রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন প্রণব মুখার্জি মমতা নাখোশ by তরুণ গাঙ্গুলী
প্রণব মুখার্জি আমাকে একবার বলেছিলেন, বাঙালি হচ্ছে কাঁকড়ার মতো। আপনি যদি একটি পাত্রে কিছু কাঁকড়া রাখেন, সেই পাত্রটির ঢাকনা যদি কোনো কারণে আপনি বন্ধ না করেন, তাহলে দেখবেন কাঁকড়াগুলো কিভাবে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
কোনোভাবে যদি একটি কাঁকড়া পাত্রের গা বেয়ে কিছুটা ওপরে উঠতে পারে, তাহলে তো কথাই নেই! বাকি কাঁকড়াগুলো তার পা জড়িয়ে ধরবে। সে যাতে ওপরে উঠতে না পারে সেই চেষ্টা করবে ওরা। এত দিন পর প্রণব মুখার্জির সেই গল্পটির কথা মনে পড়ছে। সেই উদাহরণটি কি না আজ প্রণবের বেলাতেই প্রযোজ্য হয়ে গেল।
প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য প্রস্তাব করা হলে মমতা ব্যানার্জি খুব একটা খুশি হতে পারেননি। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণবের নাম উচ্চারণই করলেন না। দেখেশুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তিনি এর বিরোধিতাই করছেন। বলা দরকার, এটা তাঁর ব্যক্তিগত অপছন্দেরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য। তবে দুজনের মধ্যে শালীনতাবোধও দেখার মতো। কেউ কারো বিরুদ্ধে কটু কথা বলছেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্কও খারাপ না দুজনের মধ্যে। তবে প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে তিনি কোনো প্রশংসাসূচক বক্তব্যও দিলেন না। আর এই প্রণব মুখার্জিই ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন মমতার জন্য। মমতা একবারের জন্যও ভুলতে পারলেন না বেঙ্গল ইয়ুথ কংগ্রেসের সভাপতি মনোনয়নের বিষয়টি। মমতা হবেন যুব কংগ্রেসের সভাপতি, এমন প্রস্তাবকে মেনে নেননি প্রণব। কিন্তু তিনি যখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন, তখন তাঁকে বলতে শোনা গেছে, প্রণব মুখার্জি বিভিন্ন উপলক্ষে প্রাণবন্ত আচরণ করেছেন।
আবার মমতার দৃষ্টিতেই পড়ল, প্রণব মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ সুবিধা না দিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। আর তাঁর এ অবস্থান মমতাকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল।
মমতা প্রণবকে বিশ্বাস করেন না- এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্টবাদী। আবার তিনি যে প্রতিহিংসাপরায়ণ তাও সত্যি। কারো স্বার্থ উদ্ধারে যদি কেউ তাঁকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে তিনি সেই ব্যক্তিকে কখনো ভুলতে পারেন না। প্রণবের প্রতি তাঁর বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সেই পথ ধরেই এসেছে।
প্রণব মুখার্জির জেদ কিংবা ইচ্ছা বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কেও অনেকেই জানে না। তাঁর বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে। আবার ঈর্ষাকাতরতামুক্ত বলেও তাঁকে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে বরকতের (গনি খান চৌধুরী) কিছু উক্তিও আমার মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন, বরকতের বেশ কিছু প্রকল্প বন্ধ করে দিতে চাইতেন প্রণব। এর পেছনে ছিল ব্যক্তিগত ঈর্ষাকাতরতা। দুজনের সঙ্গেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইন্দিরা গান্ধী পরিকল্পনার জন্য নির্ভর করতেন প্রণবের ওপর। আর কাজের জন্য নির্ভর করতেন বরকতের ওপর।
আমি প্রণবকে প্রথম দেখি ১৯৬০ সালের দিকে। তখন তিনি ছিলেন বাংলা কংগ্রেসের দপ্তর সম্পাদক। দেখতে ছিলেন একেবারে সাদামাটা। কিন্তু তিনি যখন দিল্লি যেতেন তখন তাঁর মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ত। তখন তাঁকে পাইপে ধূমপান করতে দেখা যেত। এই যে খাপ খাইয়ে নেওয়া কিংবা নিজের অবস্থান ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা, এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দক্ষ।
প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত মেধাবী। মনে রাখার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ। তবে তাঁর মধ্যে এক ধরনের হতাশাও আছে। যেমন তাঁর কিছু কথা আমার মনে আছে। তিনি একবার বলছিলেন, আমি তো বাঙালি, আমাকে কেন প্রধানমন্ত্রী করা হবে। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সামনাসামনি কোনো বিভেদ হয়নি আমার। তবে তাঁর সম্পর্কে একবার আমি লিখেছিলাম, তিনি চলমান পাথরের মতো। তাঁর গায়ে সে কারণে শ্যাওলা পড়ার সুযোগ নেই। আমার মন্তব্যকে তিনি মোটেও পছন্দ করতে পারেননি। আমি তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে আরেকটি সমালোচনামূলক লেখা লিখেছিলাম। তাঁর স্ত্রী ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন। সেই ভ্রমণের ব্যয় বহন করেছিল সরকার। আমার লেখার বিষয় ছিল সেটি।
১৯৯৫ সালের কথা। একই উড়োজাহাজে আমরা ভ্রমণ করছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না। আমার কন্যা তখন সন্তান প্রসবপরবর্তী কিছু জটিলতায় মারাত্মকভাবে অসুস্থ ছিল। আমি ছিলাম খুবই উদ্বিগ্ন। আমাদের উভয়েরই এক বন্ধুও ছিলেন সেই ফ্লাইটে। তিনি জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার, এমন চুপচাপ কেন? আমি তাঁকে আমার অবস্থাটা খুলে বলি। তিনি প্রণব মুখার্জিকে গিয়ে আমার কথা বলেছিলেন। প্রণব বলেছিলেন, তাঁর কন্যাও আমার কন্যাকে খুব পছন্দ করে। তবে আমার কন্যার সুচিকিৎসার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন।
দিল্লির সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে আমার মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত দক্ষ একজন সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে আমার মেয়ে ওখানে যথেষ্ট ভালো চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। সংগত কারণেই আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
লেখক : দ্য টেলিগ্রাফের সাবেক
ব্যুরো প্রধান
আউটলুক ইন্ডিয়া থেকে
ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য প্রস্তাব করা হলে মমতা ব্যানার্জি খুব একটা খুশি হতে পারেননি। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণবের নাম উচ্চারণই করলেন না। দেখেশুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তিনি এর বিরোধিতাই করছেন। বলা দরকার, এটা তাঁর ব্যক্তিগত অপছন্দেরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য। তবে দুজনের মধ্যে শালীনতাবোধও দেখার মতো। কেউ কারো বিরুদ্ধে কটু কথা বলছেন না। ব্যক্তিগত সম্পর্কও খারাপ না দুজনের মধ্যে। তবে প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে তিনি কোনো প্রশংসাসূচক বক্তব্যও দিলেন না। আর এই প্রণব মুখার্জিই ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছিলেন মমতার জন্য। মমতা একবারের জন্যও ভুলতে পারলেন না বেঙ্গল ইয়ুথ কংগ্রেসের সভাপতি মনোনয়নের বিষয়টি। মমতা হবেন যুব কংগ্রেসের সভাপতি, এমন প্রস্তাবকে মেনে নেননি প্রণব। কিন্তু তিনি যখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন, তখন তাঁকে বলতে শোনা গেছে, প্রণব মুখার্জি বিভিন্ন উপলক্ষে প্রাণবন্ত আচরণ করেছেন।
আবার মমতার দৃষ্টিতেই পড়ল, প্রণব মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ সুবিধা না দিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। আর তাঁর এ অবস্থান মমতাকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল।
মমতা প্রণবকে বিশ্বাস করেন না- এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্টবাদী। আবার তিনি যে প্রতিহিংসাপরায়ণ তাও সত্যি। কারো স্বার্থ উদ্ধারে যদি কেউ তাঁকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে তিনি সেই ব্যক্তিকে কখনো ভুলতে পারেন না। প্রণবের প্রতি তাঁর বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সেই পথ ধরেই এসেছে।
প্রণব মুখার্জির জেদ কিংবা ইচ্ছা বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কেও অনেকেই জানে না। তাঁর বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে। আবার ঈর্ষাকাতরতামুক্ত বলেও তাঁকে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে বরকতের (গনি খান চৌধুরী) কিছু উক্তিও আমার মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন, বরকতের বেশ কিছু প্রকল্প বন্ধ করে দিতে চাইতেন প্রণব। এর পেছনে ছিল ব্যক্তিগত ঈর্ষাকাতরতা। দুজনের সঙ্গেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইন্দিরা গান্ধী পরিকল্পনার জন্য নির্ভর করতেন প্রণবের ওপর। আর কাজের জন্য নির্ভর করতেন বরকতের ওপর।
আমি প্রণবকে প্রথম দেখি ১৯৬০ সালের দিকে। তখন তিনি ছিলেন বাংলা কংগ্রেসের দপ্তর সম্পাদক। দেখতে ছিলেন একেবারে সাদামাটা। কিন্তু তিনি যখন দিল্লি যেতেন তখন তাঁর মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ত। তখন তাঁকে পাইপে ধূমপান করতে দেখা যেত। এই যে খাপ খাইয়ে নেওয়া কিংবা নিজের অবস্থান ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা, এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দক্ষ।
প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত মেধাবী। মনে রাখার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ। তবে তাঁর মধ্যে এক ধরনের হতাশাও আছে। যেমন তাঁর কিছু কথা আমার মনে আছে। তিনি একবার বলছিলেন, আমি তো বাঙালি, আমাকে কেন প্রধানমন্ত্রী করা হবে। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সামনাসামনি কোনো বিভেদ হয়নি আমার। তবে তাঁর সম্পর্কে একবার আমি লিখেছিলাম, তিনি চলমান পাথরের মতো। তাঁর গায়ে সে কারণে শ্যাওলা পড়ার সুযোগ নেই। আমার মন্তব্যকে তিনি মোটেও পছন্দ করতে পারেননি। আমি তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে আরেকটি সমালোচনামূলক লেখা লিখেছিলাম। তাঁর স্ত্রী ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন। সেই ভ্রমণের ব্যয় বহন করেছিল সরকার। আমার লেখার বিষয় ছিল সেটি।
১৯৯৫ সালের কথা। একই উড়োজাহাজে আমরা ভ্রমণ করছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না। আমার কন্যা তখন সন্তান প্রসবপরবর্তী কিছু জটিলতায় মারাত্মকভাবে অসুস্থ ছিল। আমি ছিলাম খুবই উদ্বিগ্ন। আমাদের উভয়েরই এক বন্ধুও ছিলেন সেই ফ্লাইটে। তিনি জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার, এমন চুপচাপ কেন? আমি তাঁকে আমার অবস্থাটা খুলে বলি। তিনি প্রণব মুখার্জিকে গিয়ে আমার কথা বলেছিলেন। প্রণব বলেছিলেন, তাঁর কন্যাও আমার কন্যাকে খুব পছন্দ করে। তবে আমার কন্যার সুচিকিৎসার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন।
দিল্লির সবচেয়ে ভালো হাসপাতালে আমার মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত দক্ষ একজন সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে আমার মেয়ে ওখানে যথেষ্ট ভালো চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। সংগত কারণেই আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
লেখক : দ্য টেলিগ্রাফের সাবেক
ব্যুরো প্রধান
আউটলুক ইন্ডিয়া থেকে
ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন
No comments