সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে কাণ্ড-১৬ কোটি মানুষের দেশে সুবিধাভোগী ২০ কোটি by আশরাফুল হক রাজীব

বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে। ৬৯টি কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজে কোনো সমন্বয় নেই। সুবিধাভোগীর সংখ্যা সাত থেকে আট কোটি হওয়ার কথা থাকলেও এ সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়েছে। অথচ অনেক হতদরিদ্র মানুষ এসব কর্মসূচির সুবিধা পায় না। আবার অনেক সৌভাগ্যবান একাধিক কর্মসূচির সুবিধা নিচ্ছে।


ফলে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি হলেও সুবিধাভোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ভিজিডি, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচির নীতিমালায় বলা হয়েছে, একজন একটি কর্মসূচির সুবিধা পেলে আর কোনো সরকারি কর্মসূচির সুবিধা পাবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) মতে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচির পেছনে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে সরকার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নকাজ বাদ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালানো হয়। বিভিন্ন কর্মসূচির ৫৮ শতাংশ সুবিধাভোগী জানিয়েছেন, এ ধরনের কর্মসূচি তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু না কিছু ভূমিকা রাখলেও এ সুবিধা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়। কুড়িগ্রাম, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, বরগুনা, সাতক্ষীরা- এ সাত জেলায় পিপিআরসি সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে গবেষণা করছে। গবেষণা থেকে জানা গেছে, এসব কর্মসূচিতে যেসব সুবিধাভোগী দেখানো হয় এর ২০ শতাংশ ভুয়া। অর্থাৎ ২০ কোটি সুবিধাভোগী হলে এর দুই কোটি ভুয়া। কর্মসৃজন কর্মসূচির ২৪ শতাংশ লোক কাজ পাওয়ার যোগ্য নয় বা উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর (টার্গেট পিপল) মধ্যে পড়ে না। অনেক কর্মসূচির উদ্দিষ্ট সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার আগেই কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয় বলেও পিপিআরসির গবেষণায় উঠে আসে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন কর্মসূচির সেবা বিনা মূল্যে তাদের পাওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে ঘুষ দেয় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। বিভিন্ন কর্মসূচিতে ছয় থেকে ২৪ ভাগ সুবিধাভোগী রয়েছে, যারা কোনোভাবেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পেতে পারে না। বিভিন্ন কর্মসূচিতে ২০ ভাগ সুবিধাভোগী রয়েছে, বাস্তবে যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এসব ভুতুড়ে সুবিধা নিচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঞাও একজনের একাধিক সুবিধা ভোগ করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সুবিধা পাওয়ার যোগ্য, এমন কোনো লোক যেন এসব কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এর পরও একজন একাধিক কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করছে। পাশাপাশি অন্যজন কোনো কর্মসূচিতেই নেই।' সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট তথ্যভাণ্ডার বা ডেটাবেইস তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।'
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা অর্থের ৩০ ভাগ ব্যয় করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ। এ কর্মসূচি এবং ত্রাণ বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এ কর্মসূচির দ্বৈততা পরিহার করা সম্ভব হয় না। ডেটাবেইস হলে এটা দূর করা সম্ভব। একটি কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করলে অন্যটির সুবিধা ভোগ করা যাবে না, নীতিমালার এ অংশটি বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সরকার সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন ৬৯টি কর্মসূচির কথা বলা হয়। এত বেশি কর্মসূচির দরকারই নেই। কর্মসূচি কমিয়ে আনা গেলে তদারকি ভালো হবে। দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাচ্ছে সরকার। এত দিনেও উপকারভোগী কারা এর তালিকা নেই সরকারের কাছে। এটা সরকারি কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাব বলে তিনি মনে করেন। ড. মাহবুব বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ২০ থেকে ২৫ ভাগ অপব্যবহার হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটা ৫০ ভাগও হয়ে থাকে। যাদের এসব সুবিধা পাওয়ার কথা তারা পায় না। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানরা তালিকা তৈরির সময় অনুসারীদের প্রাধান্য দেন।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০১০-১১ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বছরে ৬৯টি কর্মসূচির আওতায় তিন কোটি ৪১ লাখ পরিবারের ২০ কোটি ২৫ লাখ ৯১ হাজার ১৮৩ জন সুবিধা পেয়েছে। ৫৫ হাজার ৮৪৬টি প্রতিষ্ঠানও গত অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা নিয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে সুবিধাভোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগী ছিল এক কোটি ৩৫ লাখ পরিবারের ৯ কোটি ২৬ লাখ ৪৯ হাজার জন। ২০১০-১১ অর্থবছরে এসব কর্মসূচিতে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
