বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং করণীয় by ড. জাহাঙ্গীর আলম
জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'জার্মান ওয়াচের' তত্ত্বাবধানে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। এতে বলা হয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এরপর ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার শীর্ষে আরো যেসব দেশ রয়েছে তার মধ্যে আছে মিয়ানমার, হন্ডুরাস,
নিকারাগুয়া, হাইতি, ভিয়েতনাম, ডমিকান ও পাকিস্তান। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সঙ্গিন এ জন্য যে এখানে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোনের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। তাই জীবন ও জীবিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি।
বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। এর বেশির ভাগ এলাকাই নিম্ন প্লাবনভূমি। একসময় এ অঞ্চলটি জেগে উঠেছিল সমুদ্র থেকে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষের বাড়িঘর সমুদ্রসীমা থেকে ১০ মিটারের কম উচ্চতায় অবস্থিত। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানি উষ্ণ হচ্ছে। উচ্চতা বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের। তাতে বিপর্যয় নেমে আসছে সমুদ্র-তীরবর্তী মানুষের ওপর। অপরদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে নদীর গতিপথের। পরিলক্ষিত হচ্ছে নদীর ভাঙন। তাতেও দেখা দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। পানি সেচ বিঘি্নত হচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও খরার প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষির উৎপাদন। তদুপরি ঘন ঘন বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঠের ফসল। মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন রোগের আক্রমণে ও ক্ষুধায় স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। এদের দারিদ্র্য বাড়ছে। অনেকেই পরিণত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তুতে।
ইদানীং সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ নিয়ে অনেক গবেষণা, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশ ও মানুষ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এর পেছনে রয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, যা জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তা করছে। গ্রিনহাউস হলো শীতপ্রধান দেশের স্বচ্ছ আচ্ছাদনবিশিষ্ট কাচের বা মোটা পলিথিনের ঘর, যাতে সূর্যের রশ্মি সহজেই ঢুকতে পারে; কিন্তু এ রশ্মি বেরিয়ে আসতে পারে না সহজে। ফলে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে সবজির চাষ হয়। বাহির থেকে ঘরটিকে সবুজ দেখায় বলে এটাকে চিহ্নিত করা হয় গ্রিনহাউস হিসেবে। আস্তে আস্তে এ ঘরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এটি হচ্ছে গ্রিনহাউস এফেক্ট বা প্রতিক্রিয়া। তেমনিভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে সূর্যের রশ্মি এসে আটকে থাকায় ধীরে ধীরে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রিনহাউস গ্যাস। এর অন্যতম হচ্ছে জলীয়বাষ্প। তা ছাড়া আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেইন (CH4), ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC) এবং ওজোন (O3) গ্যাস। এগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণকৃত সূর্যের রশ্মি শোষণ করে নেয় এবং ভূপৃষ্ঠকে উষ্ণ করে রাখে। মানুষের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন- কলকারখানা স্থাপন ও বৃক্ষরাজি নিধনের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আবার পানি সেচের কারণে ধান গাছের কাণ্ড ও পাতা পচে গিয়ে এবং গবাদিপশু প্রতিপালন করে এর বর্জ্য থেকে নির্গত হয়ে বেড়ে যায় মিথেইন গ্যাস। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাও। তাতে দিনের পর দিন পৃথিবীপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পরিবর্তন ঘটছে আবহাওয়ার। পৃথিবীপৃষ্ঠে নেমে আসছে দুর্যোগ। ঘন ঘন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ভূমিধস, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন এর উদাহরণ। তাতে অহরহ শস্যহানি ঘটছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণায়নের ফলে ধীরে ধীরে মেরু অঞ্চলের হিমবাহ বা বৃহৎ বরফ খণ্ড গলে যাচ্ছে। এই বরফগলা পানি পতিত হচ্ছে সাগরে, মহাসাগরে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পানির উচ্চতা। ফলে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয়ের কাছে। এর বরফগলা পানি পতিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর। প্লাবিত হচ্ছে কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরগুনা, পটুয়াখালী ও খুলনার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। তা ছাড়া সাগরের লোনা পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে, ক্ষেতে-খামারে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসল। বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর অন্য উপকূলীয় দেশগুলো যেমন- মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও নেদারল্যান্ডস এখন এরূপ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তবে এসব দেশে ক্ষতির আশঙ্কা কম। বাংলাদেশে অনেক বেশি।
২০১২ সালে এ চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিশ্ব পরিবেশনীতি বিরূপ হবে, এ নিয়ে আলোচনা হয় ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত ইউএনএফসিসির ১৩তম সম্মেলনে। এতে গ্রহণ করা হয় চার দফা 'বালি অ্যাকশন প্ল্যান'। আশা করা গিয়েছিল, ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি আইনগত বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর বিরোধিতার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। এরপর ২০১০ সালে কানকুনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া যায়নি। তবে এতে ১০০ কোটি ডলার সংগ্রহের মাধ্যমে একটি 'গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড' গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই তহবিল থেকে সহায়তা পাবে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে তা নিশ্চিত করা হয়। এ সম্মেলনে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে আলোচনা শুরু হবে এবং ২০১৫ সালে তা চূড়ান্ত রূপ নেবে। এ চুক্তি কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং উন্নয়নশীল দেশ ভারত বিরোধিতা করে। তবে চীনের ইতিবাচক ভূমিকা থাকায় শেষ পর্যন্ত ১৭তম ডারবান জলবায়ু সম্মেলন সব দেশের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়।
পৃথিবীপৃষ্ঠে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ৯০ শতাংশেরও বেশি উদগিরণ করছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী গরিব দেশগুলোর শরিকানা ১০ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে বাংলাদেশ নিঃসরণ করছে মাত্র ০.১ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ উৎসারণের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, জীবন ও জীবিকার যে ক্ষতি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই বর্তাচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। বাংলাদেশের স্থান এগুলোর শীর্ষে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. জেমস হানসেন ধারণা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে আগামী এক শতকের মধ্যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যাবে। অবশ্য বাস্তবে কতটুকু কী হবে, তা এখনো আরো গবেষণার বিষয় রয়ে গেছে, যা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে কোনো দূর-ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকা যে জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে, তার সমূহ আশঙ্কা রয়ে গেছে। সুতরাং শাব্দিক অর্থে ড. হানসেনের কথাগুলো বিবেচনা না করে আমাদের এখন একটা সাংঘাতিক বৈরী পরিবেশে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হবে, তার প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বিশ্বের দাতা দেশগুলো গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কতটুকু সহায়তা করবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও কতটুকু দায়িত্ব নেবে, তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে এখন আমাদেরই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে লাগাতার চাপ দিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর ওপর, যাতে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা আমরা পাই।
বাংলাদেশে ভূপৃষ্ঠ উষ্ণায়নের তাৎক্ষণিক অভিঘাত প্রধানত দুটি। এক. কৃষির উৎপাদন বিঘি্নত হওয়া, দুই. উদ্বাস্তু সমস্যা। কৃষির উৎপাদন নিরন্তর অব্যাহত রাখা এবং তা টেকসই করার জন্য লোনা পানিতে উৎপাদনক্ষম এবং খরাসহিষ্ণু শস্যের জাত ও গোখাদ্য উদ্ভাবন করতে হবে। প্রতিকূল পরিবেশে উৎপাদন ও লালন-পালনের উপযোগী করে উদ্ভাবন করতে হবে নতুন জাতের পশুপাখি। সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে অধিক উৎপাদনক্ষম ও নতুন জাতের গাছপালাসমৃদ্ধ বনরাজি। এ ক্ষেত্রে জীব-প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হতে পারে। অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের অভ্যন্তরে স্থানসঙ্কুলান ও কর্মসংস্থান করা যাবে না বিধায় অল্প জনঘনত্বসম্পন্ন উন্নত দেশগুলোতে তাদের অভিপ্রয়াণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমঝোতা প্রয়োজন।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ
Email : alamj52@gmail.com
বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ। এর বেশির ভাগ এলাকাই নিম্ন প্লাবনভূমি। একসময় এ অঞ্চলটি জেগে উঠেছিল সমুদ্র থেকে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষের বাড়িঘর সমুদ্রসীমা থেকে ১০ মিটারের কম উচ্চতায় অবস্থিত। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানি উষ্ণ হচ্ছে। উচ্চতা বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের। তাতে বিপর্যয় নেমে আসছে সমুদ্র-তীরবর্তী মানুষের ওপর। অপরদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত অনেক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে নদীর গতিপথের। পরিলক্ষিত হচ্ছে নদীর ভাঙন। তাতেও দেখা দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। পানি সেচ বিঘি্নত হচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও খরার প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষির উৎপাদন। তদুপরি ঘন ঘন বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঠের ফসল। মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে অহরহ। বিভিন্ন রোগের আক্রমণে ও ক্ষুধায় স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। এদের দারিদ্র্য বাড়ছে। অনেকেই পরিণত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তুতে।
ইদানীং সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ নিয়ে অনেক গবেষণা, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশ ও মানুষ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এর পেছনে রয়েছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, যা জলবায়ু পরিবর্তনে সহায়তা করছে। গ্রিনহাউস হলো শীতপ্রধান দেশের স্বচ্ছ আচ্ছাদনবিশিষ্ট কাচের বা মোটা পলিথিনের ঘর, যাতে সূর্যের রশ্মি সহজেই ঢুকতে পারে; কিন্তু এ রশ্মি বেরিয়ে আসতে পারে না সহজে। ফলে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে সবজির চাষ হয়। বাহির থেকে ঘরটিকে সবুজ দেখায় বলে এটাকে চিহ্নিত করা হয় গ্রিনহাউস হিসেবে। আস্তে আস্তে এ ঘরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এটি হচ্ছে গ্রিনহাউস এফেক্ট বা প্রতিক্রিয়া। তেমনিভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে সূর্যের রশ্মি এসে আটকে থাকায় ধীরে ধীরে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রিনহাউস গ্যাস। এর অন্যতম হচ্ছে জলীয়বাষ্প। তা ছাড়া আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2), মিথেইন (CH4), ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC) এবং ওজোন (O3) গ্যাস। এগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বিকিরণকৃত সূর্যের রশ্মি শোষণ করে নেয় এবং ভূপৃষ্ঠকে উষ্ণ করে রাখে। মানুষের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন- কলকারখানা স্থাপন ও বৃক্ষরাজি নিধনের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আবার পানি সেচের কারণে ধান গাছের কাণ্ড ও পাতা পচে গিয়ে এবং গবাদিপশু প্রতিপালন করে এর বর্জ্য থেকে নির্গত হয়ে বেড়ে যায় মিথেইন গ্যাস। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাও। তাতে দিনের পর দিন পৃথিবীপৃষ্ঠের উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পরিবর্তন ঘটছে আবহাওয়ার। পৃথিবীপৃষ্ঠে নেমে আসছে দুর্যোগ। ঘন ঘন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ভূমিধস, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন এর উদাহরণ। তাতে অহরহ শস্যহানি ঘটছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণায়নের ফলে ধীরে ধীরে মেরু অঞ্চলের হিমবাহ বা বৃহৎ বরফ খণ্ড গলে যাচ্ছে। এই বরফগলা পানি পতিত হচ্ছে সাগরে, মহাসাগরে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পানির উচ্চতা। ফলে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয়ের কাছে। এর বরফগলা পানি পতিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর। প্লাবিত হচ্ছে কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরগুনা, পটুয়াখালী ও খুলনার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। তা ছাড়া সাগরের লোনা পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে, ক্ষেতে-খামারে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসল। বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর অন্য উপকূলীয় দেশগুলো যেমন- মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও নেদারল্যান্ডস এখন এরূপ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তবে এসব দেশে ক্ষতির আশঙ্কা কম। বাংলাদেশে অনেক বেশি।
২০১২ সালে এ চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিশ্ব পরিবেশনীতি বিরূপ হবে, এ নিয়ে আলোচনা হয় ২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত ইউএনএফসিসির ১৩তম সম্মেলনে। এতে গ্রহণ করা হয় চার দফা 'বালি অ্যাকশন প্ল্যান'। আশা করা গিয়েছিল, ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি আইনগত বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর বিরোধিতার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। এরপর ২০১০ সালে কানকুনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া যায়নি। তবে এতে ১০০ কোটি ডলার সংগ্রহের মাধ্যমে একটি 'গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড' গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই তহবিল থেকে সহায়তা পাবে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে তা নিশ্চিত করা হয়। এ সম্মেলনে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে আলোচনা শুরু হবে এবং ২০১৫ সালে তা চূড়ান্ত রূপ নেবে। এ চুক্তি কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং উন্নয়নশীল দেশ ভারত বিরোধিতা করে। তবে চীনের ইতিবাচক ভূমিকা থাকায় শেষ পর্যন্ত ১৭তম ডারবান জলবায়ু সম্মেলন সব দেশের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়।
পৃথিবীপৃষ্ঠে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ৯০ শতাংশেরও বেশি উদগিরণ করছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী গরিব দেশগুলোর শরিকানা ১০ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে বাংলাদেশ নিঃসরণ করছে মাত্র ০.১ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ উৎসারণের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, জীবন ও জীবিকার যে ক্ষতি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই বর্তাচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। বাংলাদেশের স্থান এগুলোর শীর্ষে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. জেমস হানসেন ধারণা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে আগামী এক শতকের মধ্যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যাবে। অবশ্য বাস্তবে কতটুকু কী হবে, তা এখনো আরো গবেষণার বিষয় রয়ে গেছে, যা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে কোনো দূর-ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকা যে জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে, তার সমূহ আশঙ্কা রয়ে গেছে। সুতরাং শাব্দিক অর্থে ড. হানসেনের কথাগুলো বিবেচনা না করে আমাদের এখন একটা সাংঘাতিক বৈরী পরিবেশে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হবে, তার প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বিশ্বের দাতা দেশগুলো গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কতটুকু সহায়তা করবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও কতটুকু দায়িত্ব নেবে, তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে এখন আমাদেরই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে লাগাতার চাপ দিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর ওপর, যাতে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা আমরা পাই।
বাংলাদেশে ভূপৃষ্ঠ উষ্ণায়নের তাৎক্ষণিক অভিঘাত প্রধানত দুটি। এক. কৃষির উৎপাদন বিঘি্নত হওয়া, দুই. উদ্বাস্তু সমস্যা। কৃষির উৎপাদন নিরন্তর অব্যাহত রাখা এবং তা টেকসই করার জন্য লোনা পানিতে উৎপাদনক্ষম এবং খরাসহিষ্ণু শস্যের জাত ও গোখাদ্য উদ্ভাবন করতে হবে। প্রতিকূল পরিবেশে উৎপাদন ও লালন-পালনের উপযোগী করে উদ্ভাবন করতে হবে নতুন জাতের পশুপাখি। সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে অধিক উৎপাদনক্ষম ও নতুন জাতের গাছপালাসমৃদ্ধ বনরাজি। এ ক্ষেত্রে জীব-প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হতে পারে। অন্যদিকে উদ্বাস্তুদের জন্য দেশের অভ্যন্তরে স্থানসঙ্কুলান ও কর্মসংস্থান করা যাবে না বিধায় অল্প জনঘনত্বসম্পন্ন উন্নত দেশগুলোতে তাদের অভিপ্রয়াণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমঝোতা প্রয়োজন।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ
Email : alamj52@gmail.com
No comments