পুলিশ বন্ধু না হোক, শত্রু যেন না হয় by প্রভাষ আমিন
তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, সময় বিকেল সাড়ে ৫টা, ঘটনাস্থল কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়। ধানমণ্ডির দিক থেকে মৌচাকের অফিসে ফিরছিলেন দেশ টিভির যুগ্ম বার্তা সম্পাদক গিয়াস আহমেদ। কিন্তু বসুন্ধরা সিটির সামনে এসেই আটকে যান তিনি, সিগন্যালে অপেক্ষায় বসে থাকেন।
কিন্তু সেই অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরোয় না। ঘটনা কী? না তেমন কিছু নয়, বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশে আসা পাকিস্তান দলকে নির্বিঘ্নে যেতে দেওয়ার জন্য রাস্তা আটকে রাখা হয়েছে। বিদেশি অতিথিদের আমরা সম্মান দেব, তাঁদের চলাচলের পথ নির্বিঘ্ন করব_সব ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে হাজার হাজার মানুষকে 'অনন্তকাল' ধরে বসিয়ে রাখার তো কোনো মানে হয় না। সোয়া ঘণ্টা পর সিগন্যাল যখন ছাড়া হয়, তখন যাওয়ার সময় গিয়াস আহমেদ গাড়ির কাচ নামিয়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে বললেন, ভাই, আমরাও তো মানুষ নাকি। এতেই আঁতে ঘা লাগে ট্রাফিকের। সে গিয়াস আহমেদকে হাত দিয়ে চড় দেখায়, লাঠি দেখায়, তুই-তুকারি এবং গালাগাল করতে থাকে। এটা মানতে পারেননি গিয়াস। তিনি গাড়ি থামিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে এ আচরণের কারণ জানতে চাইলেই তেড়ে আসে ট্রাফিক কনস্টেবল মোশাররফ। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক রিফ্লেঙ্ েহাত বাড়িয়ে দেন গিয়াস। তাতেই আরো খেপে যায় ট্রাফিক কনস্টেবল। তার ডাকে ছুটে আসে সার্জেন্ট আশরাফুল, সার্জেন্ট আসাদ, এসআই জাহাঙ্গীর আলম এবং সাদা পোশাকের পুলিশের দুই সোর্স। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এই ছয়জন মিলে গিয়াস আহমেদকে রাস্তায় ফেলে অমানবিকভাবে পিটিয়েছে। তারা গিয়াসের চশমা ভেঙে ফেলে। গিয়াস তাঁর অফিসে বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এক বন্ধুকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসআই জাহাঙ্গীর আলম তাঁর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেয়। তারা তাঁকে টানতে টানতে পুলিশ বঙ্ েনিয়ে অমানবিকভাবে পেটায়। গিয়াস বারবার তাঁর পরিচয় দিয়েছেন, পরিচয়পত্র দেখে পুলিশ দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁকে পিটিয়েছে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছে, সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না, জীবনে অনেক সাংবাদিক পিটিয়েছি। মনের সুখ মিটিয়ে পেটানোর পর পুলিশ সদস্যরা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে প্রথম আলো অফিসের কাছে রাখা তাদের ভ্যানে নিয়ে যায়। গিয়াস আহমেদ দীর্ঘদিন প্রথম আলোতেও কাজ করেছেন। বাঁচার আশায় তিনি চারপাশে দেখছিলেন, পরিচিত কাউকে দেখা যায় কি না। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কাউকেই পাননি তিনি। ভ্যানে তোলার পর পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রের খোঁজে গিয়াসের শরীরে তল্লাশি চালায়। আর হুমকি দেয়, অস্ত্র মামলায় দিয়ে তাঁকে অন্তত ৪৪ বছর জেল খাটাবেন। কেউ বলছিল, হ্যান্ডকাফ লাগা; কেউ বলছিল, ডাণ্ডাবেড়ি লাগা। এভাবে অপমান করতে করতে তাঁকে তেজগাঁও থানায় নিয়ে যায়। যখন গিয়াসের জরুরি চিকিৎসা দরকার, তখনই তাঁকে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে চোর-ছেঁচড়দের সঙ্গে হাজতে ঢোকানো হয়। এই মাহবুবুর রহমান আসার পর থেকেই নাকি তেজগাঁও থানা এলাকা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। বাড়ি গোপালগঞ্জে বলে তিনি নাকি কাউকেই পাত্তা দেন না। থানায় পুলিশের সোর্স গিয়াসের কাছে টাকা-পয়সা দিয়ে আপস করার প্রস্তাব দেয়, নইলে জটিল মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। গিয়াসের ড্রাইভারের কাছ থেকে খবর পেয়ে তার বন্ধু, সহকর্মী, সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতারা থানায় ছুটে যান। ছুটে আসেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপর সুর বদলে যায় হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের। পুলিশ কিভাবে দিনকে রাত বানায়, তার একটা উদাহরণ দেখা গেল তখন। পুলিশ সদস্যরা দাবি করেন, তাঁরা গিয়াসকে পেটাননি, বরং জনগণ পেটাচ্ছিল, তাঁরা রক্ষা করেছেন। আরেকজন দাবি করেন, গিয়াস যে সাংবাদিক এটা তাঁরা জানতেন না, তাঁরা ভেবেছিলেন হকার। যেন হকারকে বিনা বিচারে পেটানো যায়! গিয়াসই প্রথম পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, এটা প্রমাণ করতে এক পুলিশ তাঁর ইউনিফর্মের দুটি বোতাম ছিঁড়ে আসেন। আরেকজন দাবি করেন, গিয়াস তাঁদের হত্যার হুমকি দিয়েছে। কী হাস্যকর সব পাল্টা অভিযোগ। শাবাশ, এই না হলে পুলিশ!
