মহাজোট সরকারের এক বছর এবং বাজার বিদু্যত ও গ্যাস by নিয়ামত হোসেন
নতুন মহাজোট সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। একটি বছর দিনের হিসেবে ৩৬৫ দিন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হয়, যে সরকারের মেয়াদকাল হচ্ছে পাঁচ বছর সে সরকারের জন্য মাত্র ৩৬৫ দিন এমন কিছু বড় সময় নয়। বহু কিছু গুছিয়ে উঠতে হয়, অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সেসবের বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হয়।
তাই সরকারের কাজের বড় ধরনের ফল এ সময় আশা করা যায় না। সামগ্রিক মূল্যায়ন তাই এই সময়ে করাও ঠিক নয়। তারপরও আরেকটি যুক্তিতে বলতে হয় পাঁচ বছরের মেয়াদে এক বছর হচ্ছে পুরো সময়ের এক-পঞ্চমাংশ। এই এক-পঞ্চমাংশ দেখে ধারণা করা যেতে পারে বাকি চারভাগ সময়টিতে কি হতে পারে বা হওয়া সম্ভব! সেদিক থেকে চলে যাওয়া এক বছরের মোটামাটি একটা মূল্যায়ন করা যায়। কথায় আছে 'মনির্ং শোজ দ্য ডে।' প্রভাতে বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। তাই বর্তমান সরকারের 'মর্নিং'-টাই দেখেই আগামী সমন্বয়ের ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
নতুন মহাজোট সরকার সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে কথাটি বলা যায় সেটি হচ্ছে, এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে, অর্থাৎ ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে। এই বিপুল ভোটকে সাধারণভাবে দেখলে হবে না, এই বিপুল ভোটের পেছনে রয়েছে দেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়নই সরকারের কাজ, সরকারের দায়িত্ব। নির্বাচনের আগে সরকারও তাদের ইশতেহার তথা কর্মসূচী দিয়ে মানুষের ব্যাপকতম সমর্থন পেয়েছে এবং ঐ কর্মসূচীগুলোই মানুষের মনের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলে গেছে। সেই কর্মসূচী তথা প্রত্যাশার মূল কথা হচ্ছে, নতুন ধারা, পুরনো দিনের প্রত্যাবর্তন নয়; নতুন দিন, দিনবদল। স্বাধীনতা অর্জনের পর কত দিনই তো পার হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের প্রথম তিন-সাড়ে তিন বছরের শাসনের পর অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক ধরনের শাসন বা শাসক এসেছে। সর্বশেষ দেখেছে একাধিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শেষ পর্যন্ত ভোট এবং ভোটের পর নতুন এই মহাজোট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ। এত সব দেখার পর এবার মানুষ সত্যি সত্যি পরিবর্তন চেয়েছে। সেই পুরনো কালচার থেকে দেশ বেরিয়ে এসে আর পাঁচটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের মতো সামনে ল্য নিধর্ারণ করে এগিয়ে চলেছে, এটা দেখতে চেয়েছে। নতুন আশা নিয়ে তাই তারা সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের দিনবদলের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
এই এক বছরে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে নানা বিশ্লেষণ তথা মূল্যায়ন হয়েছে। কারও কারও মতে, সরকার কিছু করতে পারেনি, কোন সার্থকতা নেই তাদের। অর্থাৎ তাঁরা বলতে যাচ্ছেন, সরকারের কাজে কোন সফলতা নেই, আবার অনেকে বলছেন, সরকারের কাজকর্ম ভালভাবেই চলছে, ঠিক পথে চলছে, সরকারের কাজকর্ম এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা যথেষ্ট ভাল, ইত্যাদি। বিভিন্ন আলোচনায় বলা হচ্ছে, অতীতের কলঙ্কমোচনের কাজে অনেকখানি এগুনো সম্ভব হয়েছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে, অন্যায় করা পার পাওয়া যায় না_ এই ধারণা এখন সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি।
