সিডনির মেলব্যাগ- অভিবাসীর আত্মশুদ্ধি ও তারুণ্যের অগ্রযাত্রা by অজয় দাশ গুপ্ত
অস্ট্রেলিয়ার গণতান্ত্রিক সমাজে
দীর্ঘ বসবাসের পরও আমাদের আত্মিক উন্নতি বা নৈতিক প্রগতি যতটা এগোবার কথা
এগুতে পারেনি। জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা ুদ্র এক জনগোষ্ঠী। সংস্কৃতি চর্চায়
ব্যাকুল, নিজেদের অস্তিত্ব রায় ব্যগ্র, কর্মকাণ্ডের সিংহভাগই নিজেদের মধ্যে
বিস্তৃত। স্বীকার করি না, এগুলোরও প্রয়োজন আছে।
বাংলা
বইমেলা, বাঙালীর পহেলা বৈশাখ, একুশে, স্বাধীনতা, বিজয় দিবস, শোক দিবস
যথানিয়মে পালিত হচ্ছে, হবেও। একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারায় চলবার এবং
মেশার জন্য যে জাতীয় কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন তা এখনও তেমনভাবে চোখে পড়ে না।
বলা বাহুল্য তারুণ্য এর অন্তভর্ুক্ত নয়। প্রবাসে আমাদের মতো অভিবাসী
মানুষের সমাজ দু'ভাগে বিভক্ত। বিভিন্ন দেশে জন্ম নেয়া, অথবা শৈশব কৈশোর
থেকে বেড় ওঠা বাঙালীর এক ধারা, মধ্য বয়সী অভিবাসীদের আরেক ধারা। যেহেতু এরা
এখনও বয়সে বেড়ে ওঠেনি, এবং বয়স অনুপাতে পিছিয়ে, নেতৃত্ব তাই আমাদের মতো
মধ্যবয়সী বাঙালীর হাতেই। যারা জন্মসূত্রে দেশের অর্জন ও সীমাবদ্ধতা বয়ে
বেড়াচ্ছি। আমাদের জীবনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির
অস্তিত্ব প্রকট, দীর্ঘমেয়াদী অপশাসন, সামরিকায়ন আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
বিকৃতির শিকার হবার কারণে স্বচ্ছতা আর শুদ্ধতা প্রায় েেত্র নির্বাসিত।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোও ভিন্ন ধরনের। আমাদের সন্তান অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের
বাংলাদেশীরা কথাবার্তা, আচার-আচরণে ঋজু। তারা যা বিশ্বাস করে সেটা বলে,
তাই করে। কিছুকাল পূর্বে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম আমন্ত্রিত হয়ে। সে
সন্ধ্যার পরিবেশটা ইতোপূর্বের সাাত বা অন্যান্য দিনের মতো ছিল না। কেমন
একটা গুমোট ভাব, কেন এই অস্বস্তি? পরে জানা গেল ইয়ার ইলেভেনে পড়া ছেলেটির
কারণে গুমোট হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। কি অপরাধ ছিল সেই তরুণের? জামাকাপড় গুছাতে
গিয়ে মার চোখে পড়েছিল লাইটার, তাও ছেলেটির শার্টের পকেটে। সংস্কারগ্রস্ত
জননী স্নেহ ও ভালবাসার অন্ধ আবরণ সরাতে পানেননি। তরুণের কাছে প্রশ্ন
রেখেছিলেন 'কোথা থেকে এলো এই লাইটার'? সত্য আর হিপোক্রেসিহীন জগতের
বাসিন্দা তরুণ কেন মিথ্যা বলবে? কেন তার আশ্রয় হবে ভ্রান্তি বিলাস? স্কুলের
শিক, দেশের মন্ত্রী, ট্রেনের ড্রাইভার, বাসের চালক কিংবা বন্ধু-বান্ধব
কোথাও মিথ্যের আশ্রয় নেয় না কেউ। সত্য বলা সত্য ভাষণই যেখানে নিত্য ও ফরজ,
সেখানে তারা ভীতু বাঙালীর মতো ভনিতা বা কৌশলের আশ্রয় নেবে কোন দুঃখে?
