সরকারী কলেজের হাল ॥ শিক্ষক সঙ্কট- ০ ২৫১ কলেজে সাড়ে তিন হাজার পদ শূন্য দীর্ঘদিন- ০ নেই স্বতন্ত্র পরীক্ষার হল ॥ অবকাঠামোর অভাব- ০ কোন কোন কলেজের পুরো বিভাগ চলে একজন শিক্ষক দিয়ে- ০ পাহাড়প্রমাণ সমস্যা নিয়ে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে ঢাকার দশ কলেজ by বিভাষ বাড়ৈ
চরম শিক্ষক সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের সরকারী কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। ২৫১ সরকারী কলেজে পড়ে আছে সাড়ে তিন হাজার শূন্যপদ। অথচ নিয়মের অর্ধেক শিক্ষকও নেই কোন কলেজে। বিধান অনুসারে ৪৫ শিক্ষার্থীর জন্য একজন তো দূরের কথা অনেক কলেজে ১শ’ থেকে ১শ’ ৫০ শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী আছে ৪৫ হাজার পর্যন্ত।
অথচ শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১ অর্থাৎ প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকবেন। চলমান আইনেও বলা আছে, কোন বিষয়ে ডিগ্রী (পাস) ও অনার্স থাকলে ১০ জন এবং মাস্টার্স কোর্স হলে শিক্ষক থাকতে হবে ১২ জন। শিক্ষক সঙ্কটের সঙ্গে আছে অবকাঠামোর অভাব ও স্বতন্ত্র পরীক্ষার হল না থাকার মহাসঙ্কট। উপজেলা পর্যায়ে অনেক কলেজে একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে পুরো বিভাগ। এদিকে সমস্যার পাহাড় নিয়ে ধুঁকছে রাজধানী ঢাকার ১০ সরকারী কলেজ। শিক্ষক সঙ্কটে একাডেমিক কার্যক্রম হোঁচট খাচ্ছে। আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে ঢাকায় চাকরি করছেন। ফলে প্রকৃত ও মেধাবী শিক্ষকরা ঢাকায় আসতে পারছেন না।
জানা গেছে, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে সরকারী কলেজের বেহালদশা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে একাধিকবার বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে সঙ্কট কাটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। চলমান সঙ্কটকে ‘পাঠদান কষ্টসাধ্য’ বলে মন্তব্য করে দ্রুত সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করলেও কোন ফল হচ্ছে না। এই মুহূর্তে অধিদফতরের কাছে সাড়ে তিন হাজার শূন্যপদের তালিকা আছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে উপজেলা পর্যায়ে অনেক কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিভাগ চলছে। একজন শিক্ষকই উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী, অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমস্যার পাহাড় নিয়ে ধুঁকছে ঢাকার ১০টি সরকারী কলেজ। শিক্ষক সঙ্কটে একাডেমিক কার্যক্রম হোঁচট খাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে ঢাকায় চাকরি করছেন। ফলে প্রকৃত ও মেধাবী শিক্ষকরা ঢাকায় আসতে পারছেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা শহরে মোট ১০টি সরকারী কলেজ ও একটি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন সরকারী মহিলা কলেজ, সরকারী তিতুমীর কলেজ, সরকারী বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারী কলেজ, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজ, গার্হস্থ্য সরকারী কলেজ, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ এবং সরকারী সঙ্গীত কলেজ। এছাড়া রয়েছে সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা-ঢাকা। ১১ প্রতিষ্ঠানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় এক হাজার ৮শ’ শিক্ষক আছেন। ছাত্রছাত্রী অন্তত দেড় লাখ। শিক্ষার্থীর হার অনুপাতে যে সংখ্যক শিক্ষক থাকার কথা, এখানে তার লেশমাত্রও নেই। অনেক কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে খ-কালীন (পার্ট টাইম) শিক্ষক দিয়ে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষক সঙ্কটের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীর সরকারী তিতুমীর কলেজে। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের অন্যতম বড় এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪৫ হাজারেরও বেশি। কলেজটিতে অনার্স ও মাস্টার্র্স কোর্স চালু রয়েছে ১৯টি বিভাগে। অথচ এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮২। এদের মধ্যে আবার ওএসডি হয়ে সংযুক্ত রয়েছেন অনেকে। অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. দিলারা হাফিজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ক্লাসরুম স্বল্পতা, শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কটসহ অন্যান্য অবকাঠামো সঙ্কটও চরম আকার ধারণ করেছে। ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮২। শিক্ষক খুব জরুরী। আমরা শিক্ষক ও শিক্ষকের পদ চেয়েছি।
জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ১২ জন শিক্ষক নেই এই কলেজের কোন বিভাগেই। মাত্র ৩ থেকে ৫ জন শিক্ষক নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, ইসলামী শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ। এই কলেজে নতুন সৃষ্টি করা ফিন্যান্স বিভাগে কোন স্থায়ী শিক্ষকের পদ না থাকায় চলছে অতিথি শিক্ষক দিয়ে। দু’জন ভাড়া করা শিক্ষক বাদ দিলে মার্কেটিং বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ২৪১ জন। আর মাউশিতে ওএসডি হয়ে এ কলেজে সংযুক্ত আছেন আরও ৩৬ জন। শিক্ষক সঙ্কট থাকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ বিভাগে রাখা হয়েছে পার্টটাইম ভাড়া করা শিক্ষক। অধিকাংশ বিভাগ চালানো হচ্ছে মাত্র ৫ শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষকরা বললেন, কয়েক হাজার শিক্ষকের ভার পড়েছে কয়েক শিক্ষকের কাঁধে। শিক্ষক সঙ্কটের কারণে একই শিক্ষককে উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্রদের ক্লাস নিতে হয়। এ কলেজে অনেক বিভাগ আছে, যেসব বিভাগের নিজেদের শ্রেণীকক্ষই নেই। ছাত্রদের নিয়মিত খোঁজ রাখতে হয় কোন শ্রেণীকক্ষ খালি আছে। দেশের নারী শিক্ষায় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রী ৩২ হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৬৫। সংযুক্ত ২৬। ২২ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স থাকা এই কলেজেও চলছে শিক্ষক সঙ্কট। কলেজের শিক্ষকরা জানালেন, শিক্ষক সঙ্কটের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে অবহিত করেছি। আশা করছি খুব দ্রুতই শিক্ষক সঙ্কট দূর হবে। মিরপুরের সরকারী বাংলা কলেজে শিক্ষার্থী ২৩ হাজার। অথচ তাদের শিক্ষক রয়েছেন ১৩২। সংযুক্ত আছেন ১৬ জন। পুরনো ঢাকার সরকারী কবি নজরুল কলেজে ১৩ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৮৫। ১৭ বিষয়ে অনার্স ও ৫ বিষয়ে মাস্টার্স থাকা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান এখানকার শিক্ষার্থীরা। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজে ১১ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিপরীতে শিক্ষক ৮৬। সরকারী গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজে আড়াই হাজার ছাত্রীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ৫৯। সংযুক্ত আছেন দু’জন। সরকারী বিজ্ঞান কলেজে দেড় হাজার ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন মাত্র ৩৪ শিক্ষক। এ কলেজে ওএসডি সংযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা ৬। ঢাকার পাশেই টঙ্গী সরকারী কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ৬২। এর মধ্যে সংযুক্ত পাঁচজন। অন্যদিকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই বলতে গেলে কোন শ্রেণী কক্ষই। তিন-চারটি শ্রেণীকক্ষে চলছে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর কাজ। নেই পরীক্ষার হল। অধ্যক্ষ অধ্যাপক এবিএম আফাজউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা শিক্ষক চাই। কাজ হচ্ছে না। শ্রেণীকক্ষের সমস্যা আমাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে নাটোর গোল-ই আফরোজ সরকারী কলেজে ৯ বিষয়ে কোন শিক্ষকই নেই। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকবিহীন চলছে। সাতক্ষীরার তালা সরকারী কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে গত পাঁচ বছর ধরে কোন শিক্ষক নেই। গণিতে কোন শিক্ষক নেই আড়াই বছর ধরে। নোয়াখালী সেনবাগ সরকারী ডিগ্রী কলেজে বাংলা ও ইংরেজী বিষয়ে কোন শিক্ষক নেই। নাটোরের নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারী কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে মাত্র দু’জন শিক্ষক একই সঙ্গে অনার্সের ৪৮০, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর প্রায় ৬শ’ জন ও বিএসসি পাস কোর্সে এবং এমএসসির ৩শ’ ছাত্রছাত্রীর ক্লাস নেন। একজন মাত্র পিয়ন ছাড়া কোন কর্মচারী না থাকায় এ বিভাগের ভর্তি কার্যক্রম, পরীক্ষার ফরমফিলাপ ও লাইব্রেরি পরিচালনা সব কাজই এই দু’জন শিক্ষককে করতে হয়। হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ বৃন্দাবন সরকারী কলেজে অনার্স কোর্স পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী কলেজটিতে ৮৭ শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও শিক্ষক আছেন ৪২। রসায়ন বিষয়ে শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজে ৮শ’ ছাত্রীর জন্য মাত্র একজন ইংরেজী শিক্ষক রয়েছেন। মাঝে মধ্যে বাংলা বা আরবী শিক্ষক দিয়ে কোন রকমে চালানো হয় ইংরেজী ক্লাস।
এদিকে পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। সমস্যা চিহ্নিত ও দূরীকরণে গঠিত সাব-কমিটির প্রতিবেদনেও বেরিয়ে এসেছে এসব জটিলতার চিত্র। সঙ্কট সমাধানে কমিটি নিয়মিত বা প্রয়োজনের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে শূন্যপদ পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপাারিশ করেছে। এছাড়া সঙ্কট সমাধানের পদ সৃষ্টি, বদলি ও প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে তারও সমাধানের সুপারিশ করেছে কমিটি। কমিটি বলেছে, ৪/৫ শিক্ষক নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক, তিন বছরের ডিগ্রী (পাস) কোর্স, চার বছরের অনার্স এবং মাস্টার্সের পাঠদান দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, হ্যাঁ, শিক্ষক সঙ্কট একটা বড় সমস্যা। আবার যাঁরা আছেন তাঁদেরও অনেকেই নিয়মিত ক্লাসে যান না। সব মিলিয়ে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সরকার শিক্ষার স্বার্থেই সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে চায়। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। সঙ্কটের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মোঃ নোমান-উর রশিদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটি গুরুতর একটি সঙ্কট। এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দ্রুত এই সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ স্পেশাল বিসিএস পরীক্ষা। জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিকবার বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে সঙ্কট কাটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আজও সফল হয়নি।
জানা গেছে, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে সরকারী কলেজের বেহালদশা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে একাধিকবার বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে সঙ্কট কাটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। চলমান সঙ্কটকে ‘পাঠদান কষ্টসাধ্য’ বলে মন্তব্য করে দ্রুত সমস্যা সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করলেও কোন ফল হচ্ছে না। এই মুহূর্তে অধিদফতরের কাছে সাড়ে তিন হাজার শূন্যপদের তালিকা আছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এই মুহূর্তে উপজেলা পর্যায়ে অনেক কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিভাগ চলছে। একজন শিক্ষকই উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী, অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমস্যার পাহাড় নিয়ে ধুঁকছে ঢাকার ১০টি সরকারী কলেজ। শিক্ষক সঙ্কটে একাডেমিক কার্যক্রম হোঁচট খাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে ঢাকায় চাকরি করছেন। ফলে প্রকৃত ও মেধাবী শিক্ষকরা ঢাকায় আসতে পারছেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা শহরে মোট ১০টি সরকারী কলেজ ও একটি আলিয়া মাদ্রাসা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন সরকারী মহিলা কলেজ, সরকারী তিতুমীর কলেজ, সরকারী বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারী কলেজ, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজ, গার্হস্থ্য সরকারী কলেজ, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ এবং সরকারী সঙ্গীত কলেজ। এছাড়া রয়েছে সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা-ঢাকা। ১১ প্রতিষ্ঠানে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় এক হাজার ৮শ’ শিক্ষক আছেন। ছাত্রছাত্রী অন্তত দেড় লাখ। শিক্ষার্থীর হার অনুপাতে যে সংখ্যক শিক্ষক থাকার কথা, এখানে তার লেশমাত্রও নেই। অনেক কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে খ-কালীন (পার্ট টাইম) শিক্ষক দিয়ে। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষক সঙ্কটের সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীর সরকারী তিতুমীর কলেজে। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের অন্যতম বড় এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪৫ হাজারেরও বেশি। কলেজটিতে অনার্স ও মাস্টার্র্স কোর্স চালু রয়েছে ১৯টি বিভাগে। অথচ এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮২। এদের মধ্যে আবার ওএসডি হয়ে সংযুক্ত রয়েছেন অনেকে। অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. দিলারা হাফিজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ক্লাসরুম স্বল্পতা, শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কটসহ অন্যান্য অবকাঠামো সঙ্কটও চরম আকার ধারণ করেছে। ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ১৮২। শিক্ষক খুব জরুরী। আমরা শিক্ষক ও শিক্ষকের পদ চেয়েছি।
জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ১২ জন শিক্ষক নেই এই কলেজের কোন বিভাগেই। মাত্র ৩ থেকে ৫ জন শিক্ষক নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, ইসলামী শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ। এই কলেজে নতুন সৃষ্টি করা ফিন্যান্স বিভাগে কোন স্থায়ী শিক্ষকের পদ না থাকায় চলছে অতিথি শিক্ষক দিয়ে। দু’জন ভাড়া করা শিক্ষক বাদ দিলে মার্কেটিং বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ২৪১ জন। আর মাউশিতে ওএসডি হয়ে এ কলেজে সংযুক্ত আছেন আরও ৩৬ জন। শিক্ষক সঙ্কট থাকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ বিভাগে রাখা হয়েছে পার্টটাইম ভাড়া করা শিক্ষক। অধিকাংশ বিভাগ চালানো হচ্ছে মাত্র ৫ শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষকরা বললেন, কয়েক হাজার শিক্ষকের ভার পড়েছে কয়েক শিক্ষকের কাঁধে। শিক্ষক সঙ্কটের কারণে একই শিক্ষককে উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্রদের ক্লাস নিতে হয়। এ কলেজে অনেক বিভাগ আছে, যেসব বিভাগের নিজেদের শ্রেণীকক্ষই নেই। ছাত্রদের নিয়মিত খোঁজ রাখতে হয় কোন শ্রেণীকক্ষ খালি আছে। দেশের নারী শিক্ষায় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রী ৩২ হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৬৫। সংযুক্ত ২৬। ২২ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স থাকা এই কলেজেও চলছে শিক্ষক সঙ্কট। কলেজের শিক্ষকরা জানালেন, শিক্ষক সঙ্কটের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে অবহিত করেছি। আশা করছি খুব দ্রুতই শিক্ষক সঙ্কট দূর হবে। মিরপুরের সরকারী বাংলা কলেজে শিক্ষার্থী ২৩ হাজার। অথচ তাদের শিক্ষক রয়েছেন ১৩২। সংযুক্ত আছেন ১৬ জন। পুরনো ঢাকার সরকারী কবি নজরুল কলেজে ১৩ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৮৫। ১৭ বিষয়ে অনার্স ও ৫ বিষয়ে মাস্টার্স থাকা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান এখানকার শিক্ষার্থীরা। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজে ১১ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিপরীতে শিক্ষক ৮৬। সরকারী গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজে আড়াই হাজার ছাত্রীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ৫৯। সংযুক্ত আছেন দু’জন। সরকারী বিজ্ঞান কলেজে দেড় হাজার ছাত্রছাত্রীকে পড়াচ্ছেন মাত্র ৩৪ শিক্ষক। এ কলেজে ওএসডি সংযুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা ৬। ঢাকার পাশেই টঙ্গী সরকারী কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ৬২। এর মধ্যে সংযুক্ত পাঁচজন। অন্যদিকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই বলতে গেলে কোন শ্রেণী কক্ষই। তিন-চারটি শ্রেণীকক্ষে চলছে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর কাজ। নেই পরীক্ষার হল। অধ্যক্ষ অধ্যাপক এবিএম আফাজউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা শিক্ষক চাই। কাজ হচ্ছে না। শ্রেণীকক্ষের সমস্যা আমাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে নাটোর গোল-ই আফরোজ সরকারী কলেজে ৯ বিষয়ে কোন শিক্ষকই নেই। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষকবিহীন চলছে। সাতক্ষীরার তালা সরকারী কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে গত পাঁচ বছর ধরে কোন শিক্ষক নেই। গণিতে কোন শিক্ষক নেই আড়াই বছর ধরে। নোয়াখালী সেনবাগ সরকারী ডিগ্রী কলেজে বাংলা ও ইংরেজী বিষয়ে কোন শিক্ষক নেই। নাটোরের নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা সরকারী কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে মাত্র দু’জন শিক্ষক একই সঙ্গে অনার্সের ৪৮০, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর প্রায় ৬শ’ জন ও বিএসসি পাস কোর্সে এবং এমএসসির ৩শ’ ছাত্রছাত্রীর ক্লাস নেন। একজন মাত্র পিয়ন ছাড়া কোন কর্মচারী না থাকায় এ বিভাগের ভর্তি কার্যক্রম, পরীক্ষার ফরমফিলাপ ও লাইব্রেরি পরিচালনা সব কাজই এই দু’জন শিক্ষককে করতে হয়। হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ বৃন্দাবন সরকারী কলেজে অনার্স কোর্স পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী কলেজটিতে ৮৭ শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও শিক্ষক আছেন ৪২। রসায়ন বিষয়ে শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজে ৮শ’ ছাত্রীর জন্য মাত্র একজন ইংরেজী শিক্ষক রয়েছেন। মাঝে মধ্যে বাংলা বা আরবী শিক্ষক দিয়ে কোন রকমে চালানো হয় ইংরেজী ক্লাস।
এদিকে পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। সমস্যা চিহ্নিত ও দূরীকরণে গঠিত সাব-কমিটির প্রতিবেদনেও বেরিয়ে এসেছে এসব জটিলতার চিত্র। সঙ্কট সমাধানে কমিটি নিয়মিত বা প্রয়োজনের বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে শূন্যপদ পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপাারিশ করেছে। এছাড়া সঙ্কট সমাধানের পদ সৃষ্টি, বদলি ও প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলে তারও সমাধানের সুপারিশ করেছে কমিটি। কমিটি বলেছে, ৪/৫ শিক্ষক নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক, তিন বছরের ডিগ্রী (পাস) কোর্স, চার বছরের অনার্স এবং মাস্টার্সের পাঠদান দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, হ্যাঁ, শিক্ষক সঙ্কট একটা বড় সমস্যা। আবার যাঁরা আছেন তাঁদেরও অনেকেই নিয়মিত ক্লাসে যান না। সব মিলিয়ে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সরকার শিক্ষার স্বার্থেই সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে চায়। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। সঙ্কটের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মোঃ নোমান-উর রশিদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটি গুরুতর একটি সঙ্কট। এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দ্রুত এই সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র পথ স্পেশাল বিসিএস পরীক্ষা। জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিকবার বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে সঙ্কট কাটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আজও সফল হয়নি।
No comments