সাংবাদিকরা ধোয়া তুলসীপাতা, এমনটা আমি দাবি করছি না। আর সাংবাদিকরা অন্যায় করলেও তাঁকে আইনের আওতায় আনা যাবে না, এমন অন্যায় আবদারও করছি না। তবে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, গিয়াস একজন ভালো সাংবাদিক এবং তার চেয়েও ভালো মানুষ। গিয়াসকে আমি ২০ বছর ধরে চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর গিয়াস একজন বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে একপায়ে খাড়া একজন মানুষ। ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম, প্রথম আলোর বন্ধুসভা, আজকের দেশ টিভির দেশ আমার গড়ে উঠেছে তাঁর হাত ধরেই। আমাদের কেউ চেনে না। কিন্তু অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে গিয়াস দেশজুড়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় সাংবাদিক। কিন্তু কোনো দিন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অসততা, সাংবাদিক পরিচয়ের অপব্যবহারের অভিযোগ শোনা যায়নি।
আমার প্রশ্ন হলো, গিয়াস যদি অপরাধও করে থাকে, পুলিশ কি এভাবে তাঁকে পেটাতে পারে? পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিতে পারত, অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিতে পারত, তাঁকে আদালতে হাজির করতে পারত। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে নির্যাতন করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? গিয়াস যদি সত্যি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? আসলে পুলিশ যেটা করেছে সেটা স্রেফ মাস্তানি। বলা হয়, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু পুলিশ যদি মাস্তানি করে, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় খবর এসেছে, নয়াদিলি্লতে এক চোর হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনি থেকে বাঁচার জন্য মোবাইলে পুলিশ ডাকে। আমাদের পাশের দেশে চোরও বাঁচার জন্য পুলিশকে ডাকে। আর আমাদের দেশে পুলিশ ধরে নিরপরাধ সাংবাদিককে গণপিটুনি দেয়!
পুলিশের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মতো অনেক কারণ আছে। তাঁরা সবচেয়ে কম বেতনে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশে পুলিশকে প্রায় সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়। যত ভালো কাজই করুক, তাদের বিরুদ্ধে সব সময় হাজারটা অভিযোগ তৈরি থাকে। আর ট্রাফিক পুলিশদের তো সারা দিনই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অভাব, অভিযোগ, অতিরিক্ত পরিশ্রম_সব চাপ নিয়ে থাকায় সম্ভবত সারাক্ষণই তাদের মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।
ইদানীং একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সাংবাদিক পেলেই পেটায়। এই সার্কফোয়ারা মোড়েই সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মার খেয়েছেন। তাঁরা কোনো পরিচয়ের কথাই শুনতে চান না। অতীতে কোনো সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো প্রতিকার হয়নি বলেই তাঁরা সাংবাদিক পেটাতে উৎসাহী হন। তাঁরা জানেন, প্রকাশ্যে মৃদু ভর্ৎসনা ছাড়া আর কোনো শাস্তি হবে না তাঁদের। সাংবাদিক পেটালে তবু ভর্ৎসনা সইতে হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষকে পেটালে তো কারো কাছে জবাবদিহিও করতে হয় না। বরং মনের সুখে পিটিয়ে ইচ্ছামতো কোনো একটা সাজানো মামলায় আসামি করে দিলেই হলো। পুলিশ হলো আইনের রক্ষক। কিন্তু তারাই যদি ভক্ষক হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, বাংলাদেশে পুলিশের হাতে আইন যতটা রক্ষিত হয়, লঙ্ঘিত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। পুলিশের গাড়ি কখনো ট্রাফিক সিগন্যাল মানে না, সিএনজি স্টেশনে লাইনে দাঁড়ায় না, জ্যামে পড়লে লাল-নীল ভেঁপু বাজিয়ে চলে যায়। শুধু দায়িত্ব পালনের সময় তারা প্রয়োজনে এসব সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশের খালি গাড়ি বা সপরিবারে শপিং করতে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িও সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে তটস্থ করে ফেলে। বাড়িওয়ালারা নাকি পুলিশ শুনলে বাড়িভাড়া দিতে চান না। একবার উঠলে নাকি তাঁদের আর নামানো যায় না। একটা কথা আছে, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। ৫৪ ধারায় তো পুলিশ চাইলেই যখন তখন, যাকে-তাকে আটক করতে পারে। তা ছাড়া প্রতিটি থানায় অনেক মামলা থাকে, যাতে অসংখ্য অজ্ঞাতনামা আসামি থাকে। পুলিশ চাইলে যে কাউকে ধরে সেসব মামলার কোনো একটিতে আসামি করতে পারে। পুলিশ নিজে অস্ত্র নিয়ে গিয়ে কাউকে ধরে সেই অস্ত্র তার হাতে ধরিয়ে ছবি তুলে অস্ত্র মামলার আসামি বানিয়ে দিতে পারে। প্রতিদিন এমন কত ঘটনা যে ঘটে, কত নিরপরাধ মানুষ যে কারাগারে পচে মরছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সময়মতো সাংবাদিক নেতারা না গেলে গিয়াস আহমেদকেও হয়তো জামিন অযোগ্য কোনো মামলার আসামি হয়ে এখন কারাগারে থাকতে হতো। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
কয়েক দিন আগে ডিএমপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে চমৎকার চমৎকার বাণী দিয়েছেন। বলেছেন, পুলিশ সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু। শুনে পুলকিত হয়েছি, ভেবেছি দিনবদলের পালায় হয়তো পুলিশও বদলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে ছয়জন মিলে একজন নিরীহ সাংবাদিককে পিটিয়ে তারা প্রমাণ করেছে, পুলিশ বদলায়নি, পুলিশ বদলাবে না। জনাব পুলিশ কমিশনার, সাংবাদিক শুধু নয়, সাধারণ মানুষও যেন পুলিশের কবল থেকে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে, এটাই আমাদের চাওয়া। খুব কি অন্যায় হয়ে গেল চাওয়াটা?
লেখক : এডিটর, এটিএন নিউজ
probhash2000@yahoo.com
সাংবাদিকরা ধোয়া তুলসীপাতা, এমনটা আমি দাবি করছি না। আর সাংবাদিকরা অন্যায় করলেও তাঁকে আইনের আওতায় আনা যাবে না, এমন অন্যায় আবদারও করছি না। তবে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, গিয়াস একজন ভালো সাংবাদিক এবং তার চেয়েও ভালো মানুষ। গিয়াসকে আমি ২০ বছর ধরে চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর গিয়াস একজন বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে একপায়ে খাড়া একজন মানুষ। ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম, প্রথম আলোর বন্ধুসভা, আজকের দেশ টিভির দেশ আমার গড়ে উঠেছে তাঁর হাত ধরেই। আমাদের কেউ চেনে না। কিন্তু অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে গিয়াস দেশজুড়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় সাংবাদিক। কিন্তু কোনো দিন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অসততা, সাংবাদিক পরিচয়ের অপব্যবহারের অভিযোগ শোনা যায়নি।
আমার প্রশ্ন হলো, গিয়াস যদি অপরাধও করে থাকে, পুলিশ কি এভাবে তাঁকে পেটাতে পারে? পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিতে পারত, অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিতে পারত, তাঁকে আদালতে হাজির করতে পারত। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে নির্যাতন করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? গিয়াস যদি সত্যি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন? আসলে পুলিশ যেটা করেছে সেটা স্রেফ মাস্তানি। বলা হয়, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু পুলিশ যদি মাস্তানি করে, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় খবর এসেছে, নয়াদিলি্লতে এক চোর হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনি থেকে বাঁচার জন্য মোবাইলে পুলিশ ডাকে। আমাদের পাশের দেশে চোরও বাঁচার জন্য পুলিশকে ডাকে। আর আমাদের দেশে পুলিশ ধরে নিরপরাধ সাংবাদিককে গণপিটুনি দেয়!
