এরশাদকে চারদলীয় জোটে ভেড়াতে ১৫ কোটি টাকা ঘুষ দেয়া হয়- নেপথ্য কাহিনী by রাজন ভট্টাচার্য
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটে যেতে এরশাদকে ১৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিল বিএনপি। দলের পৰে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ওই ঘুষের টাকা দেন। জাতীয় পার্টির পৰে টাকা গ্রহণ করেন দলের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য, যাঁরা এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে
চারদলীয় জোটে ভেড়াতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। রাজনীতির চুলচেরা বিশেস্নষণের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যনত্ম মহাজোট করেন এরশাদ। ওয়াদা রৰা না করায় বিএনপিকে ১৫ কোটি টাকা ফেরত দিতে হয়েছিল। আর বিএনপি তথা চারদলীয় জোটে এরশাদকে নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর মহাজোটে যোগ না দিতে ফের ২০ হাজার ডলার ঘুষ দেয়ার প্রসত্মাব দেয়া হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, হুমকি দিয়ে এরশাদকে লন্ডনে চলে যেতে বলা হয় বিএনপির পৰ থেকে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছিল চরম অস্থিরতা। বিএনপি-জামায়াত জোট পাতানো নির্বাচন চূড়ানত্ম করেছিল। নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে নামে ১৪ দল। নির্বাচন বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে শুরম্ন হয় আন্দোলন। শেষ পর্যনত্ম বাতিল হয় নির্বাচন। বিশেষ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশে জারি হয় জরম্নরী অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে জয়ী হতে শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয় জাতীয় পার্টি। দলে ভেড়াতে চারদলীয় জোট ও ১৪ দল এরশাদের সঙ্গে আলোচনা শুরম্ন করে। তবে প্রথমদিকে চারদলীয় জোটের দিকেই এরশাদের পালস্না ভারি ছিল। চারদলীয় জোটে ভেড়াতে জাতীয় পার্টির পৰে বিএনপির সঙ্গে লিয়াজোঁ রৰা করেন গোলাম মসিহ ও মশিউর রহমান রাঙ্গা।
২০০৬ সালের ২৭ জুলাই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির পৰে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবর এরশাদের সঙ্গে সাৰাত করে জাতীয় পার্টিকে চার দলে যোগ দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রসত্মাব দেন। আলোচনা করেন খালেদা জিয়াও। আলোচনার জন্য কয়েক দফা এরশাদকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের পৰ থেকে। ৰমতায় গেলে পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে চারদলীয় জোটে যেতে অনেকটাই সম্মত ছিলেন এরশাদ। সর্বশেষ ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে চার দলে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন তিনি। প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী বিএনপির পৰ থেকে ঘুষের ১৫ কোটি টাকা তুলে দেয়া হয় লিয়াজোঁ রৰাকারী দুই প্রেসিডিয়াম সদস্যের হাতে। তবে চারদলীয় জোটে যাওয়ার ঘোষণা এরশাদের জন্য কাল হয়ে আসে। ফের তাঁর বিরম্নদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলা সচল হতে থাকে। একটি দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন জানালে আদালত তা নাকচ করে। নির্বাচনের আগে আবারও জেলে যাওয়া অনেকটা চূড়ানত্ম হয় এরশাদের। রাজনীতির মাঠে শুরম্ন হয় নতুন মেরম্নকরণ। ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টিকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের দলে রাখার চেষ্টা চালায় সবসময়। মামলার মাধ্যমে বিএনপির পৰ থেকেই এই ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছিল।
১৯৯০ সালে গণঅভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর তৎকালীন বিএনপি সরকার তাঁর বিরম্নদ্ধে ২৫টির বেশি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল দুর্নীতি সংক্রানত্ম। ২৫ মামলার মধ্যে তিনটি মামলায় সাজা হয় এরশাদের। '৯০-৯৬ ছয় বছর কারাভোগ করেন এরশাদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৰমতায় আসার পর একে একে সব কটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি। মুক্তি পান জেল থেকে। ২০০১ সালে পহেলা অক্টোবর বিএনপি জামায়াত জোট ৰমতায় আসার পর আবারও এরশাদের বিরম্নদ্ধে আয়কর সংক্রানত্ম দুর্নীতি মামলা ২০০৩ সালে সচল করা। এরশাদকে বশে রাখতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ট্রাম্পকার্ড হিসেবে এই মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের কার্যতালিকায় জাপানী বোট ক্রয় সংক্রানত্ম দুর্নীতির মামলা আবারও সচল হয়ে ওঠে। বিপদে পড়েন এরশাদ। চার দলে যাওয়া নিয়ে বিভ্রানত্মিকর মনত্মব্য দেন তিনি। এরশাদকে ১৪ দলে নিতে জাতীয় পার্টির পৰে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই দুই নেতার শক্তিশালী ভূমিকার কারণে ১৪ দলে যেতে রাজি হন এরশাদ। নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে মহাসমাবেশ আহ্বান করে চারদলীয় জোট। চার দলে যোগ দিচ্ছেন এরশাদ, তখনও আশাবাদী ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু মহাসমাবেশের একদিন আগেই অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর আত্মগোপন করেন তিনি। ১৯ তারিখ ছিল ১৪ দলের মহাসমাবেশ।
চার দলে যেতে বিএনপির পৰ থেকে এরশাদকে ঘুষ দেয়ার বিষয়টি দীর্ঘসময় পর পরিষ্কার হয় ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই জাতীয় পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে। চারদলীয় জোটে যেতে এরশাদকে বিএনপির পৰ থেকে ঘুষের প্রসত্মাব দেয়া হয়েছিল একথা স্বীকার করেছেন দলের সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নিজেই। বক্তব্যে তিনি বলেন, মহাজোটে না যেতে এরশাদকে ২০ হাজার ডলার ঘুষের প্রসত্মাব দেয়া হয় বিএনপির পৰ থেকে। বলা হয় টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার জন্য। হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু মহাজোটে যোগ দেয়ার প্রশ্নে অবিচল ছিলেন এরশাদ। জাতীয় পার্টির নেতাদের ভাষ্য, প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী মহাজোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে নির্বাচিত হলেও ওয়াদা রৰা করেনি আওয়ামী লীগ। বঞ্চিত করা হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হয়নি এরশাদকে। যে কারণে মহাজোট গঠনে জাতীয় পার্টির পৰে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দুই নেতা দীর্ঘদিন নিজ দলে অনেকটা তোপের মুখে আছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর প্রেসিডিয়াম বৈঠক থেকে শুরম্ন করে গুরম্নত্বপূর্ণ কর্মকা-ে তাদের উপস্থিতি খুবই কম। দলের কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ এরশাদ নিজেই বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
যেভাবে আত্মগোপন করেন এরশাদ
রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস শুরম্নর আগে থেকেই গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, দলীয় অফিস থেকে শুরম্ন করে ব্যক্তিগত কাজে কোথাও গেলেও পিছু নিত গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এর মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ। ১৯ ডিসেম্বর ১৪ দলের মহাসমাবেশ। কোথায় যাবেন তিনি? চার দলের সঙ্গে রাজনৈতিক বনিবনা না হওয়ার কারণে ১৪ দলে যাওয়ার সিদ্ধানত্ম পাকা করেন এরশাদ। তবুও রাজনীতির মাঠে ছিল নানা আলোচনা সমালোচনা। চমক দেখাতে পারেন এরশাদ, এমন গুঞ্জনও ছিল সর্বত্র। ঘটনা ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বরের। পরদিন চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ। নানা আতঙ্ক আর হুমকি। বিএনপির পৰ থেকে চাপের মুখে এরশাদ। অস্থির সময় কাটছিল গুলশানের প্রেসিডেন্ট পার্কে। ভোরে হাঁটতে যাওয়া এরশাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ব্যতিক্রম ছিল শুধু সেদিনেই। সেদিন সকালে হাঁটতে যাননি তিনি! সকাল সাড়ে নয়টার পর হাঁটার পোশাক পরেন। অবাক সবাই। বাসা থেকে বের হওযার আগেই গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের ম্যানেজ করেন চতুর এই নেতা। বলেন, তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই। আমি বেশি দূর যাব না। বাসার সামনে থেকে হেঁটে চলে আসব। এরশাদের কথা বিশ্বাস করলেন সবাই। তবে তিনি যে পালাবেন, আগে থেকেই সব ছিল ঠিকঠাক। বাসার সামনে গলির মাথায় এরশাদের জন্য অপেৰা করছিল দলীয় এক নেতার সাদা রংয়ের প্রাইভেট কার। হাঁটার পোশাকে গাড়িতে ওঠে এরশাদের ভোঁ। সরাসরি গিয়ে উঠেন শেখ হেলালের বাসায়। এরশাদ কোথায়? এ নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম। তোলপাড়। ঘুম হারাম গোয়েন্দাদের। সংবাদ মাধ্যমে এরশাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর ফলাও করে প্রচার শুরম্ন হয়। খবর রটে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। হাসপাতাল কতর্ৃপৰ তা স্বীকার করেনি। এমনকি নিজের স্ত্রী রওশনও জানতেন না এরশাদ কোথায়। তিনি নিজেও স্বামীকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ১৭-১৮ ডিসেম্বর দুই দিন এরশাদ শেখ হেলালের বাসায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর রাতে কঠোর গোপনীয়তা রৰা করে রাতে ভাত খেতে এসেছিলেন ছোট ভাই জিএম কাদেরের গুলশানের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন দলের বিশ্বসত্ম নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। নিজের মোবাইল বন্ধ করে তাদের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ রৰা করেন এরশাদ। পার হলো ১৮ ডিসেম্বর। হতাশ চারদলীয় জোট। কারণ তাদের মহাসমাবেশে যাননি এরশাদ। ১৯ ডিসেম্বর ১৪ দলের মহাসমাবেশে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দুপুরের পর মঞ্চে ওঠেন এরশাদ। এর মধ্য দিয়ে এরশাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরম্ন হয় মহাজোটে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছিল চরম অস্থিরতা। বিএনপি-জামায়াত জোট পাতানো নির্বাচন চূড়ানত্ম করেছিল। নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে নামে ১৪ দল। নির্বাচন বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে শুরম্ন হয় আন্দোলন। শেষ পর্যনত্ম বাতিল হয় নির্বাচন। বিশেষ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশে জারি হয় জরম্নরী অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে জয়ী হতে শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয় জাতীয় পার্টি। দলে ভেড়াতে চারদলীয় জোট ও ১৪ দল এরশাদের সঙ্গে আলোচনা শুরম্ন করে। তবে প্রথমদিকে চারদলীয় জোটের দিকেই এরশাদের পালস্না ভারি ছিল। চারদলীয় জোটে ভেড়াতে জাতীয় পার্টির পৰে বিএনপির সঙ্গে লিয়াজোঁ রৰা করেন গোলাম মসিহ ও মশিউর রহমান রাঙ্গা।
২০০৬ সালের ২৭ জুলাই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির পৰে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবর এরশাদের সঙ্গে সাৰাত করে জাতীয় পার্টিকে চার দলে যোগ দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রসত্মাব দেন। আলোচনা করেন খালেদা জিয়াও। আলোচনার জন্য কয়েক দফা এরশাদকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিএনপি চেয়ারপার্সনের পৰ থেকে। ৰমতায় গেলে পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে চারদলীয় জোটে যেতে অনেকটাই সম্মত ছিলেন এরশাদ। সর্বশেষ ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে চার দলে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন তিনি। প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী বিএনপির পৰ থেকে ঘুষের ১৫ কোটি টাকা তুলে দেয়া হয় লিয়াজোঁ রৰাকারী দুই প্রেসিডিয়াম সদস্যের হাতে। তবে চারদলীয় জোটে যাওয়ার ঘোষণা এরশাদের জন্য কাল হয়ে আসে। ফের তাঁর বিরম্নদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলা সচল হতে থাকে। একটি দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন জানালে আদালত তা নাকচ করে। নির্বাচনের আগে আবারও জেলে যাওয়া অনেকটা চূড়ানত্ম হয় এরশাদের। রাজনীতির মাঠে শুরম্ন হয় নতুন মেরম্নকরণ। ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টিকে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের দলে রাখার চেষ্টা চালায় সবসময়। মামলার মাধ্যমে বিএনপির পৰ থেকেই এই ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছিল।
১৯৯০ সালে গণঅভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর তৎকালীন বিএনপি সরকার তাঁর বিরম্নদ্ধে ২৫টির বেশি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল দুর্নীতি সংক্রানত্ম। ২৫ মামলার মধ্যে তিনটি মামলায় সাজা হয় এরশাদের। '৯০-৯৬ ছয় বছর কারাভোগ করেন এরশাদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৰমতায় আসার পর একে একে সব কটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি। মুক্তি পান জেল থেকে। ২০০১ সালে পহেলা অক্টোবর বিএনপি জামায়াত জোট ৰমতায় আসার পর আবারও এরশাদের বিরম্নদ্ধে আয়কর সংক্রানত্ম দুর্নীতি মামলা ২০০৩ সালে সচল করা। এরশাদকে বশে রাখতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ট্রাম্পকার্ড হিসেবে এই মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের কার্যতালিকায় জাপানী বোট ক্রয় সংক্রানত্ম দুর্নীতির মামলা আবারও সচল হয়ে ওঠে। বিপদে পড়েন এরশাদ। চার দলে যাওয়া নিয়ে বিভ্রানত্মিকর মনত্মব্য দেন তিনি। এরশাদকে ১৪ দলে নিতে জাতীয় পার্টির পৰে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই দুই নেতার শক্তিশালী ভূমিকার কারণে ১৪ দলে যেতে রাজি হন এরশাদ। নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে মহাসমাবেশ আহ্বান করে চারদলীয় জোট। চার দলে যোগ দিচ্ছেন এরশাদ, তখনও আশাবাদী ছিল বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু মহাসমাবেশের একদিন আগেই অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর আত্মগোপন করেন তিনি। ১৯ তারিখ ছিল ১৪ দলের মহাসমাবেশ।
চার দলে যেতে বিএনপির পৰ থেকে এরশাদকে ঘুষ দেয়ার বিষয়টি দীর্ঘসময় পর পরিষ্কার হয় ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই জাতীয় পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে। চারদলীয় জোটে যেতে এরশাদকে বিএনপির পৰ থেকে ঘুষের প্রসত্মাব দেয়া হয়েছিল একথা স্বীকার করেছেন দলের সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নিজেই। বক্তব্যে তিনি বলেন, মহাজোটে না যেতে এরশাদকে ২০ হাজার ডলার ঘুষের প্রসত্মাব দেয়া হয় বিএনপির পৰ থেকে। বলা হয় টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার জন্য। হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু মহাজোটে যোগ দেয়ার প্রশ্নে অবিচল ছিলেন এরশাদ। জাতীয় পার্টির নেতাদের ভাষ্য, প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী মহাজোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে নির্বাচিত হলেও ওয়াদা রৰা করেনি আওয়ামী লীগ। বঞ্চিত করা হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হয়নি এরশাদকে। যে কারণে মহাজোট গঠনে জাতীয় পার্টির পৰে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দুই নেতা দীর্ঘদিন নিজ দলে অনেকটা তোপের মুখে আছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর প্রেসিডিয়াম বৈঠক থেকে শুরম্ন করে গুরম্নত্বপূর্ণ কর্মকা-ে তাদের উপস্থিতি খুবই কম। দলের কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ এরশাদ নিজেই বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
যেভাবে আত্মগোপন করেন এরশাদ
রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস শুরম্নর আগে থেকেই গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, দলীয় অফিস থেকে শুরম্ন করে ব্যক্তিগত কাজে কোথাও গেলেও পিছু নিত গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এর মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ। ১৯ ডিসেম্বর ১৪ দলের মহাসমাবেশ। কোথায় যাবেন তিনি? চার দলের সঙ্গে রাজনৈতিক বনিবনা না হওয়ার কারণে ১৪ দলে যাওয়ার সিদ্ধানত্ম পাকা করেন এরশাদ। তবুও রাজনীতির মাঠে ছিল নানা আলোচনা সমালোচনা। চমক দেখাতে পারেন এরশাদ, এমন গুঞ্জনও ছিল সর্বত্র। ঘটনা ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বরের। পরদিন চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশ। নানা আতঙ্ক আর হুমকি। বিএনপির পৰ থেকে চাপের মুখে এরশাদ। অস্থির সময় কাটছিল গুলশানের প্রেসিডেন্ট পার্কে। ভোরে হাঁটতে যাওয়া এরশাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ব্যতিক্রম ছিল শুধু সেদিনেই। সেদিন সকালে হাঁটতে যাননি তিনি! সকাল সাড়ে নয়টার পর হাঁটার পোশাক পরেন। অবাক সবাই। বাসা থেকে বের হওযার আগেই গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের ম্যানেজ করেন চতুর এই নেতা। বলেন, তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই। আমি বেশি দূর যাব না। বাসার সামনে থেকে হেঁটে চলে আসব। এরশাদের কথা বিশ্বাস করলেন সবাই। তবে তিনি যে পালাবেন, আগে থেকেই সব ছিল ঠিকঠাক। বাসার সামনে গলির মাথায় এরশাদের জন্য অপেৰা করছিল দলীয় এক নেতার সাদা রংয়ের প্রাইভেট কার। হাঁটার পোশাকে গাড়িতে ওঠে এরশাদের ভোঁ। সরাসরি গিয়ে উঠেন শেখ হেলালের বাসায়। এরশাদ কোথায়? এ নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম। তোলপাড়। ঘুম হারাম গোয়েন্দাদের। সংবাদ মাধ্যমে এরশাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর ফলাও করে প্রচার শুরম্ন হয়। খবর রটে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। হাসপাতাল কতর্ৃপৰ তা স্বীকার করেনি। এমনকি নিজের স্ত্রী রওশনও জানতেন না এরশাদ কোথায়। তিনি নিজেও স্বামীকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ১৭-১৮ ডিসেম্বর দুই দিন এরশাদ শেখ হেলালের বাসায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর রাতে কঠোর গোপনীয়তা রৰা করে রাতে ভাত খেতে এসেছিলেন ছোট ভাই জিএম কাদেরের গুলশানের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন দলের বিশ্বসত্ম নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। নিজের মোবাইল বন্ধ করে তাদের মোবাইল ফোন দিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ রৰা করেন এরশাদ। পার হলো ১৮ ডিসেম্বর। হতাশ চারদলীয় জোট। কারণ তাদের মহাসমাবেশে যাননি এরশাদ। ১৯ ডিসেম্বর ১৪ দলের মহাসমাবেশে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দুপুরের পর মঞ্চে ওঠেন এরশাদ। এর মধ্য দিয়ে এরশাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরম্ন হয় মহাজোটে।
No comments