দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে চিকিৎসাব্যবস্থা by এ কে এম শাহনাওয়াজ
আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতির অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক শক্তির ব্যবস্থাপনায় ও নিয়ন্ত্রণে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়। জনকল্যাণমুখী সৎ প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব সরকার পরিচালকদের ওপরই বর্তায়। তাই সরকার পরিচালকদের রজনৈতিক দর্শনে যদি সততা থাকে, তবে তার শুভ ছায়া পড়ে রাষ্ট্রের সব প্রশাসনিক ও সেবামূলক
প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালকদের রাজনীতি যদি স্বার্থ আর দুর্নীতিপরায়ণতায় নষ্ট হয়ে যায়, তবে তার দুষ্ট প্রভাব সর্বস্তরেই প্রতিফলিত হয়। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের দাপটে সর্বস্তরে মাৎস্যন্যায়ের দশা স্পষ্ট হতে থাকে।
সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের ওপর ইন্টার্নি ডাক্তারদের উপর্যুপরি হামলা এবং একজন বিভাগীয় প্রধান নেতা-ডাক্তারের (টিভি স্ক্রিনে দেখা) বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দেয়, বর্তমান সময়ে কোনো কোনো দায়িত্ববান চিকিৎসকের আচরণ ও নৈতিকতার মান কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক আগেই রাজনীতিকে সম্ভ্রমের জায়গা থেকে নামিয়ে পঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছে। নিজেদের দলীয় ও ব্যক্তিক সুবিধাবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে অন্যায় আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। একই সূত্রে রাজনৈতিক সরকারগুলো কোনো সুস্থতা ছড়াতে পারেনি। এই পরিবেশে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা এখন ধনী আর দরিদ্রে ভাগ হয়ে গেছে। ধনীর জন্য আলিশান অত্যাধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। টাকার জোরে সেখানে সুচিকিৎসা এবং ডাক্তারদের ভালো ব্যবহার পাওয়ার সুযোগ থাকে। আর গরিবের জন্য আছে প্রয়োজনের তুলনায় সিকিভাগ শয্যার আসনসংখ্যার সরকারি হাসপাতাল। অভিযোগ আছে, সেখানে বিনা পয়সায় ওষুধ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেবা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। সেবার মানসিকতা আর মমতা নিয়ে রোগীর পাশে দাঁড়ানো ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। প্রাইভেট হাসপাতালে পার্টটাইম চাকরি আর কমিশন-বাণিজ্যে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়ছেন ডাক্তারদের অনেকে। আর এর চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে নষ্ট রাজনীতির অক্টোপাস। গ্রাস করছে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাকে।
দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিশাল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হয়। স্বপ্ন থাকে ওদের চোখে, ওদের পরিবারের চোখে আর দেশের চোখে। বর্তমান বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতির গুণগান গাওয়া মতলববাজ রাজনৈতিক নেতারা ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক বানানোর জন্য অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও কীট দংশিত রাজনীতির জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিবিড় চর্চাকেন্দ্রে অস্ত্রবাজি আর সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম হচ্ছে। ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে মেধাবী নিরীহরা। সর্বকালেই রাজনীতি অঞ্চলের চিকিৎসক নেতারা ভয়ংকর দাপুটে থাকেন। বিএনপি আমলে ড্যাব নেতাদের দাপুটে অবস্থার কথা শোনা যেত। সে সময় পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যেত, কোন ডাক্তার চাকরি পাবেন আর কে পাবেন না বা কোথায় কার বদলি হবে তা ড্যাব নেতাদের সুপারিশ বা মধ্যস্থতা ছাড়া সম্ভব হতো না। অর্থনৈতিক দুর্নীতির কথা তখন প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিল।
শুধু রঙ্গমঞ্চের পরিবর্তন হয়। এখন ড্যাবের জায়গায় আসন পেতে বসেছে স্বাচিপ। বাদবাকি চরিত্রাভিনয় অভিন্ন। একই দাপুটে অবস্থা বিরাজ করছে। এ বাস্তবতা গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে। ফলে সরকার চাইলেও আর এখন কোনো কিছুতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারছে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষানবিস তরুণ ডাক্তারদের অসহিষ্ণু আর সন্ত্রাসী আচরণ এই বিষবাষ্পেরই অসংস্কৃত রূপ।
আমাদের দেশে সৎ ও দায়িত্ববান ডাক্তার থাকলেও অনৈতিক ডাক্তারদের ভিড়ে তাঁরা দৃষ্টিসীমায় খুব আসেন না। এসব কারণে দেশের চিকিৎসায় আস্থা হারিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসার জন্য চুটছে। আমি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত গবেষণার কাজে কলকাতায় ছিলাম। এ সময় পত্রিকার রিপোর্টিংয়ে দেখেছি, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই হাজার রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। আমার পরিচিত কলকাতার একজন সমাজকর্মী বলেছিলেন, এ বাস্তবতায় কলকাতায়ও বাংলাদেশের মতো অনেক পকেটকাটা ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। তবে প্রকৃত ডাক্তার ও হাসপাতালে গেলে দুই দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ফারাকটা বুঝতে পারি। আমি কলকাতায় থাকার সময় অনেক আত্মীয় ও পরিচিতজন চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলে আমার শরণাপন্ন হতেন। সেই সুবাদে অনেক ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে আমাকে। একবার এক আত্মীয়কে ভর্তি করেছিলাম কলকাতার ঐতিহ্যবাহী নীল রতন হাসপাতালে। ভদ্রলোক অল্প দিনে সুস্থ হয়েছিলেন। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, 'এখানে ডাক্তার-নার্সদের ব্যবহারেই আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি।' আজ ঢাকা মেডিক্যালে অপারেশনের রোগী যখন ডাক্তার কর্তৃক প্রহৃত হন, অসুস্থ রোগীকে যখন দেশের প্রধান সরকারি হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়; তখন ভীষণ অসহায় বোধ করি। মনে হয় না দেশে আইনের শাসন বহাল আছে। নৈতিকতার নিশ্চিত অপমৃত্যু ঘটেছে।
দেশের কাগজে আর প্রিন্ট মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে খবর বেরোয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তারদের কমিশন-বাণিজ্য কাজ করে। তখন মনে পড়ে যায় কলকাতার ডাক্তার অধ্যাপক স্বপন বসুর কথা। আমার সহকর্মীর মেয়ে কঠিন ভাইরাসে স্বাভাবিক হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশে চিকিৎসা চলছিল। আমি কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে ডা. স্বপন বসুর সঙ্গে কথা বলি। তিনি তাঁর চেম্বারে দীর্ঘক্ষণ আমাকে সময় দিলেন। মৌখিকভাবে অনেক পরামর্শ দিলেন আমাকে। আমি ভিজিটের টাকা দিতে গেলাম। তিনি নিলেন না। বললেন, আমি রোগী দেখিনি এবং কোনো প্রেসক্রিপশন করিনি। তাই কোনো টাকা প্রাপ্য নই আমি।
আমার মনে আছে, একজন প্রয়াত বিখ্যাত ডাক্তারের কথা। এলিফেন্ট রোডে তাঁর চেম্বারে প্রায় ১৫ বছর আগে আমার মাকে দেখাতে নিয়েছিলাম। ২০ দিন আগে সিরিয়াল নিতে হয়েছিল। রোগী গিজ গিজ করছে। যথারীতি জুনিয়র ডাক্তার রোগের বিবরণ নিচ্ছিলেন। তাঁর লেখা কাগজ নিয়ে ভেতরে গেলাম। বিখ্যাত ডাক্তার জুনিয়রের কাগজে চোখ বুলিয়ে সাকুল্যে প্রায় তিন মিনিট মাকে দেখে খস খস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। আমি আশ্বস্ত হওয়ার জন্য রোগী সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি রাগতস্বরে জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। বুঝলাম, ভিজিটের অনেক ৩০০ টাকা পেছনে দাঁড়ানো। আমার সময় অপচয় করানো ঠিক হচ্ছে না। এ জাতীয় অভিজ্ঞতা ধারণা করছি অনেক ভুক্তভোগীরই আছে।
এসব নীতিহীনতায় হিপোক্রেটীয় শপথের পদদলন দেখে আহত হই। প্রাচীন গ্রিসের মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস ডাক্তারদের জন্য যে শপথবাণী রেখে গিয়েছিলেন, শোনা যায় আধুনিক বিশ্বে অনেক দেশের মেডিক্যাল কলেজেও নবীন ডাক্তারদের পেশা শুরুর আগে তা পাঠ করানো হয়। আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভবত এই শপথ পাঠ করানো হয় না, তবে মেডিক্যাল ইথিক্স পড়ার সময় এই শপথের সঙ্গে পরিচিত হন হবু ডাক্তাররা। শপথবাক্যটি অনেকটা নিম্নরূপ :
