পরিত্যক্ত জমি দখলে বহুমাত্রিক জালিয়াতি by আপেল মাহমুদ

গুলশানে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত অন্তত ৩০টি প্লট জালিয়াতির সঙ্গে পাকিস্তানি পরিচয়ে শতাধিক ব্যক্তি সক্রিয় রয়েছে। ১৯৭১ সালের আগে এসব প্লটের মালিক বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও বর্তমানে তাঁদের নাম ধারণ করে প্লটগুলো হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে একটি চক্র। একেক সময় একেকজন প্লটের মালিক হিসেবে আবির্ভূত হন।


তবে ব্যক্তির বদল হলেও সবাই একই নাম ধারণ করেন। ব্লক-সিডাব্লিউএন(বি), গুলশান এভিনিউয়ের ২৮ নম্বর প্লটের প্রকৃত মালিক ছিলেন হোসনে আরা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপরিবারে এদেশ থেকে চলে গেলে তাঁর প্লটটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। জানা গেছে, বিগত ১০ বছরে অন্তত ১৫ জন নিজেদের হোসনে আরা পরিচয় দিয়ে আমমোক্তারনামা কিংবা বায়না দলিল করেছেন। বর্তমানে প্লটটির দখলে আছেন আবু সুফিয়ান নামে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
গুলশান এভিনিউ সড়কের ১১৩ নম্বর প্লটের প্রকৃত মালিক পাকিস্তানের নাগরিক এস কে রেজা চৌধুরী। তিনি বর্তমানে জীবিত এবং পাকিস্তানে বসবাস করছেন। অথচ তাঁকে মৃত দেখিয়ে তাঁর ছয় ওয়ারিশের কাছ থেকে আমমোক্তারনামা দলিলের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত প্লটটি দখলে নিয়েছে একটি আবাসন কম্পানি।
সিআইডির পরিদর্শক উত্তম কুমার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্লটটি পরিত্যক্ত হিসেবে সরকারের গেজেটভুক্ত। অথচ এ সম্পত্তি পাকিস্তানি মালিককে মৃত এবং তাঁর জীবিত ওয়ারিশদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করে দলিল সম্পাদন করা হয়েছে। তিনি জানান, রাজউকের অনুরোধে ২০০৭ সালে সিআইডি এই প্লট নিয়ে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু প্লটের মালিক দাবিদার কেউ দীর্ঘ পাঁচ বছরেও সিআইডির সামনে হাজির হননি। বলা হচ্ছে, প্লট মালিক এস কে রেজা চৌধুরী ২০০৪ সালে মারা গেছেন। অথচ ২০০২ সালের নথিতে তাঁর মৃত্যুর সনদ যুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, সংঘবদ্ধ জালিয়াতচক্র আদালতের একপক্ষীয় রায় নিয়ে সাফকবলা দলিল করে গুলশানের শত শত কোটি টাকার প্লট হাতিয়ে নিয়েছে। এ বিশাল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পেছনে রাজউক এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া খাতাপত্রে বর্তমানে পরিত্যক্ত 'ক' তালিকায় ৫৮টি এবং 'খ' তালিকায় ৭০টি প্লট থাকলেও বাস্তবে বেশির ভাগই রাজউকের দখলে নেই। পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছাড়াও গুলশানে অর্পিত, পূর্ত ও নগর উন্নয়ন, লেক, রেলওয়ে, সড়ক ও জনপথ, ডাক, তার ও টেলিফোন, বিজেএমসি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মসজিদের খতিয়ান রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এসব খতিয়ানে থাকা অনেক জমি আগেই দখল হয়ে গেছে। এসব সম্পত্তির বিষয়ে 'কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই' প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করলেন রাজউকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলশানে পরিত্যক্ত তালিকাভুক্ত বাড়ির মধ্যে বর্তমানে অন্তত ৩৪টি মূল্যবান প্লট বিভিন্ন জালিয়াত চক্র হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব প্লট মালিকদের কেউ-ই বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা পাকিস্তান বা অন্য কোথাও চলে গেছেন। স্বাধীনতার এত বছর পরও নতুন করে পাকিস্তানি মালিক সাজিয়ে প্লটগুলো আত্মসাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। আদালতে যোগসাজশ মামলা, ভুয়া মালিক সাজিয়ে মামলা এবং মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মামলা দায়ের করে জালিয়াতরা আদালতকে বিভ্রান্ত করছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে পরিত্যক্ত সম্পত্তির বেশ কিছু প্লট দখলদার চক্রের হাতে চলে গেছে বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে রাজউকের একটি সূত্র জানায়, পরিত্যক্ত হিসাবে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু প্লটের কাগজপত্র তারা চিহ্নিত করে নিরাপদ স্থানে তালাবদ্ধ করে রেখেছে।
তালিকা অনুযায়ী দখলের হুমকিতে থাকা গুলশানের প্লটগুলো হচ্ছে : ১. সড়ক-৯৩, প্লট-১৫সি, মালিক এম এম জলিল খান, ২. সড়ক-৯৬/৯৩, প্লট-১৯, মালিক মো. ওহীদুল নবী, ৩. সড়ক-১০১/১০৩, প্লট-১৩ মালিক নেছার মোহাম্মদ খান, ৪. সড়ক-১০৮, প্লট-১৪, মালিক টি এ খান, ৫. সড়ক-১০৮, প্লট-১৪, মালিক আরহাম উদ্দিন সিদ্দিকী, ৬. সড়ক-১০৮/১১২, প্লট-১, মালিক আরিফুল হাসান, ৭. সড়ক-১০৭, প্লট-৪, মালিক মো. শাহাবুদ্দীন, ৮. সড়ক-১০৮, প্লট-২১, মালিক মেসার্স ইয়াকুব লিমিটেড, ৯. সড়ক-১১৫, প্লট-১০, মালিক হারুন্নেসা, ১০. সড়ক-১১৬, প্লট-৯, মালিক বিলকিস বানু, ১১. সড়ক-গ, প্লট-৮০, মালিক নিগার পারভিন, ১২. সড়ক-৪৯ক, প্লট-১, মালিক আসাদুজ্জামান চৌধুরী ও শওকত আলী চৌধুরী, ১৩. সড়ক-৪৯, প্লট-১, মালিক এস এম তাকী ও কোরাইশী, ১৪. সড়ক-৪৭/৪৮, প্লট-২, মালিক রওশনা আরা বেগম, ১৫. সড়ক-৪১, প্লট-৬, মালিক হাবিব সুলতান জায়েদী (ফালু), ১৬. সড়ক-৪৪, প্লট-৩০এ, মালিক মোখতার আহমেদ আনসারী, ১৭. সড়ক-৪৪গ, প্লট-১১৯, মালিক হোসনে আরা বেগম, ১৮. সড়ক-গ, প্লট-১১৩, মালিক এস কে রেজা চৌধুরী, ১৯. সড়ক-গ, প্লট-১০৫, মালিক মোস্তারী বেগম, ২০. সড়ক-গ, প্লট-৭৯, মালিক আবদুল্লাহ ভাই, ২১. সড়ক-৩২, প্লট-২৩, মালিক অজ্ঞাতপরিচয়, ২২. সড়ক-১৬/২১, প্লট-৬, মালিক শামসুল হক, ২৩. সড়ক-৭২, প্লট-১, মালিক মো. কেরামত আলী, ২৪. সড়ক-৭১/৭৪, প্লট-৯, মালিক ইউসুফ আলী খান, ২৫. সড়ক-৮৭, প্লট-৪, মালিক এম এ সাত্তার, ২৬. সড়ক-৫৯, প্লট-১৯, মালিক হাফিজা বেগম, ২৭. সড়ক-৫৪, প্লট-১৩, মালিক আবদুল মালেক, ২৮. সড়ক-৫৩, প্লট-১২, মালিক মাহবুব আনাম, ২৯. সড়ক-৫০, প্লট-১৯, মালিক মোস্তফা হায়দার, ৩০. সড়ক-গ১১, প্লট-৩৫, মালিক সাবেক আইজিপি আফসার উদ্দিন, ৩১. সড়ক-১১, প্লট-৩, মালিক সৈয়দ আহমেদ হাসমী, ৩২. সড়ক-১৪, প্লট-৪, মালিক ফাতেমা জহুরা, ৩৩. সড়ক-৪৬/৫২/৫৩, প্লট-৪৫, মালিক মো. নাইম খান ও ৩৪. সড়ক-২৯, প্লট-৫, মালিক আবদুল জলিল।
এর মধ্যে মো. নাইম খানের প্লটটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই প্লটটির তিন দিকে সড়ক রয়েছে। গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বরের কেন্দ্রস্থলে প্লটটির অবস্থান। প্রায় ১০ কাঠা পরিমাণ এই প্লটের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্লটটি বর্তমানে ১৫ জন দখলদার নিয়ন্ত্রণ করছেন। অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা সেখানে খাবার হোটেল, সিমেন্ট, ইট-বালির ব্যবসা, পুরনো কাগজ বেচাকেনার দোকান দিয়েছেন। দখলদারদের একজন, অপূর্ব রেস্তরাঁর মালিক মো. আবু ইউসুফ বলেন, প্লটের মূল মালিক পাকিস্তানি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এখানে হোটেল ব্যবসা করলেও কখনো তাঁকে দেখেননি। তবে কেউ কেউ নাইম খান সেজে প্লটের দলিল করার চেষ্টা করছেন বলে তিনি শুনেছেন। এই প্লটের ওপর অবৈধভাবে নির্মিত জাকিয়া রেস্তরাঁর মালিক রানা জানান, তিনি যুবলীগ করেন। গত ২০ বছর ধরেই এখানে ব্যবসা করে আসছেন। তবে প্লটের মূল মালিক পাকিস্তানি বলে তিনিও স্বীকার করেন।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর সরকারের মালিকানাধীন প্রায় ১১০টি বাড়ি বা প্লট হাতছাড়া হয়ে গেছে। এর মধ্যে গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা ও মোহাম্মদপুর এলাকার প্লটের সংখ্যাই বেশি। তবে জালিয়াত চক্রের মূল টার্গেট হলো গুলশান-বনানীর পরিত্যক্ত প্লট। গুলশানেই রয়েছে এ রকম প্রায় ৪০টি প্লট, যা হীরকখণ্ড হিসেবে পরিচিত। এক বিঘার একটি প্লট হাতিয়ে নিতে পারলেই কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। যার জন্য দেড় শতাধিক জালিয়াত সংঘবদ্ধভাবে এসব প্লট দখল করার জন্য ভুয়া পাকিস্তানি সেজে, জাল দলিল কিংবা আদালতের ভুয়া রায় বের করছে। এ ধরনের ৪০টি ফাইল চিহ্নিত করে রাজউক সেগুলোর কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
জালিয়াতির কিছু প্রমাণ এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে প্লট দখলে নিতে জালিয়াতরা পাকিস্তানি নাগরিকদের বাংলাদেশি নাগরিক বানানোর জন্য পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করছে। এমনকি নাগরিকত্ব সনদসহ ট্রেড লাইসেন্সও তাঁদের নামে করা হচ্ছে। গুলশান ৫০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর প্লটটি জাল দলিল করার জন্য তারা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। প্লটের মালিক পাকিস্তানি নাগরিক মো. মোস্তফা হায়দার, পিতা মৃত ফজলে হায়দার। মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে মরহুম আমেদান খাতুন। তাঁর নামে করা জাতীয় পরিচয়পত্রে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে গ্রাম ও ডাকঘর-পাঁচ্চর, থানা-শিবচর, জেলা-মাদারীপুর। পরিচয়পত্র নম্বর-৫৪১৮৭৭৩৮১৯৬১৭। তা ছাড়া গুলশান ৫৯ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর প্লটের মূল মালিক পাকিস্তানি নাগরিক হাফিজা বেগমের শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রই (নম্বর-২৬৯৪২৬২৬৭৩২৪০) তৈরি করা হয়নি, একই সঙ্গে তাঁর পাসপোর্টও তৈরি করা হয়। পাসপোর্ট নম্বর-বি ১২৩৬৪৫৭। পাসপোর্টে তাঁর স্বামী হিসেবে নাম উল্লেখ করা হয় মৃত আজিমউদ্দিন আহমেদ। ঢাকা আঞ্চলিক অফিস থেকে পাসপোর্টটি ইস্যু করা হয়। তাঁর ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে- ১৬৪/বি, লালবাগ রোড, লালবাগ, ডাকঘর-পোস্তা, ঢাকা।
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. নূরুল হুদা এ বিষয়ে বলেন, সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। রাজউক সে নির্দেশনা মেনে কাজ করছে। বেদখল হয়ে যাওয়া মূল্যবান প্লটগুলো উদ্ধারের জন্য রাজউক আইনগতভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, একই ব্যক্তির নামে একাধিক ব্যক্তি রাজউকে এসে প্লটের মালিকানা দাবি করছেন। অথচ তাঁরা কেউই প্লটের মালিক নন। এরপরও কিছু প্লট তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাজউকের একটি সূত্র জানায়, গুলশান ১৪ নম্বর রোডের ৪ নম্বর প্লটের প্রকৃত মালিক পাকিস্তানি নাগরিক ফাতেমা জোহুরা। বর্তমানে তাঁর কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও এ নামেই এক ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে বাড়ির দখল নিয়েছেন।
গুলশানের ১০৯ নম্বর রোডের ৪ নম্বর প্লটের মূল মালিক পাকিস্তানের নাগরিক মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বাধীনতার আগেই তিনি এদেশ ছেড়ে চলে যান। ফলে মালিকানাবিহীন প্লট হিসেবে তা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। দুই বিঘা জমির এই প্লটটির বর্তমান বাজারমূল্য কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা। ১০৯ নম্বর রোডের ৪ নম্বর প্লটের মালিক আরেক পাকিস্তানি নাগরিক সৈয়দ আহমেদ হাসমী। সরেজমিনে দেখা যায়, একটি জালিয়াত চক্র নিজেরাই সৈয়দ আহমেদ হাসমী সেজে মূল্যবান প্লটটি দখল করে রেখেছে। তাদের লোকজনই এক বিঘা জমির এই প্লটের পাহারায় রয়েছে। ৮৪ নম্বর সড়কে ১৭ নম্বর প্লটটি পরিত্যক্ত হিসেবে গেজেটভুক্ত হলেও তা সরকারের দখলে নেই। ৩০ কাঠার এই মূল্যবান প্লটে বর্তমান দখলদার হিসেবে আছেন সরকারি দলের এক নেতা।

No comments

Powered by Blogger.