োজন করা হয় লোকগানের উৎসব। এতে দেশের ৬টি বিভাগ থেকে আসা পরিষদের প্রতিভাবান শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন। আব্বাস উদ্দীনের গান গেয়ে শোনান মফিজুর রহমান বিরহী, গিয়াস উদ্দীন রাজু, মারিয়া রহমান মুন্নী ও মেজবাহ উদ্দিন। তাদের পরিবেশিত গানগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো গুরম্নপদে প্রেম ভক্তি হলো না... থাকতে পাড় ঘাটাতে তুমি পাড়ের নাইয়া..., সে যেন কি করল আমায় কি জানি কি দিয়া..., ঢেউ খেলেরে ঝিলঝিল সায়রে ঢেউ খেলেরে..., নদীর কূল নাই কিনার নাইরে... প্রভৃতি গান। শিল্পী শেখ হেমায়েত ও মাহতাব উদ্দিন মাসুম শ্রোতাদের শোনান কবি জসীম উদ্্দীনের উজান গাঙ্গের নাইয়া... এবং যারে ছেড়ে এলামরে...গান দু'টি।
লোক উৎসবের এই আয়োজনে বিচিত্র পর্ব নামে গানের পর্বে বিভিন্ন মরমী কবির গান গেয়ে শোনান পরিষদের শিল্পীরা। এ পর্বে মুন্সী পরিবেশন করেন আমার মন মজেরে দিল মজেরে গানটি। একে আজাদ শোনান দিন গেলে আর দিন হবে না...। মানুষে মানুষ বিরাজ করে খুঁজে নেয়া দায়... গানটি গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন শিশির অধিকারী। সনত্মোষ কুমার দাস গেয়ে শোনান আমার ঘুম আসে না একা ঘরে শুইলে...। তৌহিদ সরকারের কণ্ঠে গীত হয়ে বেজে ওঠে ভালবেসে সবশেষে পাগল করলি মোরে.. গানটি। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর লেখা শোন বলি রাঙ্গা দাদার বউয়ের গুণ... গানটি গেয়ে হল ভর্তি শ্রোতাদের করতালি ও ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন শিল্পী লুৎফর নাহার মনিরা। এভাবেই অনেক জনপ্রিয় লোকগানের নানা পরিবেশনায় উৎসব চলে শেষ রাত অবধি। উলেস্নখ্য, লোকসঙ্গীতের এ উৎসব পর্যায়ক্রমে দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরে হবে।

No comments

Powered by Blogger.