বিশেষ সাক্ষাৎকার : মুস্তাফিজুর রহমান-অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার না হলে ঋণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
জাতীয় বাজেট ২০১২-১৩ ঘোষিত হয়েছে সম্প্রতি। বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : প্রায় এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকাই ঘাটতি। বিশাল ঘাটতির এ বাজেট বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : আমাদের মতো দেশে ঘাটতি বাজেট থাকাটা স্বাভাবিক। আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তাই আমাদের বাজেটের এ ঘাটতিকে মেনে নিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এ ঘাটতি পূরণের জন্য অর্থ সংগ্রহ হবে কিভাবে। সাধারণত তিন ভাবে আমাদের এখানে অর্থ সংস্থান হয়। এর একটি হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য, দ্বিতীয়ত ব্যাংক ঋণ ও ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ। তাই কথা হচ্ছে অর্থায়ন হবে কিভাবে। সম্পদ সৃষ্টি করে সেই ঘাটতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে। দেখতে হবে টাকার অপচয় যেন না হয়। চলমান অর্থবছরে সরকার বাইরে থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা আনতে পারেনি, যে কারণে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। এ বাজেটে অর্থায়নের যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তাতে বৈদেশিক নির্ভরতা কম নয়। এটুকুও যদি না আসে তাহলে বিরাট অভ্যন্তরীণ চাপ পড়বে। সেই চাপ হবে তুলনামূলক বেশি। সঞ্চয়পত্র থেকেও অর্থ আসবে। সঞ্চয়ের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা সরকারের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার বন্ড ছাড়তে পারে। সরকারের শেয়ার ছাড়ার যে টার্গেট আছে তা পূরণ হলে কিছুটা সুবিধা হবে। এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। এতে কিছুটা সুবিধা হয়তো হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : দেশজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (জিডিপি) ৭.২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরের আলোকে সম্ভাবনা ও তার যথার্থতা মূল্যায়ন করুন।
মুস্তাফিজুর রহমান : জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট করা হয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সূত্র ধরে। মনে রাখতে হবে, এটা ৬.৪ শতাংশের ওপরে করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে উন্নয়ন প্রশাসনের বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা খুবই কষ্টকর হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করাটা অসম্ভব নয়। তবে নিশ্চিতভাবে এটা চ্যালেঞ্জিং। ৭.২ শতাংশ টার্গেট পূরণের জন্য যে ধরনের জনপ্রশাসন প্রয়োজন তা কি আছে? টার্গেট পূরণ করতে হলে বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। জ্বালানি সমস্যা সমাধান করার বিকল্প নেই। সামগ্রিক বিবেচনা করে বলতে হবে- এটা দুরূহ। চ্যালেঞ্জিং। প্রশ্ন হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা। অনুকূল অবস্থা বজায় থাকা সাপেক্ষে আমরা যদি ৭.২ শতাংশ না হোক তার কাছাকাছিও অর্জন করতে পারি, তাহলেও আমাদের অর্থনীতিতে বড় অর্জন হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মূল্যস্ফীতি এখনই ৯ শতাংশের বেশি। বাজেটে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে তাকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার। কতটা সম্ভব হবে?
মুস্তাফিজুর রহমান : মূল্যস্ফীতি কমের দিকে থাকবে। মূল্যস্তর একটা পর্যায়ে আছে। চালের মূল্য এখন স্থিতিশীল। খাদ্যমূল্য কম হারে বাড়বে। তবে তা ৭ থেকে ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে। আরেকটা কথা- মূল্যস্তর তো এমনিতেই উঠে আছে। এটা অব্যাহত থাকলে জনগণের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে সরকারের নজর দিতে হবে। তবে সংযত করার চেষ্টা চলছে।
কালের কণ্ঠ : অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তার ফলাফল কী হতে পারে?
মুস্তাফিজুর রহমান : ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থায়ন হবে। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকেও নেওয়া হবে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের পারফরম্যান্সও বেশ ভালো। এনবিআরকে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। তাদের জনবল ও প্রযুক্তি সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সংস্কারের চেষ্টা চলছে। এর পরও ঘাটতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারলে ভালো হবে। সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্তি কম হবে। আবার ঋণের বিপরীতে সুদের হার পজিটিভ হতে হবে। সম্পদ আহরণের খাতগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকাতে হবে। নতুন করে ভাবতে হবে এগুলোর ব্যাপারে।
কালের কণ্ঠ : ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা স্থির রেখে ন্যূনতম কর দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় কী প্রতিফলন ঘটবে বলে আপনি মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : আমরা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পক্ষ থেকেও সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিলাম এ ধাপটা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা হোক। এটা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা হলে ভালো হতো। দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা অনেকের আছে। তবে কর দেওয়ার জন্য মানুষকে উৎসাহী করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : জনপ্রশাসন, বিবিধ এবং সুদ পরিশোধে বরাদ্দ অধিক। এতে উন্নয়নে কী প্রভাব পড়তে পারে?
