নিত্যজাতম্-গোল্ডেন মোল টিকে আছে সরকারের কথা জানি না by মহসীন হাবিব
রহস্যে পরিপূর্ণ এ দুনিয়ায় দেখতে ছোট সাইজের ইঁদুরের মতো একটি প্রাণী আছে, যার ইংরেজি নাম গোল্ডেন মোল। এই গোল্ডেন মোল জীবজগতের একমাত্র প্রাণী (পোকামাকড় ছাড়া), যার কোনো চোখ নেই এবং কানেও শোনে না। কানের দুটো অতি ছোট ছিদ্র আছে বটে, কিন্তু তা কোনো কাজে আসে না।
অবাক করা বিষয় হলো, আগে একসময় এই প্রাণীটির চোখ ছিল এবং কানেও শুনত। কিন্তু কালের বিবর্তনে গোল্ডেন মোলের চোখ ধীরে ধীরে বুজে গেছে। চোখ ও কানের স্থানে ঘন পশম তৈরি হয়েছে। এখন আর বোঝার উপায় নেই যে এই প্রাণীটির কখনো চোখ ছিল (বাদুড় কিন্তু অন্ধ নয়, বাদুড়ের চোখ আছে, তবে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ)।
বিবর্তনের কারণে চোখ ও কানের মতো অপরিহার্য অঙ্গ উধাও হয়ে গেলেও ক্ষুধা তো আর উধাও হয়ে যায়নি। খাবার সন্ধান করে খেতে হয়। তাও আবার ঘাস-পাতা নয়, সচল পোকামাকড় ধরে খেতে হয়। সেটা কী করে সম্ভব? হুম, সম্ভব। গোল্ডেন মোলের স্পর্শ-চেতনা অতি তীব্র। বিশেষ করে আশপাশের অতি অস্পষ্ট কম্পনও সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারে। সেটাই গোল্ডেন মোলকে চোখ ও কানের বিকল্প হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
দেশের সরকারপ্রধানও অনেকটা গোল্ডেন মোলের মতো। যে যাই ধারণা করুক, বাস্তবতা হলো, যিনি সরকারপ্রধান থাকেন তাঁর সরাসরি সব কিছু দেখার, দেখভাল করার ফুরসত খুব একটা নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে যায় সাক্ষাৎ, বৈঠক। তারপর সারা দিন পরিদর্শন, দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাসহ অসংখ্য কাজ, অসংখ্য সিদ্ধান্ত। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যোগদান থেকে শুরু করে একটির পর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে হয়। মোদ্দা কথা, গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ততাপূর্ণ এক অস্বাভাবিক জীবন। সে কারণেই তিনি টেলিভিশনের খবর দেখার বা পত্রিকা পড়ার সময় পান কদাচিৎ। সুতরাং তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকেন তাঁদেরই ওই গোল্ডেন মোলের ইন্দ্রিয়গুলোর মতো কাজ করতে হয়। সেটাই নিয়ম। প্রায় ১৬ কোটি (কত মানুষ কে জানে, কেউ সঠিক হিসাব দিতে পারল না। থাক সে কথা) মানুষের বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন। তাঁর পক্ষেও মানুষ হিসেবে কখনোই সব খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া সম্ভব নয়, সব বিষয়ে প্রতিদিন নিজেকে একা একা আপগ্রেড করা সম্ভব নয়। তাঁর যে উপদেষ্টারা থাকবেন, তাঁরা নিয়মিত সঠিক তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আপগ্রেড (হালনাগাদ?) করবেন। কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রীর কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। তাঁরা অনেকটাই কাজ করবেন গোল্ডেন মোলের স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়গুলোর মতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এ সহযোগিতা কতটুকু মিলছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে প্রায়ই মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন ভুল তথ্যের চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন। দেশে অসংখ্য অসংগতি, অসংখ্য অগণতান্ত্রিক আচরণ দেখা যাচ্ছে, যার দায় সরাসরি সরকারের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তিনি বিষয়গুলোর ব্যাপারে সঠিকভাবে ইনফর্মড নন। বরং কেউ না কেউ তাঁকে এমন কথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যার ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিতর্ক করে যেতে হচ্ছে; এতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা, আর যাই হোক, বাড়ছে না।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠেছে তা হলো সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। টক শো নিয়ে সম্প্রতি সরকারের মধ্যে বিরক্তি দেখা গেছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা দায়িত্ববহনকারীরা কেউ কেউ সমাজের অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ভারী ভারী মানুষকে অজ্ঞ, মূর্খ বলে গালি দিচ্ছেন, যা অসহিষ্ণুতারই বহিঃপ্রকাশ। মিটিং-মিছিল সহ্য করতে পারছে না, যা সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। খুব বেশি করে জানতে ইচ্ছা করে, কার সিদ্ধান্তে ১১ জুন বিরোধী জোটের সমাবেশে যাতে লোকসমাগম না হতে পারে সে জন্য সরকার স্বয়ং অঘোষিত হরতাল পালন করল? ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হলো না দূরপাল্লার পরিবহন, অদৃশ্য ইশারায় বন্ধ থাকল লঞ্চ রুট? সরকারে সংশ্লিষ্ট কেউ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন যে এতে সরকার কিভাবে লাভবান হয়েছে? বরং কাজটি যার সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকুক, তিনি জেনে অথবা না জেনে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট করেছেন। এ কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানতে ও বুঝতে হবে। লক্ষণীয়, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর প্রতিটি কথার জবাব তাৎক্ষণিকভাবে কেউ না কেউ দিচ্ছেন, এটিও অসহিষ্ণুতার পরিচায়ক। এতে মনে হতে পারে, সরকার উন্নয়ন ও জাতীয় নানা সংকটের দিকে না তাকিয়ে বিরোধী দলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু-তনয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সত্যিকার চিত্রটি আশপাশের লোকদের কাছ থেকে পেতেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে কড়া আদেশ আসত, যে করে হোক দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার। তিনি অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু দঃখের বিষয়, ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীকে যাঁদের ব্রিফ করার কথা তাঁরা কোথাও গরমিল করে ফেলছেন। 'সব কিছু ঠিক আছে' বলে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের ক্ষতিসাধন করছেন। প্রতিদিনের সংবাদপত্র, প্রতিদিনের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে খুন, দখল, হামলার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তাকে এক কথায় আইনশৃঙ্খলার চরম বিপর্যয় না বলে গতি নেই। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো অতিপ্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হলো, বাংলাদেশে এখন দুই মানসিকতার পুলিশই সমাজ তথা জনগণকে খেপিয়ে তুলছে। একটি হলো অতিউৎসাহী পুলিশ, যারা বিরোধী দলকে পিটিয়ে প্রমোশন-পোস্টিং চায় এবং আনুগত্যের প্রমাণ রাখে, আরেকটি হলো যারা সরকারের পতন দেখতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পুলিশের মধ্যে যেমন আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ রয়েছে, তেমনি ভুলে গেলে চলবে না যে একটি বড় সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা বিএনপি এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে নিয়োগ পেয়ে চাকরিতে বহাল আছেন। যে পুলিশ একের পর এক উদ্ধত আচরণ করছে, লাঠির জোরে যাকে ইচ্ছা গায়ে হাত তুলছে, সেই পুলিশই একের পর এক হত্যাকাণ্ডের, একের পর এক জঘন্য অপরাধের কোনো ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারছে না। শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের নির্বাহী প্রশাসনের সর্বস্তরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তারা সরকারের অনিষ্ট করে চলেছে।
দেশের প্রতিটি ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একটি সিন্ডিকেটও ভাঙতে পারেনি সরকারের কোনো সংস্থা। চাল-ডাল-ডিম-আলু থেকে শুরু করে বাড়ির ব্যবসা-গাড়ির ব্যবসা- সর্বত্র সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবা পড়েছে। সরকার শুধু আশার কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার অতি জলদি পরিবর্তন না হলে সরকারে থাকা দলের জনপ্রিয়তায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। গোল্ডেন মোল যে তীব্র চেতনা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সরকারের জন্য এখনই সে চেতনা তৈরি করা দরকার। অন্যথায়, মনে রাখা দরকার, বিশালদেহী শক্তিশালী ডাইনোসরও কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পুনশ্চ : সিগারেট খাওয়া ভালো না। প্রয়োজনে সরকার সিগারেটের ওপর আরো কর ধার্য করুক, আপত্তি নেই। প্রয়োজনে সিগারেট নিষিদ্ধ করা হোক, তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু যে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ১২২ টাকা দাম লেখা আছে, সে সিগারেট সারা বাংলাদেশে ১৫০ টাকা প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে কিভাবে? প্রতি প্যাকেট সিগারেটে প্রায় ৩০ টাকা বাড়তি হিসাবে জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা গিয়ে কার পকেটে ঢুকছে? এত বড় ডাকাতি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত বা সংশ্লিষ্টরা দেখতে না পান, তাহলে কী করে বলা যাবে যে সরকারের গোল্ডেন মোলের মতো চেতনাটুকু আছে?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
বিবর্তনের কারণে চোখ ও কানের মতো অপরিহার্য অঙ্গ উধাও হয়ে গেলেও ক্ষুধা তো আর উধাও হয়ে যায়নি। খাবার সন্ধান করে খেতে হয়। তাও আবার ঘাস-পাতা নয়, সচল পোকামাকড় ধরে খেতে হয়। সেটা কী করে সম্ভব? হুম, সম্ভব। গোল্ডেন মোলের স্পর্শ-চেতনা অতি তীব্র। বিশেষ করে আশপাশের অতি অস্পষ্ট কম্পনও সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারে। সেটাই গোল্ডেন মোলকে চোখ ও কানের বিকল্প হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
দেশের সরকারপ্রধানও অনেকটা গোল্ডেন মোলের মতো। যে যাই ধারণা করুক, বাস্তবতা হলো, যিনি সরকারপ্রধান থাকেন তাঁর সরাসরি সব কিছু দেখার, দেখভাল করার ফুরসত খুব একটা নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে যায় সাক্ষাৎ, বৈঠক। তারপর সারা দিন পরিদর্শন, দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাসহ অসংখ্য কাজ, অসংখ্য সিদ্ধান্ত। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যোগদান থেকে শুরু করে একটির পর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে হয়। মোদ্দা কথা, গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ততাপূর্ণ এক অস্বাভাবিক জীবন। সে কারণেই তিনি টেলিভিশনের খবর দেখার বা পত্রিকা পড়ার সময় পান কদাচিৎ। সুতরাং তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকেন তাঁদেরই ওই গোল্ডেন মোলের ইন্দ্রিয়গুলোর মতো কাজ করতে হয়। সেটাই নিয়ম। প্রায় ১৬ কোটি (কত মানুষ কে জানে, কেউ সঠিক হিসাব দিতে পারল না। থাক সে কথা) মানুষের বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন। তাঁর পক্ষেও মানুষ হিসেবে কখনোই সব খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া সম্ভব নয়, সব বিষয়ে প্রতিদিন নিজেকে একা একা আপগ্রেড করা সম্ভব নয়। তাঁর যে উপদেষ্টারা থাকবেন, তাঁরা নিয়মিত সঠিক তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আপগ্রেড (হালনাগাদ?) করবেন। কখনো কখনো প্রধানমন্ত্রীর কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। তাঁরা অনেকটাই কাজ করবেন গোল্ডেন মোলের স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয়গুলোর মতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এ সহযোগিতা কতটুকু মিলছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে প্রায়ই মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন ভুল তথ্যের চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন। দেশে অসংখ্য অসংগতি, অসংখ্য অগণতান্ত্রিক আচরণ দেখা যাচ্ছে, যার দায় সরাসরি সরকারের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তিনি বিষয়গুলোর ব্যাপারে সঠিকভাবে ইনফর্মড নন। বরং কেউ না কেউ তাঁকে এমন কথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, যার ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিতর্ক করে যেতে হচ্ছে; এতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা, আর যাই হোক, বাড়ছে না।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠেছে তা হলো সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। টক শো নিয়ে সম্প্রতি সরকারের মধ্যে বিরক্তি দেখা গেছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা দায়িত্ববহনকারীরা কেউ কেউ সমাজের অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ভারী ভারী মানুষকে অজ্ঞ, মূর্খ বলে গালি দিচ্ছেন, যা অসহিষ্ণুতারই বহিঃপ্রকাশ। মিটিং-মিছিল সহ্য করতে পারছে না, যা সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। খুব বেশি করে জানতে ইচ্ছা করে, কার সিদ্ধান্তে ১১ জুন বিরোধী জোটের সমাবেশে যাতে লোকসমাগম না হতে পারে সে জন্য সরকার স্বয়ং অঘোষিত হরতাল পালন করল? ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হলো না দূরপাল্লার পরিবহন, অদৃশ্য ইশারায় বন্ধ থাকল লঞ্চ রুট? সরকারে সংশ্লিষ্ট কেউ ব্যাখ্যা দিতে পারবেন যে এতে সরকার কিভাবে লাভবান হয়েছে? বরং কাজটি যার সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকুক, তিনি জেনে অথবা না জেনে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট করেছেন। এ কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানতে ও বুঝতে হবে। লক্ষণীয়, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীর প্রতিটি কথার জবাব তাৎক্ষণিকভাবে কেউ না কেউ দিচ্ছেন, এটিও অসহিষ্ণুতার পরিচায়ক। এতে মনে হতে পারে, সরকার উন্নয়ন ও জাতীয় নানা সংকটের দিকে না তাকিয়ে বিরোধী দলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু-তনয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সত্যিকার চিত্রটি আশপাশের লোকদের কাছ থেকে পেতেন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে কড়া আদেশ আসত, যে করে হোক দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার। তিনি অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু দঃখের বিষয়, ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীকে যাঁদের ব্রিফ করার কথা তাঁরা কোথাও গরমিল করে ফেলছেন। 'সব কিছু ঠিক আছে' বলে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের ক্ষতিসাধন করছেন। প্রতিদিনের সংবাদপত্র, প্রতিদিনের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে খুন, দখল, হামলার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তাকে এক কথায় আইনশৃঙ্খলার চরম বিপর্যয় না বলে গতি নেই। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে আত্মতুষ্টি প্রকাশ করছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি বার্তা পৌঁছানো অতিপ্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে। তা হলো, বাংলাদেশে এখন দুই মানসিকতার পুলিশই সমাজ তথা জনগণকে খেপিয়ে তুলছে। একটি হলো অতিউৎসাহী পুলিশ, যারা বিরোধী দলকে পিটিয়ে প্রমোশন-পোস্টিং চায় এবং আনুগত্যের প্রমাণ রাখে, আরেকটি হলো যারা সরকারের পতন দেখতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পুলিশের মধ্যে যেমন আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ রয়েছে, তেমনি ভুলে গেলে চলবে না যে একটি বড় সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা বিএনপি এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে নিয়োগ পেয়ে চাকরিতে বহাল আছেন। যে পুলিশ একের পর এক উদ্ধত আচরণ করছে, লাঠির জোরে যাকে ইচ্ছা গায়ে হাত তুলছে, সেই পুলিশই একের পর এক হত্যাকাণ্ডের, একের পর এক জঘন্য অপরাধের কোনো ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারছে না। শুধু পুলিশ নয়, প্রশাসনের নির্বাহী প্রশাসনের সর্বস্তরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তারা সরকারের অনিষ্ট করে চলেছে।
দেশের প্রতিটি ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একটি সিন্ডিকেটও ভাঙতে পারেনি সরকারের কোনো সংস্থা। চাল-ডাল-ডিম-আলু থেকে শুরু করে বাড়ির ব্যবসা-গাড়ির ব্যবসা- সর্বত্র সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবা পড়েছে। সরকার শুধু আশার কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার অতি জলদি পরিবর্তন না হলে সরকারে থাকা দলের জনপ্রিয়তায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। গোল্ডেন মোল যে তীব্র চেতনা দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সরকারের জন্য এখনই সে চেতনা তৈরি করা দরকার। অন্যথায়, মনে রাখা দরকার, বিশালদেহী শক্তিশালী ডাইনোসরও কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পুনশ্চ : সিগারেট খাওয়া ভালো না। প্রয়োজনে সরকার সিগারেটের ওপর আরো কর ধার্য করুক, আপত্তি নেই। প্রয়োজনে সিগারেট নিষিদ্ধ করা হোক, তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু যে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ১২২ টাকা দাম লেখা আছে, সে সিগারেট সারা বাংলাদেশে ১৫০ টাকা প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে কিভাবে? প্রতি প্যাকেট সিগারেটে প্রায় ৩০ টাকা বাড়তি হিসাবে জনগণের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা গিয়ে কার পকেটে ঢুকছে? এত বড় ডাকাতি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত বা সংশ্লিষ্টরা দেখতে না পান, তাহলে কী করে বলা যাবে যে সরকারের গোল্ডেন মোলের মতো চেতনাটুকু আছে?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments