আনোয়ারায় বিতর্কিত প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ-উচ্চ আদালতে ফটোকপি পাঠিয়ে ডিসি দুষছেন রেজিস্ট্রার দপ্তরকে

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরুর পর জেলা প্রশাসনের কাছে এ-সংক্রান্ত মূল ফাইল চেয়েছিলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ উচ্চ আদালতে মূল ফাইল না পাঠিয়ে ফটোকপি পাঠিয়ে দেন।


অথচ এখন ফটোকপি পাঠানোর দায় রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মূল ফাইল না পাঠিয়ে ফটোকপি পাঠানোর বিষয়ে গত ১৯ জুলাই কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় 'আনোয়ারায় ভূমি অধিগ্রহণ, উচ্চ আদালত চেয়েছিলেন মূল ফাইল, ডিসি পাঠান ফটোকপি!' শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
কেন ফটোকপি পাঠানো হয়েছিল জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ গতকাল বুধবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আদালতের নির্দেশনা অনুসারে মূল ফাইল এবং ফটোকপি দুটোই পাঠানো হয়েছিল। জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে যে কর্মকর্তা ফাইল নিয়ে ঢাকার রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছিলেন ফটোকপি দিলেই হবে। তাই ফটোকপি রেখে মূল কপি নিয়ে আসা হয়। পরে যখন মূল ফাইল চাওয়া হয়, তখন মূল ফাইলটি পুনরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।' রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তারা কেন মূল ফাইল না রেখে ফটোকপি রেখেছিলেন- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।
আনোয়ারায় প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে জমি অধিগ্রহণ করছে জেলা প্রশাসন। জানা গেছে, অবৈধভাবে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা দায়েরের পর আদালত মূল ফাইলটি তলব করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ উচ্চ আদালতে মূল ফাইল পাঠাননি। পাঠিয়েছিলেন সত্যায়িত ফটোকপি। আর মূল ফাইল নিয়ে চলে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
জানা গেছে, ২০১০-এর ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নোটে ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নতুন রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশনা দেন। এ নির্দেশের পরও রিপোর্ট দাখিল না করে সরাসরি অধিগ্রহণ অনুমোদন হয়েছে- মর্মে মন্ত্রণালয় থেকে একটি নথি জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণ কার্যক্রম চালায়। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কাজ স্থগিত করতে উচ্চ আদালত থেকে ফাইল চেয়ে পাঠানো হলে ডিসি মূল ফাইল না পাঠিয়ে ফটোকপি পাঠান। প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, 'হাইকোর্ট ফাইল তলব করা মানেই কোনো কার্যক্রম স্থগিত রাখা, ডিসি সাহেবের উচিত ছিল সে নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো।'
ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও ভুল থাকায় এ-সংক্রান্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুলনিশি জারি করে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো) বজায় রাখার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু প্রতিপক্ষ সিপিএলএ দাখিল করে চেম্বার জজের মাধ্যমে স্থগিতাবস্থার আদেশকে স্থগিত করে।
আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণ। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর, বিমানবাহিনী, চট্টগ্রাম বন্দর, বেসামরিক বিমান চলাচল, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরসহ যেসব কর্তৃপক্ষ বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কারো কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) সংগ্রহ করেননি ডিসি।
জানা যায়, এই জমি বাবদ বসুন্ধরা গ্রুপ জেলা প্রশাসনকে নিয়মিতভাবে শিল্পভূমি হারে খাজনা দিয়ে আসছে। বসুন্ধরা লিজ ভাড়া বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বছরে আট কোটি ৪৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে আসছে। এ ছাড়া ভ্যাট ও উৎসে কর পরিশোধ করছে বছরে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ভূমি উন্নয়ন, সীমানা বাঁধ নির্মাণ, ভাঙন রোধের ব্যবস্থা, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে এ জমিকে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির একটি প্রতিবেদনেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ওই কমিটির প্রতিবেদনে আনোয়ারার পরিবর্তে বাঁশখালী থানার খানখানাবাদে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশকেও পাত্তা দিচ্ছেন না জেলা প্রশাসক।

No comments

Powered by Blogger.