মুস্তাফিজুর রহমান : বাজেটের বড় একটি অংশ চলে যায় এসব খাতে। ব্যয়ের ৮০ শতাংশই চলে যায় সুদ, পরিসেবা, জনপ্রশাসন, ভর্তুকি ইত্যাদি খাতে। এগুলো তো বিনিয়োগ নয়। তবে আমরা যদি সম্পদ সৃষ্টি করতে পারতাম, তাহলে অসুবিধা হতো না। পাবলিক এঙ্পেন্ডিচার সংস্কারের কথা শুনি না। কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তাদের মাধ্যমে সংস্কার করার সুযোগ নিতে হবে। এনবিআরে লোকবল বাড়িয়ে বেশি কর আদায় করা সম্ভব হবে। দেখতে হবে লোকবলের মধ্যে দক্ষ শক্তি কেমন বাড়ছে। তাহলে বিনিয়োগও বাড়বে। ভর্তুকি যৌক্তিক করতে হবে। অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রেও দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। অর্থের প্রাপ্তি ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয়ে বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকটি আমাদের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের মতো এ খাতটিও গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। এবার জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ কমেছে। কিন্তু টাকার অঙ্কে এটা কমেনি। সবচেয়ে বড় কথা, টাকার ব্যবহার কিভাবে হচ্ছে। টাকাটা সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর দিতে হবে। সেখানেও দক্ষতার কথা এসে যায়।
কালের কণ্ঠ : রপ্তানিকারকরা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উৎসে কর দিতে বাধ্য হবেন। আমদানিকে উৎসাহী এবং রপ্তানিকে নিরুৎসাহ করার প্রচেষ্টা অর্থনীতিতে কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : ইউরো জোন নিয়ে এখন চাপ আছে। তাই দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কমিয়ে আনতে পারলে ভালো। উৎসে কর দাতারা কিছু সুযোগ পেয়ে থাকেন। সেই সুযোগ এখনো টিকে থাকবে।
কালের কণ্ঠ : টিসিবিকে তহবিল দেওয়া হয়নি। ব্যাংক গ্যারান্টির প্রয়োজনে তাকে ১৪ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। অথচ খাদ্য আমদানিকারকরা ১০ শতাংশ সুদে ঋণসুবিধা পান। এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান নিয়ে সরকার কিভাবে প্রতিষ্ঠানটির সেবা সম্প্রসারণ
করবে?
মুস্তাফিজুর রহমান : সরকারের আরো প্রতিষ্ঠান আছে। টিসিবিকে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সম্প্রসারণ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : প্রতিযোগিতা আইন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুস্তাফিজুর রহমান : বাজার অন্যায়ভাবে কার্যকর হলে সে ক্ষেত্রে আইনি সুবিধা পেতে গেলে এটা মন্দ হবে না। পাস হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের জনবল থাকতে হবে। আইন হলেই কী হবে? বিদেশের বাজারদরও দেখতে হবে। বিনিময় হারটিও বিবেচনা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বিষয়টিও জড়িত।
কালের কণ্ঠ : প্রায় দুই কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। তারা ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয়। আবার ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : মোবাইল ফোন এখন সাধারণ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস। অনেক কর দেওয়া হচ্ছে মূল্য সংযোজন করের আওতায়। তার
বিনিময়েই আরো সার্ভিস পাওয়া উচিত। আমি মনে করি, মোবাইলের ওপর আর কর বাড়ানো ঠিক হবে না।
কালের কণ্ঠ : ঘোষিত বাজেট পুঁজিবাজার সংকট নিরসনে কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : পুঁজিবাজার সহায়ক তেমন দিকনির্দেশনা এখানে নেই বললেই চলে। মনে রাখতে হবে, বাজেট দিয়েই সব হয় না। এসইসি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। কার্যকর হলে কিছুটা সুপ্রভাব পড়বে এ খাতে। দেখুন না, তদন্ত কমিটি করা হলো। তারা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। সরকার তো কোনো ফলোআপ করল না। এতে কুপ্রভাব তো পড়তেই পারে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না করতে পারলে হবে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ এবং সে ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মুস্তাফিজুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
