আমরা মানুষ দেখি না by কাজী জামশেদ নাজিম
আমি একজন তথ্য সংগ্রহকারী। সপ্তাহের মঙ্গলবার আমার সাপ্তাহিক বিশ্রামের দিন। কথা বলছি, গত মঙ্গলবার নিয়ে। ঘুম ভাঙতে সকালের ছয় ঘণ্টা চলে যায়। স্বল্প সময়ে পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনামগুলো দেখা হলো। দৃষ্টি গেল পেছনের পাতায়। ‘তিনটি বাঘের বাচ্চা উদ্ধার’ শিরোনামে একটি খবর।
তিন কলাম, অর্ধেক পৃষ্ঠার চারভাগের তিন ভাগ দখল করেছে এটি। ছবিতে একটি শিশু বাঘের মুখে ফিডার। এর নিচেই র্যাব সদস্যদের ‘কোমল’ হাতে ধরে শাবকগুলোকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ছবি দুটির নিচে আবেগী শব্দ দিয়ে বেশ গুছিয়ে লেখা হয়েছে ক্যাপশন- ‘মা নেই। তাই ফিডারে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে বাঘের বাচ্চাগুলোকে।’ লেখাগুলো দেখে শাবকদের জন্য কিছুটা মায়া জন্মায়। আবার হাসি পায়। কিছুটা ঘৃণাও জন্মায়। ঘৃণা সমাজের প্রতি, কিছুটা নিজের প্রতি। নিজের প্রতি ঘৃণা এ কারণে- মানুষের বাচ্চাদের মুখে ফিডার ধরিনি। তা করলে হয়তো দুটি নবজাতক জীবন পেতো।
ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়ার কোনো স্থান নেই। নেই অফিসে যাওয়ার চিন্তা। তারপরও বাসা থেকে বের হলাম। বাসস্ট্যান্ডের একটি সংবাদপত্রের বিক্রয় কেন্দ্রে চোখ রাখলাম। দৃষ্টি পড়লো সর্বাধিক প্রচারিত একটি ইংরেজি দৈনিকের দিকে। প্রথম পাতায় বাঘের বাচ্চাদের ছবি। চার কলামে অর্ধেক পৃষ্ঠায় ওই খবরটি স্থান পেয়েছে। আরো কয়েকটি দৈনিক নেড়েচেড়ে দেখলাম। সেগুলোও এ খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছবিসহ ছেপেছে।
হাতে-গোনা কয়েক বছর ধরে সাংবাদকর্মীর পেশায় আছি। সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময়কার কথা। বৈকালিক দৈনিক দিনের শেষে সংবাদকর্মীর হিসেবে কাজ শুরু করি। আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক শহিদুল আজম ছিলেন দৈনিকটির নির্বাহী সম্পাদক। একদম ফাঁকি দিতে পারতাম না। ঘটনাস্থলে না গেলে তিনি কিভাবে যেন খবর পেতেন। ফলে অনেক ঘটনাস্থলে আমাকে যেতে হয়েছে। দেখেছি অনেক মর্মান্তিক ঘটনার করুণ দৃশ্য। বিশেষ করে বিডিয়ার বিদ্রোহ, কারওয়ান বাজারের ট্রিপল মার্ডার, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড। অনেক ঘটনায় কষ্ট পেয়েছি। চাপা কান্নাও এসেছে। কিন্তু চোখে কখনো অশ্রু দেখিনি। একদিন চোখের অশ্রু আমার অবাধ্য হয়েছিল। খুনখারাবি বা মানুষের হাত-পা পৃথক করার ঘটনা দেখে নয়, সামান্য দুটি নবজাতকের চিৎকারে।
গত বছরের শেষের দিকের কথা। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাশেই লোকজনের জট। সবার মাথার ওপর দিয়ে ফ্লোরে দৃষ্টি রাখি। দৃষ্টি পড়তেই হতভম্ভ। একটি নীল রঙের চেক লুঙ্গি, ভেতর ফুটফুটে দুটি ছেলে সন্তান। তাদের বয়স মাত্র ২/১ দিন। তাদের দাবিদার কেউ নেই। রোগীদের স্বজন ও হাসপাতালের আয়া-বুয়ারা দেখছে। কেউ তাদের কোলে নিচ্ছে না। কে-ই বা নেবে? নিজ মায়ের কোলেই ওদের ঠাঁই হলো না। হয়তো ওরা একজোড়া নর-নারীর ক্ষণিকের আনন্দের ফসল। তাই ওদের জন্য তাদের কোনো দরদ নেই।
মায়ের আদর পেতে ছেলে দুটি কাতরাচ্ছিল। এ দুই হতভাগা নবজাতক মায়ের বুকের দুধে পিপাসাও মেটাতে পারেনি। পিপাসায় ওদের গলা শুকিয়ে আসছিল। চিৎকারে হাসপাতালের আশপাশ ভারী হয়ে ওঠে। শাবকদের ছবিসহ খবর দেখে এতো সময় বাসের সিটে হেলান দিয়ে ওই নবজাতকদের নিয়ে ভাবছিলাম।