পুলিশের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মতো অনেক কারণ আছে। তাঁরা সবচেয়ে কম বেতনে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশে পুলিশকে প্রায় সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকতে হয়। যত ভালো কাজই করুক, তাদের বিরুদ্ধে সব সময় হাজারটা অভিযোগ তৈরি থাকে। আর ট্রাফিক পুলিশদের তো সারা দিনই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অভাব, অভিযোগ, অতিরিক্ত পরিশ্রম_সব চাপ নিয়ে থাকায় সম্ভবত সারাক্ষণই তাদের মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।
ইদানীং একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সাংবাদিক পেলেই পেটায়। এই সার্কফোয়ারা মোড়েই সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক মার খেয়েছেন। তাঁরা কোনো পরিচয়ের কথাই শুনতে চান না। অতীতে কোনো সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো প্রতিকার হয়নি বলেই তাঁরা সাংবাদিক পেটাতে উৎসাহী হন। তাঁরা জানেন, প্রকাশ্যে মৃদু ভর্ৎসনা ছাড়া আর কোনো শাস্তি হবে না তাঁদের। সাংবাদিক পেটালে তবু ভর্ৎসনা সইতে হয়, কিন্তু সাধারণ মানুষকে পেটালে তো কারো কাছে জবাবদিহিও করতে হয় না। বরং মনের সুখে পিটিয়ে ইচ্ছামতো কোনো একটা সাজানো মামলায় আসামি করে দিলেই হলো। পুলিশ হলো আইনের রক্ষক। কিন্তু তারাই যদি ভক্ষক হয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, বাংলাদেশে পুলিশের হাতে আইন যতটা রক্ষিত হয়, লঙ্ঘিত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। পুলিশের গাড়ি কখনো ট্রাফিক সিগন্যাল মানে না, সিএনজি স্টেশনে লাইনে দাঁড়ায় না, জ্যামে পড়লে লাল-নীল ভেঁপু বাজিয়ে চলে যায়। শুধু দায়িত্ব পালনের সময় তারা প্রয়োজনে এসব সুবিধা নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশের খালি গাড়ি বা সপরিবারে শপিং করতে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িও সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে তটস্থ করে ফেলে। বাড়িওয়ালারা নাকি পুলিশ শুনলে বাড়িভাড়া দিতে চান না। একবার উঠলে নাকি তাঁদের আর নামানো যায় না। একটা কথা আছে, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। ৫৪ ধারায় তো পুলিশ চাইলেই যখন তখন, যাকে-তাকে আটক করতে পারে। তা ছাড়া প্রতিটি থানায় অনেক মামলা থাকে, যাতে অসংখ্য অজ্ঞাতনামা আসামি থাকে। পুলিশ চাইলে যে কাউকে ধরে সেসব মামলার কোনো একটিতে আসামি করতে পারে। পুলিশ নিজে অস্ত্র নিয়ে গিয়ে কাউকে ধরে সেই অস্ত্র তার হাতে ধরিয়ে ছবি তুলে অস্ত্র মামলার আসামি বানিয়ে দিতে পারে। প্রতিদিন এমন কত ঘটনা যে ঘটে, কত নিরপরাধ মানুষ যে কারাগারে পচে মরছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সময়মতো সাংবাদিক নেতারা না গেলে গিয়াস আহমেদকেও হয়তো জামিন অযোগ্য কোনো মামলার আসামি হয়ে এখন কারাগারে থাকতে হতো। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
কয়েক দিন আগে ডিএমপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে চমৎকার চমৎকার বাণী দিয়েছেন। বলেছেন, পুলিশ সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু। শুনে পুলকিত হয়েছি, ভেবেছি দিনবদলের পালায় হয়তো পুলিশও বদলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে ছয়জন মিলে একজন নিরীহ সাংবাদিককে পিটিয়ে তারা প্রমাণ করেছে, পুলিশ বদলায়নি, পুলিশ বদলাবে না। জনাব পুলিশ কমিশনার, সাংবাদিক শুধু নয়, সাধারণ মানুষও যেন পুলিশের কবল থেকে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে, এটাই আমাদের চাওয়া। খুব কি অন্যায় হয়ে গেল চাওয়াটা?
লেখক : এডিটর, এটিএন নিউজ
probhash2000@yahoo.com
No comments