অতীতের জাতীয় কলঙ্কমোচন, প্রত্যেক অপরাধের আইন মাফিক বিচার এসবই জনগণের শুধু প্রত্যাশাই নয়, এগুলো দাবি। সে দাবি পূরণে কাজ হচ্ছে দেখে মানুষ খুশি হবে। মানুষ খুশি হবে এর সঙ্গে দেশে গণতান্ত্রিক সুশাসন জোরদার হলে, সুস্থ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল স্থায়ী হলে। দেশের মানুষ আর অতীতের কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে চায় না, অতীতের ধারায়ও ফিরে যেতে চায় না। সকল কলঙ্ক ও গ্লানিমোচন করে নতুনভাবে নতুন যুগে চলতে চায়। এটাই তাদের প্রত্যাশা। বিংশ শতাব্দী চলে গেছে অনেক দিন। একবিংশ শতাব্দী শুরুও হয়েছে সেও অনেক দিন হলো। এরপর দেখতে দেখতে পার হতে চলল একটি দশকও। এখন চলতে হবে নতুনভাবে, নতুন আলোকে, নতুন নতুন ল্য বাস্তবায়নের পথে মানুষ এখন কথা নয়, কাজ দেখতে চায়, অনেক কথা বহুকাল ধরে শুনেছে, এখন আর অত কথা তাদের মন ভোলায় না, বাস্তবে কাজ দেখলে তারা খুশি হয়।
১৫ আগস্ট কলঙ্কের বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বড় বড় অন্যায় অপরাধের বিচার ইত্যাদি মহাজোটের প্রতিশ্রুতি বিষয়ও নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি হতে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধরাকে জোরদার করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অঙ্গীকারের মধ্যেই পড়ে। এসব কাজে অগ্রগতি মানুষকে অবশ্যই আশান্বিত করেছে। মানুষ অনেক প্রত্যাশার কিছু হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে এটা দেখতে মানুষ স্বভাবতই খুশি হবে এবং তাদের অন্যান্য প্রত্যাশাও যে বাস্তবায়ন হবে তা মনে দৃঢ় হবে। সরকারকে তাই মানুষের অপরাপর প্রত্যাশা পূরণে দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। একটা বছর চলে গেল। দেখতে দেখতে আরও একটা বছর চলে যাবে, সুতরাং এখন শুধু কাজ। মানুষ তাকিয়ে আছে বড় আশা করে, সরকারের কাজ থেকে এই সব কাজ দেখতে। সরকারের বহু কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে বাজারের দিকে সার্বণিক দৃষ্টি দেয়া। জ্বালানির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ থাকতে হবে। বিদু্যতের বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে নিতে হবে।
বাজার আমাদের সব সময় অস্থিতিশীল। একটার দাম কমে তো আরেকটির দাম বাড়ে। একটি পণ্য যথেষ্ট পাওয়া যায় তো আরেকটি দুর্মূল্য দুর্লভ হয়ে যায়। আবার আরেকটি আশ্চর্যের কথা হচ্ছে দুর্লভ হয়নি। বাজারে সবখানে পাওয়া যাচ্ছে এমন জিনিসের দাম হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে অনেক কাঁচামালের দাম কয়েক দিন কম থাকলে দু'চার দিন পরই আবার চড়ে যাচ্ছে। যখন পর্যাপ্ত সরবরাহ তখনই এই অবস্থা। আমাদের খোলা বাজার তথা মুক্তবাজার অর্থনীতি যদি এমনি খেলা দেখাতেই থাকে তা হলে এ বাজার অবশ্যই বদলানো উচিত। এ বাজারে বিক্রেতারা যা খুশি দাম ঠিক করবেন, সেটা কেন? অনেক ব্যবসায়ীই সৎ ব্যবসা করেন এটা সব সময় স্বীকার করা হয়, তবে আমাদের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে তথা স্তরে অসাধু ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। সিন্ডিকেট কি শুধু