মুস্তাফিজুর রহমান : আমাদের মতো দেশে ঘাটতি বাজেট থাকাটা স্বাভাবিক। আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে তাই আমাদের বাজেটের এ ঘাটতিকে মেনে নিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এ ঘাটতি পূরণের জন্য অর্থ সংগ্রহ হবে কিভাবে। সাধারণত তিন ভাবে আমাদের এখানে অর্থ সংস্থান হয়। এর একটি হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য, দ্বিতীয়ত ব্যাংক ঋণ ও ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ। তাই কথা হচ্ছে অর্থায়ন হবে কিভাবে। সম্পদ সৃষ্টি করে সেই ঘাটতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে। দেখতে হবে টাকার অপচয় যেন না হয়। চলমান অর্থবছরে সরকার বাইরে থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা আনতে পারেনি, যে কারণে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। এ বাজেটে অর্থায়নের যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তাতে বৈদেশিক নির্ভরতা কম নয়। এটুকুও যদি না আসে তাহলে বিরাট অভ্যন্তরীণ চাপ পড়বে। সেই চাপ হবে তুলনামূলক বেশি। সঞ্চয়পত্র থেকেও অর্থ আসবে। সঞ্চয়ের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা সরকারের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার বন্ড ছাড়তে পারে। সরকারের শেয়ার ছাড়ার যে টার্গেট আছে তা পূরণ হলে কিছুটা সুবিধা হবে। এনবিআরকে শক্তিশালী করতে হবে। এতে কিছুটা সুবিধা হয়তো হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : দেশজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (জিডিপি) ৭.২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরের আলোকে সম্ভাবনা ও তার যথার্থতা মূল্যায়ন করুন।
মুস্তাফিজুর রহমান : জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট করা হয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সূত্র ধরে। মনে রাখতে হবে, এটা ৬.৪ শতাংশের ওপরে করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে উন্নয়ন প্রশাসনের বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা খুবই কষ্টকর হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করাটা অসম্ভব নয়। তবে নিশ্চিতভাবে এটা চ্যালেঞ্জিং। ৭.২ শতাংশ টার্গেট পূরণের জন্য যে ধরনের জনপ্রশাসন প্রয়োজন তা কি আছে? টার্গেট পূরণ করতে হলে বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। জ্বালানি সমস্যা সমাধান করার বিকল্প নেই। সামগ্রিক বিবেচনা করে বলতে হবে- এটা দুরূহ। চ্যালেঞ্জিং। প্রশ্ন হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা। অনুকূল অবস্থা বজায় থাকা সাপেক্ষে আমরা যদি ৭.২ শতাংশ না হোক তার কাছাকাছিও অর্জন করতে পারি, তাহলেও আমাদের অর্থনীতিতে বড় অর্জন হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মূল্যস্ফীতি এখনই ৯ শতাংশের বেশি। বাজেটে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে তাকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার। কতটা সম্ভব হবে?
মুস্তাফিজুর রহমান : মূল্যস্ফীতি কমের দিকে থাকবে। মূল্যস্তর একটা পর্যায়ে আছে। চালের মূল্য এখন স্থিতিশীল। খাদ্যমূল্য কম হারে বাড়বে। তবে তা ৭ থেকে ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পারে। আরেকটা কথা- মূল্যস্তর তো এমনিতেই উঠে আছে। এটা অব্যাহত থাকলে জনগণের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে সরকারের নজর দিতে হবে। তবে সংযত করার চেষ্টা চলছে।
কালের কণ্ঠ : অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তার ফলাফল কী হতে পারে?
মুস্তাফিজুর রহমান : ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থায়ন হবে। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকেও নেওয়া হবে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের পারফরম্যান্সও বেশ ভালো। এনবিআরকে সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। তাদের জনবল ও প্রযুক্তি সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে। সংস্কারের চেষ্টা চলছে। এর পরও ঘাটতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারলে ভালো হবে। সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্তি কম হবে। আবার ঋণের বিপরীতে সুদের হার পজিটিভ হতে হবে। সম্পদ আহরণের খাতগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকাতে হবে। নতুন করে ভাবতে হবে এগুলোর ব্যাপারে।
কালের কণ্ঠ : ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা স্থির রেখে ন্যূনতম কর দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় কী প্রতিফলন ঘটবে বলে আপনি মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : আমরা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের পক্ষ থেকেও সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিলাম এ ধাপটা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা হোক। এটা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত করা হলে ভালো হতো। দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা অনেকের আছে। তবে কর দেওয়ার জন্য মানুষকে উৎসাহী করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : জনপ্রশাসন, বিবিধ এবং সুদ পরিশোধে বরাদ্দ অধিক। এতে উন্নয়নে কী প্রভাব পড়তে পারে?
মুস্তাফিজুর রহমান : বাজেটের বড় একটি অংশ চলে যায় এসব খাতে। ব্যয়ের ৮০ শতাংশই চলে যায় সুদ, পরিসেবা, জনপ্রশাসন, ভর্তুকি ইত্যাদি খাতে। এগুলো তো বিনিয়োগ নয়। তবে আমরা যদি সম্পদ সৃষ্টি করতে পারতাম, তাহলে অসুবিধা হতো না। পাবলিক এঙ্পেন্ডিচার সংস্কারের কথা শুনি না। কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তাদের মাধ্যমে সংস্কার করার সুযোগ নিতে হবে। এনবিআরে লোকবল বাড়িয়ে বেশি কর আদায় করা সম্ভব হবে। দেখতে হবে লোকবলের মধ্যে দক্ষ শক্তি কেমন বাড়ছে। তাহলে বিনিয়োগও বাড়বে। ভর্তুকি যৌক্তিক করতে হবে। অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রেও দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। অর্থের প্রাপ্তি ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয়ে বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের দিকটি আমাদের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের মতো এ খাতটিও গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। এবার জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ কমেছে। কিন্তু টাকার অঙ্কে এটা কমেনি। সবচেয়ে বড় কথা, টাকার ব্যবহার কিভাবে হচ্ছে। টাকাটা সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর দিতে হবে। সেখানেও দক্ষতার কথা এসে যায়।
কালের কণ্ঠ : রপ্তানিকারকরা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উৎসে কর দিতে বাধ্য হবেন। আমদানিকে উৎসাহী এবং রপ্তানিকে নিরুৎসাহ করার প্রচেষ্টা অর্থনীতিতে কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : ইউরো জোন নিয়ে এখন চাপ আছে। তাই দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কমিয়ে আনতে পারলে ভালো। উৎসে কর দাতারা কিছু সুযোগ পেয়ে থাকেন। সেই সুযোগ এখনো টিকে থাকবে।
কালের কণ্ঠ : টিসিবিকে তহবিল দেওয়া হয়নি। ব্যাংক গ্যারান্টির প্রয়োজনে তাকে ১৪ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। অথচ খাদ্য আমদানিকারকরা ১০ শতাংশ সুদে ঋণসুবিধা পান। এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান নিয়ে সরকার কিভাবে প্রতিষ্ঠানটির সেবা সম্প্রসারণ
করবে?
মুস্তাফিজুর রহমান : সরকারের আরো প্রতিষ্ঠান আছে। টিসিবিকে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটিকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সম্প্রসারণ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : প্রতিযোগিতা আইন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুস্তাফিজুর রহমান : বাজার অন্যায়ভাবে কার্যকর হলে সে ক্ষেত্রে আইনি সুবিধা পেতে গেলে এটা মন্দ হবে না। পাস হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের জনবল থাকতে হবে। আইন হলেই কী হবে? বিদেশের বাজারদরও দেখতে হবে। বিনিময় হারটিও বিবেচনা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বিষয়টিও জড়িত।
কালের কণ্ঠ : প্রায় দুই কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। তারা ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয়। আবার ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : মোবাইল ফোন এখন সাধারণ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস। অনেক কর দেওয়া হচ্ছে মূল্য সংযোজন করের আওতায়। তার
বিনিময়েই আরো সার্ভিস পাওয়া উচিত। আমি মনে করি, মোবাইলের ওপর আর কর বাড়ানো ঠিক হবে না।
কালের কণ্ঠ : ঘোষিত বাজেট পুঁজিবাজার সংকট নিরসনে কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মুস্তাফিজুর রহমান : পুঁজিবাজার সহায়ক তেমন দিকনির্দেশনা এখানে নেই বললেই চলে। মনে রাখতে হবে, বাজেট দিয়েই সব হয় না। এসইসি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। কার্যকর হলে কিছুটা সুপ্রভাব পড়বে এ খাতে। দেখুন না, তদন্ত কমিটি করা হলো। তারা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। সরকার তো কোনো ফলোআপ করল না। এতে কুপ্রভাব তো পড়তেই পারে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না করতে পারলে হবে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ এবং সে ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মুস্তাফিজুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments