সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ

ষাট-সত্তরের দশকেও গ্রামবাংলায় দেশীয় সংস্কৃতির নানা রকম আয়োজন হতো। নাটক, যাত্রাপালা, সার্কাস, কবিগান ও জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের প্রতিযোগিতা, পুঁথিপাঠ, এমনকি গল্প বলারও প্রতিযোগিতা হতো। গ্রামের স্কুলগুলোতেও বছরে একবার বিচিত্রানুষ্ঠান হতো।


গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, কৌতুক প্রদর্শন, বিজ্ঞানমেলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, অনেক স্কুলে বছরে একবার ছাত্রদের অংশগ্রহণে নাটকও হতো। গ্রামবাংলা থেকে সংস্কৃতির এ সমৃদ্ধ ভাণ্ডার মাত্র কয়েক দশকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছে। এ হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে পুনরায় উজ্জীবিত করার জন্য বর্তমান সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগই বলতে হবে।
কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বা পুঁথিগত শিক্ষা নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তথা সুস্থ জাতি গঠন করতে পারে না। মানুষের মধ্যকার সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশ যত বেশি হবে, জাতি হিসেবে আমরা তত বেশি এগিয়ে যাব। শহরভিত্তিক এ জাতীয় কিছু কর্মকাণ্ড দেখা গেলেও দেশের বিচারে তা নিতান্তই সামান্য। কারণ এখনো বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। সেই ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন প্রায় অনুপস্থিত। তাদের জন্য সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করা এবং শিশু-কিশোরদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ছাড়া দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকারগুলোও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে না।
অন্যদিকে গ্রামবাংলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তথা সুস্থ বিনোদনের সুযোগ যত কমতে থাকে, অপরাধপ্রবণতা তত বাড়তে থাকে_যার প্রমাণ আমরা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করছি। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-মাদকাসক্তি এখন গ্রামগঞ্জের নিত্য অনুষঙ্গ। বিগত জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছিল, তা-ও সম্ভব হয়েছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে জাতিকে দূরে রাখার কারণে। আমরা যদি আরেকটু পেছনে তাকাই তাহলে দেখব, তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারও সবচেয়ে বেশি ভয় পেত বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে। তাই তারা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য নানা ধরনের চক্রান্ত করেছিল। যত বেশি চক্রান্ত হয়েছে, বাঙালি তত বেশি আঁকড়ে ধরেছে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে। আর তারই ফলস্বরূপ পাকিস্তানিদের বিদায় নিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে এসেছিল। তাই তারাও পরিকল্পিতভাবেই দেশের সংস্কৃতি ধ্বংসের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই যে স্বাধীনতার সুফল পেতে হলে আমাদের হারানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটি কেবল নগরভিত্তিক নয়, সেটি হতে হবে গোটা বাংলাদেশভিত্তিক। এ ছাড়া আগামী দিনের নাগরিক যারা, সেই শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সুকুমারবৃত্তি বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলেই তারা কেবল প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এ কারণে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি সুকুমারবৃত্তির চর্চা অনেকগুণ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাঙালির চিরন্তন সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ গড়তে পারলেই কেবল আমরা জাতি হিসেবে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব, অন্যথায় নয়।

No comments

Powered by Blogger.