চরাচর-লবণ উৎপাদন যেখানে যেভাবে by তোফায়েল আহমদ

সাগরের লবণাক্ত পানি অথবা সৈকতের বালি লবণাক্ত পানির সঙ্গে আগুনের তাপে ফুটিয়ে লবণ তৈরি হতো কিছুকাল আগেও। সেই লবণ এখন উৎপাদন হয় উপকূলীয় মাঠে, তাও সম্পূর্ণ সৌরতাপে। এখন লবণ তৈরি অনেকটা নির্ভরশীল আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন ভালো হয়।


দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন হয় কক্সবাজারে। চট্টগ্রাম উপকূলের কিয়দংশ জমিতেও লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। কক্সবাজার-চট্টগ্রামের উৎপাদিত লবণেই দেশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে এই অঞ্চলে লবণের প্রকট সংকট দেখা দেওয়ার কারণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে লবণ উৎপাদনের তাগিদ দেখা দেয়। তদানীন্তন সরকার ১৯৬০-৬১ সাল থেকে পরিকল্পিতভাবে লবণ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় কক্সবাজারের উপকূলীয় মাঠে। এ জন্য বিসিক ১৯৬১ সালে সাত হাজার একর জমিতে সৌরতাপের মাধ্যমে লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। সেই সময় লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার টন। মাত্র ছয় দশকের ব্যবধানে বর্তমানে লবণ উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার একরে। সেই সঙ্গে উৎপাদনও হচ্ছে বার্ষিক ১৫-১৭ লাখ টন লবণ।
লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি এখন দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। শুরুতে বড় পাত্রে সাগরের লবণাক্ত পানি ফুটিয়ে লবণ উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে দুই ধরনের পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে। লবণ উৎপাদনে শুধু জমি ও মানুষের শ্রম ছাড়া আর কোনো উপাদানের প্রয়োজন হয় না। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ চাষে পলিথিনে বাড়তি বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় রয়েছে। লবণের বিস্তীর্ণ চাষের জমিতে ছোট বাঁধ দিয়ে লবণের মাঠ তৈরি করা হয়। ওই মাঠ নিখুঁতভাবে সমতল করার জন্য স্থানীয়ভাবে তৈরি 'গরা' (ভারী কাঠ) নামের বিশেষ উপকরণ দিয়ে মাঠ সমতল করা হয়। এরপর ওই মাঠে সাগরের লবণাক্ত পানি ঢোকানো হয়। ছোট মাঠটিতে পানি দুই-তিন দিন স্থায়ী হওয়ার পর সেই পানি আরেকটি মাঠে ঢোকানো হয়। সেখানে এক-দুই দিন শুকানোর পর চূড়ান্ত মাঠটিতে পানি স্থানান্তর করা হয়। চূড়ান্ত মাঠে দুই-তিন দিন থাকার পর সেখানে জমানো পানি জলীয় বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার পর লবণ জমাট বেঁধে ওঠে মাঠে। সাগরের পানি থেকে প্রতিবার লবণ উৎপাদন হতে সময় লাগে সাত থেকে ১০ দিন। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে যেমন- শুষ্ক, রোদ ও গরম বাতাস হলে চার থেকে ছয় দিনের মধ্যেই মাঠ থেকে প্রতিবার লবণ তোলা যায়। এভাবে সরাসরি মাঠ থেকে যে লবণ উৎপাদন হয়, তার বেশির ভাগই হচ্ছে 'কালো লবণ'। এক দশক ধরে আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। এটি সনাতন পদ্ধতির মতোই। লবণের মাঠ সমতলভাবে তৈরি করে তার ওপর পলিথিন বিছিয়ে দেওয়া হয়। পলিথিনের ওপরই লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানো হয়। এভাবে পলিথিনের ওপরই লবণাক্ত পানি শুকিয়ে লবণ বেরিয়ে আসে। এ পদ্ধতির লবণ অপেক্ষাকৃত সাদা ও ময়লামুক্ত লবণ হিসেবে পরিচিত।
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া, মহেশখালী, উপকূলীয় উপজেলা পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়েই মাঠে লবণ উৎপাদন হয়।
তোফায়েল আহমদ

No comments

Powered by Blogger.