'আমি শপথ করছি যে লিখিত সব শর্ত আমি আমার বিচারবুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য পালন করব। এই বিদ্যা যিনি আমাকে শিক্ষাদান করেছেন, তাঁকে মা-বাবার মতো গণ্য করব। প্রয়োজনে আমার সব সম্পদ তাঁর প্রয়োজনে ভাগ করে নেব। তাঁর সন্তানদের আমি নিজের ভাইবোনের মতো দেখব। তারা এই বিদ্যাচর্চা করতে চাইলে বিনা বেতনে বা বিনা শর্তে এই বিদ্যা তাদের শেখাব। আমি আমার বিচারবুদ্ধি ও যোগ্যতা অনুসারে রোগীদের উপকারের উদ্দেশ্যে ওষুধপথ্যের নির্দেশ দেব, তা তাদের অপকার বা ক্ষতির জন্য নয়। কোনো রোগীকেই আমি ক্ষতিকর ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দেব না। বিশেষ করে কোনো মহিলাকে ভ্রূণ হত্যায় সাহায্য করব না। আমি রোগীর ঘরে উপকারের উদ্দেশ্যেই যাব। কারো কোনো ক্ষতির উদ্দেশ্য আমার মধ্যে থাকবে না। রোগীর সব ধরনের গোপনীয়তা আমি রক্ষা করব। আমি আমার জীবন ও বিদ্যাকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ রাখব।'
আজ এ দেশের ডাক্তার যাঁরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাঝরাত পর্যন্ত রোগী দেখে সুচিকিৎসাবঞ্চিত করেন, রাজনৈতিক শক্তির মদে মত্ত হয়ে মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করেন, রোগীর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালান, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অপারেশনের পর পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যায় থাকা রোগীকে বলপূর্বক হাসপাতাল থেকে বের করে দেন, শিক্ষানবিস নবীন ডাক্তারদের উন্মত্ততায় ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়, নিজেদের অপকীর্তি ফাঁস হওয়ার ভয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন দলীয় মাস্তানের মতো, কর্তব্যরত সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করেন- ভাঙেন তাঁদের ক্যামেরা, হাসপাতালের পরিচালক এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে হাসপাতালের দরজা দালালদের জন্য অবারিত রেখে সাংবাদিকদের জন্য বন্ধ করে দেন। এসব দেখে কষ্ট হয় মহান হিপোক্রেটিসের জন্য। তাঁর শপথ কিভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সব ডাক্তার ও শিক্ষানবিস ডাক্তার এসব অপকীর্তির সঙ্গে জড়িত নন। বিভিন্ন পত্রিকার ভাষ্য ও চলমান অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কুপ্রভাব অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এ অঞ্চলকেও কলুষিত করেছে। কিন্তু বাস্তবতাটি দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়। যেহেতু সংকট সৃষ্টির উৎসভূমি রাজনৈতিক মাস্তানি আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, তাই এ অবস্থা থেকে সবাইকে মুক্তি দিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সবার আগে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলবাজি বজায় রেখে কোনো সুস্থতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের ওপর ইন্টার্নি ডাক্তারদের উপর্যুপরি হামলা এবং একজন বিভাগীয় প্রধান নেতা-ডাক্তারের (টিভি স্ক্রিনে দেখা) বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দেয়, বর্তমান সময়ে কোনো কোনো দায়িত্ববান চিকিৎসকের আচরণ ও নৈতিকতার মান কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অনেক আগেই রাজনীতিকে সম্ভ্রমের জায়গা থেকে নামিয়ে পঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছে। নিজেদের দলীয় ও ব্যক্তিক সুবিধাবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে অন্যায় আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। একই সূত্রে রাজনৈতিক সরকারগুলো কোনো সুস্থতা ছড়াতে পারেনি। এই পরিবেশে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা এখন ধনী আর দরিদ্রে ভাগ হয়ে গেছে। ধনীর জন্য আলিশান অত্যাধুনিক হাসপাতাল রয়েছে। টাকার জোরে সেখানে সুচিকিৎসা এবং ডাক্তারদের ভালো ব্যবহার পাওয়ার সুযোগ থাকে। আর গরিবের জন্য আছে প্রয়োজনের তুলনায় সিকিভাগ শয্যার আসনসংখ্যার সরকারি হাসপাতাল। অভিযোগ আছে, সেখানে বিনা পয়সায় ওষুধ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সেবা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। সেবার মানসিকতা আর মমতা নিয়ে রোগীর পাশে দাঁড়ানো ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। প্রাইভেট হাসপাতালে পার্টটাইম চাকরি আর কমিশন-বাণিজ্যে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়ছেন ডাক্তারদের অনেকে। আর এর চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে নষ্ট রাজনীতির অক্টোপাস। গ্রাস করছে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাকে।
দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিশাল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হয়। স্বপ্ন থাকে ওদের চোখে, ওদের পরিবারের চোখে আর দেশের চোখে। বর্তমান বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতির গুণগান গাওয়া মতলববাজ রাজনৈতিক নেতারা ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক বানানোর জন্য অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও কীট দংশিত রাজনীতির জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিবিড় চর্চাকেন্দ্রে অস্ত্রবাজি আর সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম হচ্ছে। ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে মেধাবী নিরীহরা। সর্বকালেই রাজনীতি অঞ্চলের চিকিৎসক নেতারা ভয়ংকর দাপুটে থাকেন। বিএনপি আমলে ড্যাব নেতাদের দাপুটে অবস্থার কথা শোনা যেত। সে সময় পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যেত, কোন ডাক্তার চাকরি পাবেন আর কে পাবেন না বা কোথায় কার বদলি হবে তা ড্যাব নেতাদের সুপারিশ বা মধ্যস্থতা ছাড়া সম্ভব হতো না। অর্থনৈতিক দুর্নীতির কথা তখন প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিল।
শুধু রঙ্গমঞ্চের পরিবর্তন হয়। এখন ড্যাবের জায়গায় আসন পেতে বসেছে স্বাচিপ। বাদবাকি চরিত্রাভিনয় অভিন্ন। একই দাপুটে অবস্থা বিরাজ করছে। এ বাস্তবতা গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে। ফলে সরকার চাইলেও আর এখন কোনো কিছুতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারছে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষানবিস তরুণ ডাক্তারদের অসহিষ্ণু আর সন্ত্রাসী আচরণ এই বিষবাষ্পেরই অসংস্কৃত রূপ।
আমাদের দেশে সৎ ও দায়িত্ববান ডাক্তার থাকলেও অনৈতিক ডাক্তারদের ভিড়ে তাঁরা দৃষ্টিসীমায় খুব আসেন না। এসব কারণে দেশের চিকিৎসায় আস্থা হারিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসার জন্য চুটছে। আমি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত গবেষণার কাজে কলকাতায় ছিলাম। এ সময় পত্রিকার রিপোর্টিংয়ে দেখেছি, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে প্রায় দুই হাজার রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। আমার পরিচিত কলকাতার একজন সমাজকর্মী বলেছিলেন, এ বাস্তবতায় কলকাতায়ও বাংলাদেশের মতো অনেক পকেটকাটা ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। তবে প্রকৃত ডাক্তার ও হাসপাতালে গেলে দুই দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ফারাকটা বুঝতে পারি। আমি কলকাতায় থাকার সময় অনেক আত্মীয় ও পরিচিতজন চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলে আমার শরণাপন্ন হতেন। সেই সুবাদে অনেক ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে আমাকে। একবার এক আত্মীয়কে ভর্তি করেছিলাম কলকাতার ঐতিহ্যবাহী নীল রতন হাসপাতালে। ভদ্রলোক অল্প দিনে সুস্থ হয়েছিলেন। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, 'এখানে ডাক্তার-নার্সদের ব্যবহারেই আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি।' আজ ঢাকা মেডিক্যালে অপারেশনের রোগী যখন ডাক্তার কর্তৃক প্রহৃত হন, অসুস্থ রোগীকে যখন দেশের প্রধান সরকারি হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়; তখন ভীষণ অসহায় বোধ করি। মনে হয় না দেশে আইনের শাসন বহাল আছে। নৈতিকতার নিশ্চিত অপমৃত্যু ঘটেছে।
দেশের কাগজে আর প্রিন্ট মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে খবর বেরোয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তারদের কমিশন-বাণিজ্য কাজ করে। তখন মনে পড়ে যায় কলকাতার ডাক্তার অধ্যাপক স্বপন বসুর কথা। আমার সহকর্মীর মেয়ে কঠিন ভাইরাসে স্বাভাবিক হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশে চিকিৎসা চলছিল। আমি কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে ডা. স্বপন বসুর সঙ্গে কথা বলি। তিনি তাঁর চেম্বারে দীর্ঘক্ষণ আমাকে সময় দিলেন। মৌখিকভাবে অনেক পরামর্শ দিলেন আমাকে। আমি ভিজিটের টাকা দিতে গেলাম। তিনি নিলেন না। বললেন, আমি রোগী দেখিনি এবং কোনো প্রেসক্রিপশন করিনি। তাই কোনো টাকা প্রাপ্য নই আমি।
আমার মনে আছে, একজন প্রয়াত বিখ্যাত ডাক্তারের কথা। এলিফেন্ট রোডে তাঁর চেম্বারে প্রায় ১৫ বছর আগে আমার মাকে দেখাতে নিয়েছিলাম। ২০ দিন আগে সিরিয়াল নিতে হয়েছিল। রোগী গিজ গিজ করছে। যথারীতি জুনিয়র ডাক্তার রোগের বিবরণ নিচ্ছিলেন। তাঁর লেখা কাগজ নিয়ে ভেতরে গেলাম। বিখ্যাত ডাক্তার জুনিয়রের কাগজে চোখ বুলিয়ে সাকুল্যে প্রায় তিন মিনিট মাকে দেখে খস খস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। আমি আশ্বস্ত হওয়ার জন্য রোগী সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি রাগতস্বরে জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। বুঝলাম, ভিজিটের অনেক ৩০০ টাকা পেছনে দাঁড়ানো। আমার সময় অপচয় করানো ঠিক হচ্ছে না। এ জাতীয় অভিজ্ঞতা ধারণা করছি অনেক ভুক্তভোগীরই আছে।
এসব নীতিহীনতায় হিপোক্রেটীয় শপথের পদদলন দেখে আহত হই। প্রাচীন গ্রিসের মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস ডাক্তারদের জন্য যে শপথবাণী রেখে গিয়েছিলেন, শোনা যায় আধুনিক বিশ্বে অনেক দেশের মেডিক্যাল কলেজেও নবীন ডাক্তারদের পেশা শুরুর আগে তা পাঠ করানো হয়। আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভবত এই শপথ পাঠ করানো হয় না, তবে মেডিক্যাল ইথিক্স পড়ার সময় এই শপথের সঙ্গে পরিচিত হন হবু ডাক্তাররা। শপথবাক্যটি অনেকটা নিম্নরূপ :
'আমি শপথ করছি যে লিখিত সব শর্ত আমি আমার বিচারবুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য পালন করব। এই বিদ্যা যিনি আমাকে শিক্ষাদান করেছেন, তাঁকে মা-বাবার মতো গণ্য করব। প্রয়োজনে আমার সব সম্পদ তাঁর প্রয়োজনে ভাগ করে নেব। তাঁর সন্তানদের আমি নিজের ভাইবোনের মতো দেখব। তারা এই বিদ্যাচর্চা করতে চাইলে বিনা বেতনে বা বিনা শর্তে এই বিদ্যা তাদের শেখাব। আমি আমার বিচারবুদ্ধি ও যোগ্যতা অনুসারে রোগীদের উপকারের উদ্দেশ্যে ওষুধপথ্যের নির্দেশ দেব, তা তাদের অপকার বা ক্ষতির জন্য নয়। কোনো রোগীকেই আমি ক্ষতিকর ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দেব না। বিশেষ করে কোনো মহিলাকে ভ্রূণ হত্যায় সাহায্য করব না। আমি রোগীর ঘরে উপকারের উদ্দেশ্যেই যাব। কারো কোনো ক্ষতির উদ্দেশ্য আমার মধ্যে থাকবে না। রোগীর সব ধরনের গোপনীয়তা আমি রক্ষা করব। আমি আমার জীবন ও বিদ্যাকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ রাখব।'
আজ এ দেশের ডাক্তার যাঁরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাঝরাত পর্যন্ত রোগী দেখে সুচিকিৎসাবঞ্চিত করেন, রাজনৈতিক শক্তির মদে মত্ত হয়ে মানুষের সঙ্গে দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করেন, রোগীর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালান, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অপারেশনের পর পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যায় থাকা রোগীকে বলপূর্বক হাসপাতাল থেকে বের করে দেন, শিক্ষানবিস নবীন ডাক্তারদের উন্মত্ততায় ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়, নিজেদের অপকীর্তি ফাঁস হওয়ার ভয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন দলীয় মাস্তানের মতো, কর্তব্যরত সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করেন- ভাঙেন তাঁদের ক্যামেরা, হাসপাতালের পরিচালক এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে হাসপাতালের দরজা দালালদের জন্য অবারিত রেখে সাংবাদিকদের জন্য বন্ধ করে দেন। এসব দেখে কষ্ট হয় মহান হিপোক্রেটিসের জন্য। তাঁর শপথ কিভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
আমরা বিশ্বাস করি, দেশের সব ডাক্তার ও শিক্ষানবিস ডাক্তার এসব অপকীর্তির সঙ্গে জড়িত নন। বিভিন্ন পত্রিকার ভাষ্য ও চলমান অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কুপ্রভাব অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এ অঞ্চলকেও কলুষিত করেছে। কিন্তু বাস্তবতাটি দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়। যেহেতু সংকট সৃষ্টির উৎসভূমি রাজনৈতিক মাস্তানি আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, তাই এ অবস্থা থেকে সবাইকে মুক্তি দিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সবার আগে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলবাজি বজায় রেখে কোনো সুস্থতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments