চলচ্চিত্র ‘শিল্পে’র উন্নতিতে... by নাজমুল হাসান দারাশিকো

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১০ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ বিষয়ে ঘোষণা দেন এবং ৩ মে তারিখে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই মৌখিক স্বীকৃতি স্থায়ী রূপ পেল। এ ঘোষণায় চলচ্চিত্র নির্মাণসংক্রান্ত কাজে জড়িত ব্যক্তিরা আনন্দিত হয়েছেন-
এফডিসিতে নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে এমন সংবাদও পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এফডিসি-র সীমানার বাইরে রাস্তার পাশে বিশাল ডিজিটাল ব্যানার লাগানো হয়েছে, সেখানে লেখা রয়েছে- ‘চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন।’

দীর্ঘদিন ধরে স্থবির এবং ক্রমশই নিস্তেজ হতে যাওয়া চলচ্চিত্র ক্ষেত্রকে বাঁচানোর জন্য সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। ভারতীয় সিনেমা আমদানির মাধ্যমে দেশীয় শিল্প উন্নতি করার চেষ্টা থেকে সরে এসে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করার মতো সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের পক্ষ থেকেও আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। কিন্তু চলচ্চিত্রের উন্নয়নে ‘শিল্প’ হিসেবে এই স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়।

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, শিল্পী, কলাকুশলিদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও চলচ্চিত্রশিল্পের নবজাগরণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্রশিল্প নির্মাণ ও প্রদর্শনসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করছে। চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান নিঃসন্দেহে বেশ সুখকর। সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসাকে আরো বিকশিত হবার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যবসা খাতকে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করে। কোনো ব্যবসাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করার ফলে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদী ঋণ গ্রহণ, কর অবকাশসহ বিভিন্ন রকম সুবিধা দেয়া হয় এসব ব্যবসায়ীকে। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।

চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ফলে এসব সুবিধা এখন থেকে সিনেমা নির্মাতারাও পাবেন বলে আশা করা যায়। চলচ্চিত্র নির্মানে ব্যাংক ঋণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল নির্মাতারা। ফলে প্রায় ৭০ লাখ থেকে শুরু করে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে যে সিনেমাগুলো নির্মিত হয়, তার পুরোটাই ব্যক্তিপ্রচেষ্টায় সংগ্রহ করতে হয়। সহজ শর্তে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারায় সম্ভাবনাময়ী নতুন নির্মাতারা এগিয়ে আসতে পারছেন না। হয়তো এই অবস্থার দিন শেষ হয়ে এলো।

চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযুক্তির ভূমিকা বলাবাহুল্য। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণেই আমরা চলচ্চিত্র নামক কলার দর্শক হতে পেরেছি। চলচ্চিত্রের অগ্রগতির বিভিন্ন ধাপগুলো বিশ্লেষণ করলে এই প্রযুক্তিরই উন্নয়ন ও প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বালাদেশের সিনেমাজগতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি বেশিরভাগই পুরানো যা বর্তমান বিশ্বে নির্মিত সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমান কারিগরীমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্ষম নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে নির্মিত তুলনামূলক ভালো চলচ্চিত্রগুলোর প্রায় সবই মুদ্রণসংক্রান্ত কাজের জন্য ভারতের মাদ্রাজের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা এদেশে সিনেমা নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধিই করে। স্বল্প ব্যয়ে ভালো সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সদ্যঘোষিত শিল্পখাতের এই দিকটির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন, তাহলে হয়তো বেসরকারি উদ্যোগেই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে উঠবে।

সিনেমা নির্মাণে বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত প্রযুক্তির আরেকটি রূপ হলো ডিজিটাল সিনেমা। ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল সিনেমা প্রদর্শনের জন্য সরকার মোরশেদুল ইসলামের 'প্রিয়তমেষু'-কে অনুমতি দিয়ে আরেকটি নতুন দিক উন্মোচনে করেছেন ২০০৯ সালে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি ডিজিটাল সিনেমাকে সেন্সরবোর্ডের মাধ্যমে মুক্তিদানের অনুমতি ব্যতীত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা এখন পর্যন্ত প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে সিনেমা নির্মাণব্যয় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং প্রণোদনা পেলে বাংলাদেশের মেধাবী সন্তানেরা এদেশের সিনেমা শিল্পকে কার্যকরি ও লাভজনক শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করবে বলেই আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত, এই নীতিমালার অভাব শুধু ডিজিটাল সিনেমার ক্ষেত্রেই নয়, ফিল্ম ফরম্যাটে তৈরি সিনেমার ক্ষেত্রেও সমানভাবে লক্ষ্যণীয়।

নির্মিত সিনেমা প্রদর্শনের জন্য উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে পাশের দেশ ভারত, এমনকি কলকাতায়ও বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে, আমরা তখন যুদ্ধ করছি আমাদের জরাজীর্ণ সিনেমাহলগুলোকে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখতে। মাল্টিপ্লেক্স এবং ডিজিটাল প্রজেকশন এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের সব সিনেমা হলেই পর্দার সংখ্যা একটি। মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাহলে এই পর্দার সংখ্যা একাধিক- চার থেকে ১৪টি পর্দা থাকে। বাংলাদেশের একমাত্র মাল্টিপ্লেক্স স্টার সিনেপ্লেক্সে পর্দার সংখ্যা চারটি। মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাহলের কল্যাণে একই স্থানে একাধিক সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ থাকে যা একদিকে যেমন নির্মাতার জন্য সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, অন্যদিকে তেমনি প্রদর্শককে অধিকতর ব্যবসা নিশ্চিত করে। তাছাড়া, বাংলাদেশে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য সিনেমা হল ঢাকা শহরে মাত্র দুই থেকে তিনটি, অন্যান্য বিভাগীয় শহরে বড়জোর একটি। প্রয়োজনীয় পরিবেশের অভাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী সম্পূর্ণই হলবিমুখ। এই শ্রেণীকে হলে ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু গুণগতমানের সিনেমাই যথেষ্ট নয়, সেই  সিনেমা উপভোগের জন্য মানসম্পন্ন সিনেমা হলও চাই।  মাল্টিপ্লেক্সের মাধ্যমে এই শ্রেণীর প্রয়োজন মেটানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত।

শুধু পর্দার সংখ্যা বাড়ালেই মাল্টিপ্লেক্স করা সম্ভব হয় না, এর সঙ্গে আলো বিভিন্ন দিকের উন্নয়ন করতে হয়। সাধারণত মাল্টিপ্লেক্সের ভবনটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয় যেন সব ধরনের দর্শক কিছু সাধারণ সুবিধা যেমন টয়লেট, ক্যান্টিন, পার্কিং ইত্যাদি ভোগ করতে পারে। ফলে মাল্টিপ্লেক্সে রূপান্তরের জন্য সম্পূর্ণ নকশা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে। এ কারণে, বর্তমানে চালু সিনেমা হলগুলোর কোনটিকে মাল্টিপ্লেক্সে রূপান্তরের উদ্দেশ্য হয়তো পুরো এক বছর সময় ও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রথম মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হয় ১৯৯৭ সালে, নয়া দিল্লিতে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ভিলেজ রোডশো-র সঙ্গে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রিয়া এক্সিবিটরস লিমিটেড চুক্তিবদ্ধ হয়ে একটি চালু সিনেমাহলকে নতুনভাবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে মাল্টিপ্লেক্সে রূপান্তর করে, নতুন নাম হয় 'পিভিআর অনুপম'। গত দশ বছরে দিল্লির সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনকারী সিনেমাহলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই "পিভিআর অনুপম'।

ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে সরকারের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় এই মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপের বিশ্লেষণে। ২০০০ সাল পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণে সরকার বিশেষ সুবিধা দেয়। এর অন্যতম হলো পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফ করা। এর পূর্বে নুতুন নির্মিত সিনেমা হলগুলোর জন্য এই কর ছিল প্রায় ৭৫ শতাংশ। বলাবাহুল্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছে, বিভিন্ন রাজ্যে চেইন মাল্টিপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নেও মাল্টিপ্লেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০০৬-০৭ সালে ভারতের সঙ্গে আমদানি শর্ত শিথিল করার পরে এবং পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফের সিদ্ধান্ত এ শিল্পের পালে হাওয়া বইতে শুরু করে। ভারত কর্তৃক গৃহীত এই সিদ্ধান্তের ফলাফল আরো বিস্তৃত। যৌথ বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মাল্টিপ্লেক্স ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে পরবতী সময়ে স্টক মার্কেটে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ সরকার হয়তো এ থেকে উদ্ধুদ্ধ হতে পারে। সিনেমা দর্শকদের উন্নয়নে মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণের পাশাপাশি শহর ও মফস্বল অঞ্চলের সিনেমাহলগুলোর উন্নয়নে ঋণ এবং কর মওকুফ সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে পারে।

দর্শকদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তরুণ নির্মাতাদের এগিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম তাদের সিনেমার চোখ এবং মানসিকতা তৈরি করেছে উন্নত বিশ্ব বিশেষত আমেরিকান, ইউরোপিয়ান এবং দূরপ্রাচ্যের সিনেমা দেখে। এরা একই গল্পে প্রেম-বিরহ, পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় একটি সামাজিক-অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণের চেয়ে বিভিন্ন ধারা যেমন ড্রামা, থ্রিলার, কমেডি ইত্যাদি সিনেমা নির্মাণে বেশি আগ্রহী। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হওয়া এই তরুণ প্রজন্মের মেধাকে বিকশিত করার সুযোগ প্রদানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তির সহলভ্যতা ও প্রদর্শন সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য

সিনেমাহলগুলোতে ডিজিটাল প্রজেকশন ব্যবস্থা প্রয়োজন। সুখের খবর, বেসরকারি উদ্যোগে দেশের কিছু সিনেমা হলে ডিজিটাল প্রজেকশন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারি প্রণোদনা এই উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করবে। উল্লেখ্য, ডিজিটাল প্রজেকশন শুধু সিনেমাকে অধিকতর উপভোগ্যই করে না, এর মাধ্যমে সিনেমার পাইরেসিও অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

সিনেমা শুধু বিনোদিত করে না, সিনেমা মানুষকে শিক্ষিতও করে। গত শতকের গোড়ার দিকে কম্যুনিজমের আদর্শ ও শিক্ষা রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাহায্য নেয়া হয়েছিল সিনেমার। একশ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার যদি দেশের মানুষের শিক্ষা-মানসিকতার উন্নয়নে এই প্রযুক্তির ব্যবহার যথাযথ করতে পারে, তবেই শিল্প ঘোষণার সার্থকতা। অন্যথায়, এই ঘোষণা হবে শুধুই নির্বাচনী প্রস্তুতির হাতিয়ার, আর প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হবে শুধুই তৈলমর্দন।

নাজমুল হাসান দারাশিকো: ব্লগার। চলচ্চিত্র বিষয়ে বাংলা ভাষায় বিশেষায়িত ব্লগের (darashiko.com) লেখক।
                                       darashiko@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.