৫৮৯০টি মামলা প্রত্যাহার করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেয়া হয়- ২০০১-এর নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা by মুহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

(শেষাংশ) ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনার সংখ্যা বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৮০০০ (আঠার হাজার)-এরও উর্ধে। সহিংসতার প্রায় ৯ বৎসর পর গঠিত একটি মাত্র বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের বরাবর দাখিলকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৫৪৪৩টি।


অতীত ইতিহাস পর্যালোচনায় ইহা সুপ্রমাণিত যে, সাধারণত একটি মাত্র স্পর্শকাতর জনগুরুত্বসম্পন্ন অপরাধ/সহিংসতার ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠিত হয় এবং একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনাস্থলে সংঘটিত অপরাধ তদন্তের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে। দেশব্যাপী সংঘটিত হাজার হাজার সহিংস ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত/অনুসন্ধান করা একটি মাত্র তদন্ত কমিশনের পক্ষে বাস্তবতার দৃষ্টিতে সম্ভব কিনা তা দেশের সচেতন জনগণের চিন্তু-ভাবনার অবকাশ আছে বলে কমিশন মনে করে। তদুপরি অত্র কমিশন তাদের সামর্থ্য, অপ্রতুল জনবল, নির্ধারিত মেয়াদ বিবেচনায় ৩৪৬৭টি সহিংস ঘটনার তদন্ত/অনুসন্ধান সম্পন্ন করে দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হলেও বাস্তব কারণেই এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সহিংস ঘটনা অন্তরালে রয়ে গেছে। অগোচরে বা দৃশ্যপটে না আসা সহিংস ঘটনাসমূহের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলে কমিশন মনে করে। উপরোক্ত তদন্ত কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে মহাহাইকোর্টের মতামত সাপেক্ষে প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী পুলিশ সুপার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে একটি করে স্বল্প মেয়াদের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সরকারও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। উক্ত কমিশনকে নিজ জেলায় তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করে অভিযোগ সংগ্রহ ও তদন্তপূর্বক অনূর্ধ ০৩ (তিন) মাসের মধ্যে সরকারের রবাবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। জেলাভিত্তিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর অত্র বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন কর্র্তৃক ইতোমধ্যে তদন্ত সম্পন্নকৃত সহিংসতার ঘটনাসমূহের বিয়োজন বা সংযোজন করে নির্বাচনোত্তর সহিংস ঘটনার পূর্ণাঙ্গরূপ দেয়া সম্ভব হবে। এই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল স্থাপন করা যেতে পারে।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান/তদন্তে অভিজ্ঞতার আলোকে ইহা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ব্যাপক হারে সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) স্থানীয় পর্যায়ে আইনগত সুবিধা পায়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবৈধ প্রভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমগণ চিহ্নিত দলীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি এবং থানাও মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করা সম্ভব হলেও রাজনৈতিক প্রভাবে সুষ্ঠু তদন্ত না করে আসামিগণকে অব্যাহতির সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দায়ের করা সম্ভব হলেও পরবর্তীতে চাপ প্রয়োগ করে সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যতীত অভিযুক্ত দলীয় সন্ত্রাসীগণ আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। জোরপূর্বক বিচারকালে সাক্ষ্য হাজির করতে দেওয়া হয়নি বা হুমকির মুখে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে এজাহারকারী/বাদীকে বাধ্য করা হয়েছে। সর্বোপরি গণহারে সরকার কথিত রাজনৈতিক মামলা গণ্যে ৫৮৯০টি মামলা প্রত্যাহার করে চিহ্নিত দলীয় সন্ত্রাসীদের মুক্তি দিয়েছে। এছাড়া ৯৪৫টি মামলা থেকে বেছে বেছে বিএনপিদলীয় ক্যাডার আসামিদের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের অনৈতিক রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নির্বাচনোত্তর সহিংসতা নির্যাতিতরা আইনের আশ্রয় গ্রহণ বা আদালতে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
অবশ্য গণমাধ্যম, বিরোধী রাজনৈতিক দল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং জনমতের অব্যাহত চাপের মুখে দুই-একটি চাঞ্চল্যকর অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। নির্বাচনোত্তর সহিংসতার সাথে সংশ্লিষ্ট গুটি কয়েক মামলা তীক্ষè নজরদারি ও তদারকির কারণে অভিযুক্তদের অনুকূলে নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখনও তা বিচারাধীন আছে।
২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় নির্যাতিত ব্যক্তিগণ (ভিকটিমগণ) রাজনৈতিক অবৈধ প্রভাবের কারণে তৎসময়ে অভিযোগ দায়ের করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করা সম্ভব হলেও ন্যায়বিচার না পাওয়ায় বিদ্যমান আইনে এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় বর্তমানে আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ আছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের দৃষ্টিতে প্রাপ্ত এবং প্রাথমিক তদন্তকৃত অভিযোগসমূহ সম্পর্কে আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত সুপারিশ করা হলো : (ছক দ্রষ্টব্য)
কমিশনের নিজস্ব বিবেচনায় উপরে বর্ণিত আইনের বিধানসমূহ প্রয়োগ সম্পর্কে মতামত দেওয়া হলো :
আইনের বিধানসমূহের নানামুখী ব্যাখ্যার সুযোগ থাকায় প্রয়োগের সময় আইন বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই উদ্দেশ্য কার্যকর করার স্বার্থে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা/আইন শাখার সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি সমন্বয় সেল গঠন করা আবশ্যক হবে। উপরন্তু জেলা পর্যায়ে বিজ্ঞ পিপি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের একজন প্রতিনিধি (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট জেলাসমূহের নির্বাচনোত্তর সহিংসতার সাথে সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহ সম্পর্কে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে মর্মে কমিশন মনে করে।

লেখক : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ

No comments

Powered by Blogger.