ভুলে গেলাম মানুষের বাচ্চা দুটির কথা। নিজ গন্তব্যে ছুটলাম। ডিআরইউ’র কম্পিউটার রুমে গেলাম। বদ্ধ রুমে যন্ত্রের কৃত্রিম শীতল বাতাস। এমন পরিবেশে কম্পিউটার ব্রাউজ করার মজাই আলাদা। বিভিন্ন অনলাইন নিউজ সার্ভিসের সংবাদ শিরোনাম দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো বাঘের বাচ্চাদের খবর। তাদের উদ্ধার ঘটনায় নিয়ে অনেক খবর। সকাল থেকে বাঘের বাচ্চারা আমার পিছু ছাড়ছে না। খবর পড়ায় ইতি টেনে ফেসবুকের পাতা মেললাম। সেখানেও বাঘের ছবি স্থান পেয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বাঘের বাচ্চা নিয়ে স্থিরচিত্র ধারণ করেছেন। তা ফেইসবুকে পোস্ট করেছে। কেউ নিজের সন্তানকে নিয়ে এভাবে পোজ দিয়ে চিত্রধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করছে কি না- সে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।
শাবক ও নবজাতক নিয়ে নানা ভাবনা মাথায় দোলা দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তার মোবাইলে ফোন করলাম। জানতে চাইতে চাইলাম- নবজাতক উদ্ধারের কোনো তথ্য আছে কি না। বছরে কতগুলো নবজাতক শিশু ফেলে দেয়া হয়? কতগুলো জীবিত উদ্ধার করা হয়? তিনি বললেন, এ ধরনের পরিসংখ্যানের জন্য সময় দিতে হবে, পৃথকভাবে কোনো পরিসংখ্যান নেই।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খোলে গেল। পুলিশের কাছে পরিসংখ্যান না থাকতে পারে, কিন্তু গুগলে থাকবে। কম্পিউটারে টাইপ করলাম ‘নবজাতক শিশু উদ্ধার’। গুগলে তল্লাশি দিতে কম্পিউটারের স্কিন ভরে গেল। হাজারো নবজাতক শিশু উদ্ধারে সংবাদ ভাসছে। হাসপাতালে বারান্দা, ধানক্ষেত কিংবা ময়লা আবর্জনা পাশেই লাশ হয়ে মানুষের বাচ্চা তথা নবজাতকদের পড়ে থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে দু-চারজন নবজাতকের লাশ একসঙ্গে উদ্ধার করা হচ্ছে। সর্বশেষ কয়েক সপ্তাহে আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় চার নবজাতকের লাশ উদ্ধার করার হয়। নবজাতক উদ্ধারের খবরগুলো হয়তো ছয় মাসে পড়েও শেষ করা যাবে না।
এর মধ্যে আমি যে পত্রিকায় কর্মরত সেটির দুটি প্রতিবেদন চোখে পড়লো। ‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় না’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি আমার লেখা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই নবজাতক দুটিকে নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে যারা স্মৃতির পাতায় স্থান পেয়েছিল। সেদিন শিশু দুটির চিৎকারে মায়া জন্ম নিয়েছিল হাসপাতালে আয়া ফাতেমার। তিনি আর ওয়ার্ড মাস্টার আলম হাসপাতালের পরিচালকের কাছে শিশুদের হস্তান্তর করেন। তিনি শিশু দুটির কেয়ার ওয়ার্ডে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের বাচ্চা দুটির লক্ষ রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অযত্ন আর অবহেলার সমন্বয়ের আচরণগুলো ওদের ওপর পড়েছে। এক দিনের ব্যবধানে শিশু দুটির জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সেদিন ওই মানুষের বাচ্চাদের পাশে র্যাব, পুলিশ কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আসেনি। খবর হিসেবে পত্রিকার পাতায় খুব একটা স্থান পায়নি। এ দু’নবজাতকদের আইনি সহায়তা দিতে পুলিশের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি। তাদের হত্যাকারীরা আগামীতে শাস্তি পাবে কি না- তা আমার বোধগম্য নয়।
‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় না’ শিরোনামের প্রতিবেদন তৈরির সময় কথা বলেছিলাম আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সঙ্গে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল- প্রতিনিয়ত নবজাতক উদ্ধার করা হচ্ছে, হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়- এসব প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা কী? তিনি কিছু কথা বলেছিলেন- তা আর না-ই বললাম। তবে তিনি একটা কথা বলেছেন- ‘এটা একটা সামাজিক ব্যবধি।’ শরীরের ব্যাধি নিয়ে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই, তবে সমাজের ব্যাধি নিয়ে কই, কোথায় বা কার কাছে যাব?
নবজাতক উদ্ধার ও হত্যার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এক সময় কথা হয় সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কাহার আকন্দের সঙ্গে। তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে জানান, নবজাতক বা মানুষের বাচ্চা মারা যাওয়ার ঘটনা হত্যাযজ্ঞের অপরাধের মধ্যে শামিল। তবে নবজাতকদের কোনো ওয়ারিশ থাকে না। মামলার কোনো বাদী না থাকায় মামলাগুলোর অগ্রগতি হয় না। ফলে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। শুধু তারাই নন, দুইজন পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন সহকারী পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের চাকরির বয়স কম করে হলেও ২০/২৫ বছর। তারা বিভিন্ন সময় একাধিক নবজাতক উদ্ধার করেছেন। কিন্তু কেউ নবজাতক হত্যা বা ফেলে দেয়ার অভিযোগে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেননি। এসব ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ সদস্যের তদন্তে ব্যর্থতার দায়ে নিতে হচ্ছে না। কোনো জবাবদিহি করতে হয় না কারো কাছে।
শাবক আটক রাখার জন্য মা ও ছেলেকে শাস্তি দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পশুসম্পদ রক্ষা আইনে অবশ্য তারা কঠোর অপরাধ করছেন। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাঘের বাচ্চা আটককারীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে- এজন্য র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ধন্যবাদ। তবে নবজাতক হত্যাকারীদের শাস্তির কী হবে? কখনো কি নবজাতক হত্যার ঘটনায় তদন্ত টিম গঠন করা হবে?
ছোটবেলা থেকে একটি গান শুনে এসেছি- সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপরে নাই। আজ সমাজ ও আমাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গানটির কথাগুলোর সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছি না। নাকি গায়কের সে সময়ের সঙ্গে বর্তমান সমাজের মিল নেই। নেই আইনের সঠিক প্রয়োগ। নাকি ওই গানটি নতুন করে কাউকে দিয়ে গাওয়া হবে। আর সে গানের কথা হবে এমন- সবার ওপরে শাবক সত্য, মানুষ সত্য নয়।
কাজী জামশেদ নাজিম: সাংবাদিক
kjn_nazim@yahoo.com
ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়ার কোনো স্থান নেই। নেই অফিসে যাওয়ার চিন্তা। তারপরও বাসা থেকে বের হলাম। বাসস্ট্যান্ডের একটি সংবাদপত্রের বিক্রয় কেন্দ্রে চোখ রাখলাম। দৃষ্টি পড়লো সর্বাধিক প্রচারিত একটি ইংরেজি দৈনিকের দিকে। প্রথম পাতায় বাঘের বাচ্চাদের ছবি। চার কলামে অর্ধেক পৃষ্ঠায় ওই খবরটি স্থান পেয়েছে। আরো কয়েকটি দৈনিক নেড়েচেড়ে দেখলাম। সেগুলোও এ খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছবিসহ ছেপেছে।
হাতে-গোনা কয়েক বছর ধরে সাংবাদকর্মীর পেশায় আছি। সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময়কার কথা। বৈকালিক দৈনিক দিনের শেষে সংবাদকর্মীর হিসেবে কাজ শুরু করি। আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক শহিদুল আজম ছিলেন দৈনিকটির নির্বাহী সম্পাদক। একদম ফাঁকি দিতে পারতাম না। ঘটনাস্থলে না গেলে তিনি কিভাবে যেন খবর পেতেন। ফলে অনেক ঘটনাস্থলে আমাকে যেতে হয়েছে। দেখেছি অনেক মর্মান্তিক ঘটনার করুণ দৃশ্য। বিশেষ করে বিডিয়ার বিদ্রোহ, কারওয়ান বাজারের ট্রিপল মার্ডার, নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড। অনেক ঘটনায় কষ্ট পেয়েছি। চাপা কান্নাও এসেছে। কিন্তু চোখে কখনো অশ্রু দেখিনি। একদিন চোখের অশ্রু আমার অবাধ্য হয়েছিল। খুনখারাবি বা মানুষের হাত-পা পৃথক করার ঘটনা দেখে নয়, সামান্য দুটি নবজাতকের চিৎকারে।
গত বছরের শেষের দিকের কথা। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাশেই লোকজনের জট। সবার মাথার ওপর দিয়ে ফ্লোরে দৃষ্টি রাখি। দৃষ্টি পড়তেই হতভম্ভ। একটি নীল রঙের চেক লুঙ্গি, ভেতর ফুটফুটে দুটি ছেলে সন্তান। তাদের বয়স মাত্র ২/১ দিন। তাদের দাবিদার কেউ নেই। রোগীদের স্বজন ও হাসপাতালের আয়া-বুয়ারা দেখছে। কেউ তাদের কোলে নিচ্ছে না। কে-ই বা নেবে? নিজ মায়ের কোলেই ওদের ঠাঁই হলো না। হয়তো ওরা একজোড়া নর-নারীর ক্ষণিকের আনন্দের ফসল। তাই ওদের জন্য তাদের কোনো দরদ নেই।
মায়ের আদর পেতে ছেলে দুটি কাতরাচ্ছিল। এ দুই হতভাগা নবজাতক মায়ের বুকের দুধে পিপাসাও মেটাতে পারেনি। পিপাসায় ওদের গলা শুকিয়ে আসছিল। চিৎকারে হাসপাতালের আশপাশ ভারী হয়ে ওঠে। শাবকদের ছবিসহ খবর দেখে এতো সময় বাসের সিটে হেলান দিয়ে ওই নবজাতকদের নিয়ে ভাবছিলাম।
ভুলে গেলাম মানুষের বাচ্চা দুটির কথা। নিজ গন্তব্যে ছুটলাম। ডিআরইউ’র কম্পিউটার রুমে গেলাম। বদ্ধ রুমে যন্ত্রের কৃত্রিম শীতল বাতাস। এমন পরিবেশে কম্পিউটার ব্রাউজ করার মজাই আলাদা। বিভিন্ন অনলাইন নিউজ সার্ভিসের সংবাদ শিরোনাম দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো বাঘের বাচ্চাদের খবর। তাদের উদ্ধার ঘটনায় নিয়ে অনেক খবর। সকাল থেকে বাঘের বাচ্চারা আমার পিছু ছাড়ছে না। খবর পড়ায় ইতি টেনে ফেসবুকের পাতা মেললাম। সেখানেও বাঘের ছবি স্থান পেয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বাঘের বাচ্চা নিয়ে স্থিরচিত্র ধারণ করেছেন। তা ফেইসবুকে পোস্ট করেছে। কেউ নিজের সন্তানকে নিয়ে এভাবে পোজ দিয়ে চিত্রধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করছে কি না- সে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।
শাবক ও নবজাতক নিয়ে নানা ভাবনা মাথায় দোলা দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তার মোবাইলে ফোন করলাম। জানতে চাইতে চাইলাম- নবজাতক উদ্ধারের কোনো তথ্য আছে কি না। বছরে কতগুলো নবজাতক শিশু ফেলে দেয়া হয়? কতগুলো জীবিত উদ্ধার করা হয়? তিনি বললেন, এ ধরনের পরিসংখ্যানের জন্য সময় দিতে হবে, পৃথকভাবে কোনো পরিসংখ্যান নেই।
হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খোলে গেল। পুলিশের কাছে পরিসংখ্যান না থাকতে পারে, কিন্তু গুগলে থাকবে। কম্পিউটারে টাইপ করলাম ‘নবজাতক শিশু উদ্ধার’। গুগলে তল্লাশি দিতে কম্পিউটারের স্কিন ভরে গেল। হাজারো নবজাতক শিশু উদ্ধারে সংবাদ ভাসছে। হাসপাতালে বারান্দা, ধানক্ষেত কিংবা ময়লা আবর্জনা পাশেই লাশ হয়ে মানুষের বাচ্চা তথা নবজাতকদের পড়ে থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে দু-চারজন নবজাতকের লাশ একসঙ্গে উদ্ধার করা হচ্ছে। সর্বশেষ কয়েক সপ্তাহে আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় চার নবজাতকের লাশ উদ্ধার করার হয়। নবজাতক উদ্ধারের খবরগুলো হয়তো ছয় মাসে পড়েও শেষ করা যাবে না।
এর মধ্যে আমি যে পত্রিকায় কর্মরত সেটির দুটি প্রতিবেদন চোখে পড়লো। ‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় না’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি আমার লেখা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই নবজাতক দুটিকে নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে যারা স্মৃতির পাতায় স্থান পেয়েছিল। সেদিন শিশু দুটির চিৎকারে মায়া জন্ম নিয়েছিল হাসপাতালে আয়া ফাতেমার। তিনি আর ওয়ার্ড মাস্টার আলম হাসপাতালের পরিচালকের কাছে শিশুদের হস্তান্তর করেন। তিনি শিশু দুটির কেয়ার ওয়ার্ডে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের বাচ্চা দুটির লক্ষ রাখেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অযত্ন আর অবহেলার সমন্বয়ের আচরণগুলো ওদের ওপর পড়েছে। এক দিনের ব্যবধানে শিশু দুটির জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সেদিন ওই মানুষের বাচ্চাদের পাশে র্যাব, পুলিশ কিংবা কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আসেনি। খবর হিসেবে পত্রিকার পাতায় খুব একটা স্থান পায়নি। এ দু’নবজাতকদের আইনি সহায়তা দিতে পুলিশের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যায়নি। তাদের হত্যাকারীরা আগামীতে শাস্তি পাবে কি না- তা আমার বোধগম্য নয়।
‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় না’ শিরোনামের প্রতিবেদন তৈরির সময় কথা বলেছিলাম আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সঙ্গে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল- প্রতিনিয়ত নবজাতক উদ্ধার করা হচ্ছে, হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়- এসব প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা কী? তিনি কিছু কথা বলেছিলেন- তা আর না-ই বললাম। তবে তিনি একটা কথা বলেছেন- ‘এটা একটা সামাজিক ব্যবধি।’ শরীরের ব্যাধি নিয়ে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই, তবে সমাজের ব্যাধি নিয়ে কই, কোথায় বা কার কাছে যাব?
নবজাতক উদ্ধার ও হত্যার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এক সময় কথা হয় সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কাহার আকন্দের সঙ্গে। তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করে জানান, নবজাতক বা মানুষের বাচ্চা মারা যাওয়ার ঘটনা হত্যাযজ্ঞের অপরাধের মধ্যে শামিল। তবে নবজাতকদের কোনো ওয়ারিশ থাকে না। মামলার কোনো বাদী না থাকায় মামলাগুলোর অগ্রগতি হয় না। ফলে এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। শুধু তারাই নন, দুইজন পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন সহকারী পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের চাকরির বয়স কম করে হলেও ২০/২৫ বছর। তারা বিভিন্ন সময় একাধিক নবজাতক উদ্ধার করেছেন। কিন্তু কেউ নবজাতক হত্যা বা ফেলে দেয়ার অভিযোগে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেননি। এসব ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ সদস্যের তদন্তে ব্যর্থতার দায়ে নিতে হচ্ছে না। কোনো জবাবদিহি করতে হয় না কারো কাছে।
শাবক আটক রাখার জন্য মা ও ছেলেকে শাস্তি দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পশুসম্পদ রক্ষা আইনে অবশ্য তারা কঠোর অপরাধ করছেন। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাঘের বাচ্চা আটককারীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে- এজন্য র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ধন্যবাদ। তবে নবজাতক হত্যাকারীদের শাস্তির কী হবে? কখনো কি নবজাতক হত্যার ঘটনায় তদন্ত টিম গঠন করা হবে?
ছোটবেলা থেকে একটি গান শুনে এসেছি- সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপরে নাই। আজ সমাজ ও আমাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গানটির কথাগুলোর সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছি না। নাকি গায়কের সে সময়ের সঙ্গে বর্তমান সমাজের মিল নেই। নেই আইনের সঠিক প্রয়োগ। নাকি ওই গানটি নতুন করে কাউকে দিয়ে গাওয়া হবে। আর সে গানের কথা হবে এমন- সবার ওপরে শাবক সত্য, মানুষ সত্য নয়।
কাজী জামশেদ নাজিম: সাংবাদিক
kjn_nazim@yahoo.com
No comments