দারিদ্র্য বিমোচন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের সময় দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০ শতাংশ। এই হিসাবে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ছয় কোটি ছিল দরিদ্র লোক। বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দারিদ্র্যের হার কমে ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সেই হিসাবে এখন দেশের চার কোটি ৭২ লাখ মানুষ দরিদ্র। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেওয়া। সেই হিসাবে সর্বোচ্চ ছয় কোটি মানুষকে এ সহায়তা দিলেই নিরাপত্তা বেষ্টনীর উদ্দেশ্য সফল হওয়ার কথা। কিন্তু একক হিসাবে ২০ কোটি ২৫ লাখ মানুষ এসব কর্মসূচির সহায়তা পাচ্ছে- যা মোট জনসংখ্যার চেয়ে পাঁচ কোটি বেশি।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, সব মিলিয়ে সাত থেকে আট কোটি মানুষ এ সুবিধার আওতায় আসতে পারে। এটাই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আদর্শ সংখ্যা। এ পরিমাণ মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হলে দেশের দারিদ্র্যের চেহারা বদলে যাবে। কিন্তু ২০ কোটির বেশি মানুষ এ কর্মসূচির সেবা পাওয়ার অর্থ হলো- একজন ব্যক্তি একাধিক কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে। আবার পাশাপাশি সমাজের অন্য একজন মানুষ দরিদ্র হওয়ার পরও কোনো সহায়তা পাচ্ছে না।
২০ কোটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, 'সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে ভর্তুকি দেয়। কর্মসূচির উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীরও (টার্গেট পিপল) ভিন্নতা রয়েছে। ফলে সুবিধাভোগীর তালিকা করা বেশ জটিল, তবে অসম্ভব নয়। সরকারের বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে একই ব্যক্তি একাধিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেগুলো দ্বৈততা হলেও গ্রহণযোগ্য। তবে অনেক লোক রয়েছে, যারা কোনোভাবেই অন্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। এরা অনিয়ম ও অনৈতিকভাবে এ সুবিধা নিচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সঠিক তালিকা থাকলে এ ধরনের অনিয়ম বন্ধ করা যেত।'
পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'সরকারের বিশাল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশকে সেবা দিতে পারে। এসব কর্মসূচিতে মনিটরিংয়ের দুর্বলতা রয়েছে। কর্মকর্তাদের মনিটরিংয়ের ইচ্ছারও অভাব রয়েছে। তাঁদের দক্ষতার অভাবও প্রকট। এসব কর্মসূচির ফলাফল কী তাও বিশ্লেষণ করা হয় না।' এ ধরনের কর্মসূচির প্রভাব জানার জন্য পিপিআরসি গবেষণা করছে জানিয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের টাকা দেওয়া হয় বলে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি কিছুটা কমেছে।
জানা গেছে, আগামী বছরের মধ্যে সরকার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। এ জন্য সরকার ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে ৬৯টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ৯টি কর্মসূচির আওতায় ৩০ ভাগ অর্থ ব্যয় করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে- অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) কর্মসূচি, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচি, ভিজিএফ, জিআর (খাদ্যশস্য), শীতবস্ত্র বিতরণ, গৃহনির্মাণ মঞ্জুরি, খয়রাতি সাহায্য বা জিআর (নগদ অর্থ) ও ঢেউটিন বিতরণ। এসব কর্মসূচির অনেকগুলোর নীতিমালায় একজন একাধিক কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করতে পারবে না বলে শর্ত থাকলেও তা মানা হয় না।
জানা যায়, খাদ্য বিভাগের ১০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্বৈততা পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে না বিতরণ-প্রক্রিয়ার জন্য। ওএমএসের চাল কার জন্য, তাদের তালিকা সরকারের কাছে নেই। আবার ডিলাররা কম দামে চাল তুলে দোকানে বিক্রি করে দেন। গরিবের ফেয়ার প্রাইস কার্ডও ডিলারদের কবজায় রয়েছে। তাঁরা এসব কার্ডে কম দামে চাল তুলে বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে দেন।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ সাতটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো- বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ও দুস্থ মহিলা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, সরকারি শিশুপরিবার ও বেসরকারি এতিমখানার জন্য মঞ্জুরি প্রদান। অনেক বয়স্ক ব্যক্তি ভাতা পাওয়ার জন্য সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও পাচ্ছেন না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড় করেও কেউ কেউ সুবিধা নিচ্ছে। ওদিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মানবেতর জীবন যাপন করেন। স্বামীর সংসারে সচ্ছলতা থাকার পরও অনেকে বিধবা সেজে বিধবা ও দুস্থ মহিলা ভাতা নেন। কালের কণ্ঠের পাবনা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার হরিপুর ইউনিয়নের মস্তালীপুর গ্রামের মোজাহার আলীর স্ত্রী কমেলা খাতুন ও ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের দারোগা আলীর স্ত্রী হাওয়া খাতুন কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিধবা ভাতা তুলছেন। এ দুজনের স্বামী থাকার পরও তাঁরা বিধবা ভাতা তুলেছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
৬৯টি কর্মসূচির মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় পাঁচটি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি (আশ্রয়ণ প্রকল্প), পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ছয়টি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ চারটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তিনটি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ছয়টি, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় দুটি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ ১০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনা করছে।

No comments

Powered by Blogger.