ছেলেটি মাকে সরাসরি জানিয়েছিল, এই লাইটার তার সিগারেট জ্বালানোর কাজে লাগে,
ব্যস! তাতেই মহাভারত অশুর হয়ে উঠল, শান্তি হয়ে উঠল সুদূর পরাহত। আমরা তো
শুনে থ। এগারো কাসের যুবক সিগারেটে ঝুঁকবে_ এটাই তো স্বাভাবিক। যে সব
অভিভাবক বা আমার মতো সন্ধিগ্ধ পিতা হা-পিত্যেশ করেন তাঁরা ঐ বয়সে কি
করেছিলেন? কি ফুঁকে ছিলাম আমরা? পার্থক্য এই, এ দেশে বড় হওয়া তরুণ-তরুণীরা
মিথ্যে বলে না বা কোন কৃতকর্মকেই অস্বীকার করে না। সত্যভাষী তরুণটির সততা ও
সত্যভাষণের জন্য গর্বিত হবার পরিবর্তে কুণ্ঠিত ও শঙ্কিত অভিভাবকের কারণে
সন্ধ্যাটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই ব্যবধান রচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেবল
তারুণ্যের বেলায় নয়, মধ্যবয়সীরা নিজেদের মধ্যেও অসহিষ্ণু। ধরুন এই
মেলব্যাগের কথা। কোন একটি অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পরই অসহিষ্ণু
মতামত আর নৈর্ব্যক্তিক প্রতিক্রিয়া দেখে বিস্মিত হই। জনকণ্ঠের ঔদার্য আর
অনুমোদনে সিডনি এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত এক নগরী। এখানকার বাঙালী ও
মূলধারার জীবন কাহিনীও কম বেশি সুবিদিত। তবু নিস্তার নেই। গলাচিপা বা
ঝালকাঠির আওয়ামী লীগ, বিএনপির কর্মকাণ্ড যতটা স্থান ও গুরুত্বের দাবিদার
সিডনিও তার বাইরের কিছু নয়, পাঠকের ধৈর্যচু্যতি বা বিরক্তি ঘটানোর অধিকার
নেই কারোই। তবু প্রবাসী খায়েশের উগ্রতায় শঙ্কিত হবার বিকল্প দেখি না। তাদের
ধারণা, তাদের নামগুলো ছাপা হওয়াই বড় কথা। বাকি সব তুচ্ছ। নিজেদের ছোট করতে
বা ছোট করার চেষ্টায় আমাদের মতো আগ্রহী ও অতু্যৎসাহী জাতি দুনিয়ায় বিরল।
আশার কথা এই, আমাদের পূর্ববতর্ী এবং আমাদের বয়সী প্রজন্ম এখন অনেক বেশি
কান্ত। প্রায় ঝিমিয়েই পড়েছেন। অন্যদিকে উঠে আসছে নতুন প্রজন্ম। সেখানে যেন এ
জাতীয় হতাশা, ঝগড়া বিবাদ বা অশান্তির থাবা পৌঁছুতে না পারে। কেউ যেন
কারুর প্রিয়তা দতা অথবা জন সম্পৃক্ততায় ঈর্ষান্বিত হয়ে না ওঠে, ঘরে ঘরে
ছড়িয়ে পড়া কম্পিউটার, ই-মেইলের মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেকে খাটো করার
প্রবণতামুক্ত থাকাটা এখন জরুরীই বটে। কি আশ্বর্য! দেখেও শিখছি না আমরা।
এদেশে বড় হওয়া প্রজন্ম বলতে গেলে সর্বণিক কম্পিউটারেই ব্যস্ত। আমাদের যুগে
পারস্পরিক দেখা-সাাত ব্যতীত আড্ডা হতো না। এরা তা প্রযুক্তির কল্যাণে
গৃহবন্দী করে ফেলেছে। এদের আড্ডাঘর-মিলনস্থল, কথাবার্তা, ভাব বিনিময়ের
দৈনন্দিন সঙ্গী প্রযুক্তি তথা কম্পিউটার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোন রেকর্ড
নেই এরা নিজেদের অপমান বা অবমাননার জন্য তার এস্তেমাল করেছে, অথচ
শুচিবায়ুগ্রস্ত আমরা এদের কম্পিউটারে মগ্ন দেখলেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ি। দিনে
বড় জোর কয়েক ঘণ্টা, কেউ সপ্তাহ, কেউ বা কয়েকদিনে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করা
কম্পিউটারের কি হাল করেছি আমরা? পূজা সমিতি, ঈদ কমিটি থেকে ব্যক্তি ঈর্ষায়
জ্বলজ্বলে প্রতীক আর দগদগে ঘা-এর মতো মেইলগুলো বাঙালী জনগোষ্ঠীর লজ্জা।
হয়েই থাকবে। বৃষ্টিস্নাত এক অপরাহ্নে সেদিন দুই যুবক এসেছিল। উদ্দেশ্য
তাদের প্রতিষ্ঠিত ওয়েব টিভিতে ইন্টারভিউ তথা আলাপচারিতা। সৌজন্য ও
তারুণ্য_ এ দু' কারণে এড়ানো যায়নি। কিন্তু এতটা উজ্জ্বল তারুণ্যে বাংলাদেশ
তো জেগে থাকবে অন্যভাবে। এদের কর্মকাণ্ড হবে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারা অনুগামী।
সেভাবে জেগে উঠবে স্বদেশ ও তার ভাবমূর্তি। সাধারণ তারুণ্য যেন মূলস্রোত
বিচু্যত না হয়। ওরাই যে আমাদের ভরসা।
No comments