উঁচু পর্যায়ে হয়, নিম্নপর্যায়ে হয় না? শ্যামবাজার বা কাওরান বাজার থেকে দশ টাকা দরে কোন কাঁচামাল কিনে এনে চলি্লশ টাকা দরে কেউ বিক্রি করে তাহলে সেটা দেখবে কে? মুক্তবাজার হোক আর কেতাবী যে নামই আমাদের বাজারের হোক, সব পর্যায়ে নজরদারি বা তদারকি দরকার। এখন ভরা সবজির মৌসুম? এখন প্রতিটি সবজির দাম যা হওয়া উচিত। তা কি হচ্ছে? মাছের সরবরাহ কম নয়_ তারপরও দাম চড়ছে কেন? মাংসের দাম সেই যে ঈদের আগের ঠিক করা হলো এখন কি দামে তা বিক্রি হচ্ছে সেটা দেখার কেউ কি আছে? ডিমের দাম আগের তুলনায় কমেছে বললেও এখন আরও কেন কমছে না তার উত্তর কি? বাজার সবাই করে, সবাই কিনে খায়, দাম বেশি হলে ধনীদের কষ্ট হয় না, কিন্তু দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। জনগণের বিপুল আস্থাভাজন সরকারকে সাধারণ জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে বাজারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিতে হবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট অসাধু পন্থায় বিপুল টাকা কামিয়ে নিচ্ছে_ এ ধরনের খবর মানুষ আর এখন শুনতে চায় না। মানুষ দেখতে চায় বাজারে গিয়ে স্বাভাবিক দামে সবকিছু কেনা যাচ্ছে এটাই। সে জন্যই বাজারের ব্যাপারে সরকারের সর্বণিক কঠোর তদারকি মানুষ প্রত্যাশা করে। অতীতের মতো কাজে হবে না। কতবার বলা হয়েছে বাজারে পণ্যমূল্য টাঙ্গাতে হবে। ক্রেতা চাইলে পাইকারি বাজারের ক্যাশমেমো দেখাতে হবে। এভাবে কোন লাভ হয়নি। এটা যদি করত বলা হয়, তাহলে বাজারের অবস্থা আমদানির অবস্থা দেখে কি বলা যায় না যে, অমুক পণ্যের দাম অত টাকার মধ্যে রাখতে হবে এর বেশি দাম নেয়া যাবে না! প্রয়োজনে টিসিবিকে অনেক ব্যাপকভাবে কাজে লাগান। প্রয়োজনে বাজারকে জনসাধারণের কল্যাণে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করুন।
বিদু্যতের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হয়েছে। এই েেত্র সরকার নানা পদপে নিচ্ছে বলা হচ্ছে। বিদু্যতের অবস্থা অতীতে কি হয়ছে মানুষ জানে। এখন কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদু্যত আনার কথাও বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে বিদু্যতের ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিদু্যতের ব্যবস্থা খুব সহজে হয় না, এটাও মানুষ বোঝে। সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কেও মানুষ জানে। সেজন্য মানুষ অপোও করতে চায়, সময়ও যে লাগবে সেটাও জানে। তবে কথা হচ্ছে, সরকারের বিদু্যতের উদ্যোগকে এক মুহূর্তের জন্যও শিথিল করা চলবে না। বিদু্যতের চাহিদা অনেক বেড়েছে। বিদু্যত ছাড়া জনজীবনে দুর্ভোগ সীমাহীন। বিদু্যত না হলে শিল্প হবে না, কৃষিতে সমস্যা হবে। তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিদু্যতের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। বিদু্যত উৎপাদনের সকল পন্থাকে কাজে লাগাতে হবে। সেগুলোকে সাধারণের মধ্যে সহজলভ্য করতে হবে। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যত প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা শোনা গিয়েছিল। পারমাণবিক বিদু্যত উৎপাদনের ব্যাপারে কয়েকটি দেশের কাছ থেকে সহযোগিতার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল রাশিয়া এই কাজে সাহায্য করতে চায়। এ ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু আলোচনাও হয় বলে জানা যায়। পারমাণবিক বিদু্যতের ব্যাপারেও সচেষ্ট হওয়া উচিত। তাপবিদু্যত, জলবিদু্যত, পারমাণবিক বিদু্যত, বায়ুবিদু্যত, সৌরবিদু্যত বা যে কোন পন্থাতেই হোক বিদু্যতের জন্য সরকারের উদ্যোগ অনেক বেশি বাড়াতে হবে, একটি বছর পার হয়েছে। এই দ্বিতীয় বছরে অন্তত এ ব্যাপারে আরও অনেকখানি সাফল্য তথা অগ্রগতি মানুষ দেখতে পেলে উৎসাহিত ও আশান্বিত হতে পারবে অনেক বেশি।
গ্যাসের ব্যাপারেও সেই একই কথা বলা যায়। গ্যাস, বিদু্যত ইত্যাদি পর্যাপ্ত না থাকলে জনজীবনে কষ্ট, শিল্পকারখানা হবে না, বিনিয়োগ হবে না। এখনই ঢাকার অনেক এলাকায় গ্যাসে টান পড়ছে। এই শীতেও রাজধানীর কোন কোন এলাকায় বিদু্যত থাকছে না। অনেকখানি সময় লোডশেডিং বা বিদু্যত বিভ্রাট যাই হোক_ বিদু্যতেও টান পড়ছে, গ্যাসেও পড়ছে। চেষ্টা চলছে বিদু্যতের মতো গ্যাসের ব্যাপারেও। এখন এই চেষ্টা ত্বরান্বিত করতে হবে। একটি বছর কোন দিকেই কাজ হয়নি বলা যাবে না। কৃষিতে অনেক সাফল্য এসেছে আরও সাফল্য আগামীতে আসবে সে প্রত্যাশাও সৃষ্টি হচ্ছে। এমনই সাফল্য জনজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য েেত্রও মানুষ প্রত্যাশা করে। অনেক েেত্র অতিদ্রুত ফল আসবে না এটা ঠিক, তবে দ্রুততর হচ্ছে চেষ্টা বা উদ্যোগ এটা মানুষ দেখতে চায়। এ কাজগুলো মানুষ দেখতে পেলে কোন হতাশা সৃষ্টি হবার অবকাশ থাকবে না। মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা সরকারের কাছে। সরকারও সেটা অবশ্যই বোঝে। মানুষের সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদু্যত, গ্যাস, বাজারসহ সকল েেত্র সরকারকে নতুন এই বছরটিতে কাজ করতে হবে। একটি বছর যেমন দেখতে দেখতে চলে গেল দ্বিতীয় বছরটিও তেমনি চলে যাবে একই গতিতে। এক বছরের হিসেবে প্রত্যাশা বাস্তবায়নের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পরের বছরটিতে অর্থাৎ চলতি এই বছরে সে সম্ভাবনা যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়, বিভিন্ন েেত্র মানুষ যাতে কিছু কিছু ফলও পেতে পারে সেই চেষ্টা সরকারকে এখন থেকেই করতে হবে। ফলের পরিমাণ যাই হোক না কেন ব্যাপক উদ্যোগে কাজ দেখলে আগামীতে আরও ফললাভের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে জোরদার হবে এবং মানুষ এসব কাজের যথাযথ মূল্যায়নও নিঃসন্দেহে নিজেরাই করতে পারবে, কাউকে কিছু বলে দিতে হবে না।
নতুন মহাজোট সরকার সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে কথাটি বলা যায় সেটি হচ্ছে, এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে, অর্থাৎ ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে। এই বিপুল ভোটকে সাধারণভাবে দেখলে হবে না, এই বিপুল ভোটের পেছনে রয়েছে দেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়নই সরকারের কাজ, সরকারের দায়িত্ব। নির্বাচনের আগে সরকারও তাদের ইশতেহার তথা কর্মসূচী দিয়ে মানুষের ব্যাপকতম সমর্থন পেয়েছে এবং ঐ কর্মসূচীগুলোই মানুষের মনের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলে গেছে। সেই কর্মসূচী তথা প্রত্যাশার মূল কথা হচ্ছে, নতুন ধারা, পুরনো দিনের প্রত্যাবর্তন নয়; নতুন দিন, দিনবদল। স্বাধীনতা অর্জনের পর কত দিনই তো পার হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের প্রথম তিন-সাড়ে তিন বছরের শাসনের পর অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক ধরনের শাসন বা শাসক এসেছে। সর্বশেষ দেখেছে একাধিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শেষ পর্যন্ত ভোট এবং ভোটের পর নতুন এই মহাজোট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ। এত সব দেখার পর এবার মানুষ সত্যি সত্যি পরিবর্তন চেয়েছে। সেই পুরনো কালচার থেকে দেশ বেরিয়ে এসে আর পাঁচটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের মতো সামনে ল্য নিধর্ারণ করে এগিয়ে চলেছে, এটা দেখতে চেয়েছে। নতুন আশা নিয়ে তাই তারা সমর্থন দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের দিনবদলের কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
এই এক বছরে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে নানা বিশ্লেষণ তথা মূল্যায়ন হয়েছে। কারও কারও মতে, সরকার কিছু করতে পারেনি, কোন সার্থকতা নেই তাদের। অর্থাৎ তাঁরা বলতে যাচ্ছেন, সরকারের কাজে কোন সফলতা নেই, আবার অনেকে বলছেন, সরকারের কাজকর্ম ভালভাবেই চলছে, ঠিক পথে চলছে, সরকারের কাজকর্ম এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা যথেষ্ট ভাল, ইত্যাদি। বিভিন্ন আলোচনায় বলা হচ্ছে, অতীতের কলঙ্কমোচনের কাজে অনেকখানি এগুনো সম্ভব হয়েছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে, অন্যায় করা পার পাওয়া যায় না_ এই ধারণা এখন সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি।
অতীতের জাতীয় কলঙ্কমোচন, প্রত্যেক অপরাধের আইন মাফিক বিচার এসবই জনগণের শুধু প্রত্যাশাই নয়, এগুলো দাবি। সে দাবি পূরণে কাজ হচ্ছে দেখে মানুষ খুশি হবে। মানুষ খুশি হবে এর সঙ্গে দেশে গণতান্ত্রিক সুশাসন জোরদার হলে, সুস্থ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল স্থায়ী হলে। দেশের মানুষ আর অতীতের কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে চায় না, অতীতের ধারায়ও ফিরে যেতে চায় না। সকল কলঙ্ক ও গ্লানিমোচন করে নতুনভাবে নতুন যুগে চলতে চায়। এটাই তাদের প্রত্যাশা। বিংশ শতাব্দী চলে গেছে অনেক দিন। একবিংশ শতাব্দী শুরুও হয়েছে সেও অনেক দিন হলো। এরপর দেখতে দেখতে পার হতে চলল একটি দশকও। এখন চলতে হবে নতুনভাবে, নতুন আলোকে, নতুন নতুন ল্য বাস্তবায়নের পথে মানুষ এখন কথা নয়, কাজ দেখতে চায়, অনেক কথা বহুকাল ধরে শুনেছে, এখন আর অত কথা তাদের মন ভোলায় না, বাস্তবে কাজ দেখলে তারা খুশি হয়।
১৫ আগস্ট কলঙ্কের বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বড় বড় অন্যায় অপরাধের বিচার ইত্যাদি মহাজোটের প্রতিশ্রুতি বিষয়ও নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি হতে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধরাকে জোরদার করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অঙ্গীকারের মধ্যেই পড়ে। এসব কাজে অগ্রগতি মানুষকে অবশ্যই আশান্বিত করেছে। মানুষ অনেক প্রত্যাশার কিছু হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে এটা দেখতে মানুষ স্বভাবতই খুশি হবে এবং তাদের অন্যান্য প্রত্যাশাও যে বাস্তবায়ন হবে তা মনে দৃঢ় হবে। সরকারকে তাই মানুষের অপরাপর প্রত্যাশা পূরণে দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। একটা বছর চলে গেল। দেখতে দেখতে আরও একটা বছর চলে যাবে, সুতরাং এখন শুধু কাজ। মানুষ তাকিয়ে আছে বড় আশা করে, সরকারের কাজ থেকে এই সব কাজ দেখতে। সরকারের বহু কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে বাজারের দিকে সার্বণিক দৃষ্টি দেয়া। জ্বালানির বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ থাকতে হবে। বিদু্যতের বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে নিতে হবে।
বাজার আমাদের সব সময় অস্থিতিশীল। একটার দাম কমে তো আরেকটির দাম বাড়ে। একটি পণ্য যথেষ্ট পাওয়া যায় তো আরেকটি দুর্মূল্য দুর্লভ হয়ে যায়। আবার আরেকটি আশ্চর্যের কথা হচ্ছে দুর্লভ হয়নি। বাজারে সবখানে পাওয়া যাচ্ছে এমন জিনিসের দাম হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে অনেক কাঁচামালের দাম কয়েক দিন কম থাকলে দু'চার দিন পরই আবার চড়ে যাচ্ছে। যখন পর্যাপ্ত সরবরাহ তখনই এই অবস্থা। আমাদের খোলা বাজার তথা মুক্তবাজার অর্থনীতি যদি এমনি খেলা দেখাতেই থাকে তা হলে এ বাজার অবশ্যই বদলানো উচিত। এ বাজারে বিক্রেতারা যা খুশি দাম ঠিক করবেন, সেটা কেন? অনেক ব্যবসায়ীই সৎ ব্যবসা করেন এটা সব সময় স্বীকার করা হয়, তবে আমাদের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে তথা স্তরে অসাধু ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। সিন্ডিকেট কি শুধু উঁচু পর্যায়ে হয়, নিম্নপর্যায়ে হয় না? শ্যামবাজার বা কাওরান বাজার থেকে দশ টাকা দরে কোন কাঁচামাল কিনে এনে চলি্লশ টাকা দরে কেউ বিক্রি করে তাহলে সেটা দেখবে কে? মুক্তবাজার হোক আর কেতাবী যে নামই আমাদের বাজারের হোক, সব পর্যায়ে নজরদারি বা তদারকি দরকার। এখন ভরা সবজির মৌসুম? এখন প্রতিটি সবজির দাম যা হওয়া উচিত। তা কি হচ্ছে? মাছের সরবরাহ কম নয়_ তারপরও দাম চড়ছে কেন? মাংসের দাম সেই যে ঈদের আগের ঠিক করা হলো এখন কি দামে তা বিক্রি হচ্ছে সেটা দেখার কেউ কি আছে? ডিমের দাম আগের তুলনায় কমেছে বললেও এখন আরও কেন কমছে না তার উত্তর কি? বাজার সবাই করে, সবাই কিনে খায়, দাম বেশি হলে ধনীদের কষ্ট হয় না, কিন্তু দেশের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। জনগণের বিপুল আস্থাভাজন সরকারকে সাধারণ জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে বাজারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিতে হবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেট অসাধু পন্থায় বিপুল টাকা কামিয়ে নিচ্ছে_ এ ধরনের খবর মানুষ আর এখন শুনতে চায় না। মানুষ দেখতে চায় বাজারে গিয়ে স্বাভাবিক দামে সবকিছু কেনা যাচ্ছে এটাই। সে জন্যই বাজারের ব্যাপারে সরকারের সর্বণিক কঠোর তদারকি মানুষ প্রত্যাশা করে। অতীতের মতো কাজে হবে না। কতবার বলা হয়েছে বাজারে পণ্যমূল্য টাঙ্গাতে হবে। ক্রেতা চাইলে পাইকারি বাজারের ক্যাশমেমো দেখাতে হবে। এভাবে কোন লাভ হয়নি। এটা যদি করত বলা হয়, তাহলে বাজারের অবস্থা আমদানির অবস্থা দেখে কি বলা যায় না যে, অমুক পণ্যের দাম অত টাকার মধ্যে রাখতে হবে এর বেশি দাম নেয়া যাবে না! প্রয়োজনে টিসিবিকে অনেক ব্যাপকভাবে কাজে লাগান। প্রয়োজনে বাজারকে জনসাধারণের কল্যাণে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করুন।
বিদু্যতের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হয়েছে। এই েেত্র সরকার নানা পদপে নিচ্ছে বলা হচ্ছে। বিদু্যতের অবস্থা অতীতে কি হয়ছে মানুষ জানে। এখন কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদু্যত আনার কথাও বলা হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে বিদু্যতের ব্যাপারেও বিভিন্ন সময়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিদু্যতের ব্যবস্থা খুব সহজে হয় না, এটাও মানুষ বোঝে। সরকারের আন্তরিকতা সম্পর্কেও মানুষ জানে। সেজন্য মানুষ অপোও করতে চায়, সময়ও যে লাগবে সেটাও জানে। তবে কথা হচ্ছে, সরকারের বিদু্যতের উদ্যোগকে এক মুহূর্তের জন্যও শিথিল করা চলবে না। বিদু্যতের চাহিদা অনেক বেড়েছে। বিদু্যত ছাড়া জনজীবনে দুর্ভোগ সীমাহীন। বিদু্যত না হলে শিল্প হবে না, কৃষিতে সমস্যা হবে। তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিদু্যতের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। বিদু্যত উৎপাদনের সকল পন্থাকে কাজে লাগাতে হবে। সেগুলোকে সাধারণের মধ্যে সহজলভ্য করতে হবে। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যত প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা শোনা গিয়েছিল। পারমাণবিক বিদু্যত উৎপাদনের ব্যাপারে কয়েকটি দেশের কাছ থেকে সহযোগিতার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল রাশিয়া এই কাজে সাহায্য করতে চায়। এ ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু আলোচনাও হয় বলে জানা যায়। পারমাণবিক বিদু্যতের ব্যাপারেও সচেষ্ট হওয়া উচিত। তাপবিদু্যত, জলবিদু্যত, পারমাণবিক বিদু্যত, বায়ুবিদু্যত, সৌরবিদু্যত বা যে কোন পন্থাতেই হোক বিদু্যতের জন্য সরকারের উদ্যোগ অনেক বেশি বাড়াতে হবে, একটি বছর পার হয়েছে। এই দ্বিতীয় বছরে অন্তত এ ব্যাপারে আরও অনেকখানি সাফল্য তথা অগ্রগতি মানুষ দেখতে পেলে উৎসাহিত ও আশান্বিত হতে পারবে অনেক বেশি।
গ্যাসের ব্যাপারেও সেই একই কথা বলা যায়। গ্যাস, বিদু্যত ইত্যাদি পর্যাপ্ত না থাকলে জনজীবনে কষ্ট, শিল্পকারখানা হবে না, বিনিয়োগ হবে না। এখনই ঢাকার অনেক এলাকায় গ্যাসে টান পড়ছে। এই শীতেও রাজধানীর কোন কোন এলাকায় বিদু্যত থাকছে না। অনেকখানি সময় লোডশেডিং বা বিদু্যত বিভ্রাট যাই হোক_ বিদু্যতেও টান পড়ছে, গ্যাসেও পড়ছে। চেষ্টা চলছে বিদু্যতের মতো গ্যাসের ব্যাপারেও। এখন এই চেষ্টা ত্বরান্বিত করতে হবে। একটি বছর কোন দিকেই কাজ হয়নি বলা যাবে না। কৃষিতে অনেক সাফল্য এসেছে আরও সাফল্য আগামীতে আসবে সে প্রত্যাশাও সৃষ্টি হচ্ছে। এমনই সাফল্য জনজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য েেত্রও মানুষ প্রত্যাশা করে। অনেক েেত্র অতিদ্রুত ফল আসবে না এটা ঠিক, তবে দ্রুততর হচ্ছে চেষ্টা বা উদ্যোগ এটা মানুষ দেখতে চায়। এ কাজগুলো মানুষ দেখতে পেলে কোন হতাশা সৃষ্টি হবার অবকাশ থাকবে না। মানুষের অনেক বেশি প্রত্যাশা সরকারের কাছে। সরকারও সেটা অবশ্যই বোঝে। মানুষের সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদু্যত, গ্যাস, বাজারসহ সকল েেত্র সরকারকে নতুন এই বছরটিতে কাজ করতে হবে। একটি বছর যেমন দেখতে দেখতে চলে গেল দ্বিতীয় বছরটিও তেমনি চলে যাবে একই গতিতে। এক বছরের হিসেবে প্রত্যাশা বাস্তবায়নের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পরের বছরটিতে অর্থাৎ চলতি এই বছরে সে সম্ভাবনা যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়, বিভিন্ন েেত্র মানুষ যাতে কিছু কিছু ফলও পেতে পারে সেই চেষ্টা সরকারকে এখন থেকেই করতে হবে। ফলের পরিমাণ যাই হোক না কেন ব্যাপক উদ্যোগে কাজ দেখলে আগামীতে আরও ফললাভের প্রত্যাশা মানুষের মধ্যে জোরদার হবে এবং মানুষ এসব কাজের যথাযথ মূল্যায়নও নিঃসন্দেহে নিজেরাই করতে পারবে, কাউকে কিছু বলে দিতে হবে না।
No comments