শ্রদ্ধাঞ্জলি-হিরণ্ময় এক নারীর কথা by রীনা দাস
সিস্টার মেরিয়ান টেরেসা ২০১১ সালের ১৭ জুন তাঁর অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষিত তীর্থযাত্রায় বাংলাদেশের ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। খ্রিষ্টধর্মের হলিক্রস সিস্টার সংঘের এই ব্রতচারী সিস্টার তাঁর সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের কিশোর ও নারীদের শিক্ষা প্রসারে এবং সংঘের সর্বাত্মক উন্নয়নকল্পে।
বাংলাদেশের অত্যন্ত স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলিক্রস স্কুল ও হলিক্রস কলেজে ষাটের দশক থেকে প্রধান শিক্ষিকা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। যে দুটো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু গতানুগতিক পাঠ্যক্রমের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের সীমিত না রেখে তাদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক গঠনের জন্য কয়েক যুগ ধরে বিরাট ভূমিকা পালন করছে, যার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে-বিদেশে অনেক নারী সুযোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বিশ্বের, দেশের, সমাজের, পরিবারের উন্নতির জন্য অবদান রাখছে। ফ্রান্সের ল্যাঁ ম্যাঁ শহর হলিক্রস সংঘের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কারণ, এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেন এই সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় ফাদার মরো, যিনি ঐশী জ্ঞানে পূর্ণ হয়ে খ্রিষ্টের সেবা ও ত্যাগের নীতি জীবনে ধারণ করে মানবের আধ্যাত্মিক মুক্তিকল্পে প্রতিষ্ঠা করেন হলিক্রস সংঘ।
নিজের জীবনের ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই সংঘকে এমন এক স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন, যা আজ বহু দেশের শত শত ব্রতচারীর ত্যাগ ও কর্মের মহিমায় মহিমান্বিত। সেই ল্যাঁ ম্যাঁ ব্রতচারীদের তীর্থস্থান, যেখানে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের ব্রতচারীরা সমবেত হন এবং পুণ্যভূমিতে নতুন করে জীবনের দর্শন, কর্ম, ত্যাগ ও আদর্শ নানাভাবে মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে ঐশী শক্তিতে পূর্ণ হয়ে আগামী দিনের অঙ্গীকারে বলীয়ান হন। সেই পুণ্য স্থানে যাওয়ার ব্রতচারীদের এক বড় আকাঙ্ক্ষা। সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার অন্তরেও সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল। কলেজের ও সংঘের নানা দায়িত্বের কারণে সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ২০০৯-১০ সালে ধীরে ধীরে কলেজের সংঘের অনেক দায়িত্বভার উত্তরসূরিদের হাতে দিয়ে তাদের পাশে পাশে থেকে পরামর্শদাতার মতো কাজ করছিলেন।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বের একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য উত্তরসূরি তৈরি করা। সুযোগ্য নেতৃত্বের একটি বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে, উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। সিস্টার মেরিয়ান টেরেসা কলেজ এবং সংঘের জন্য উত্তরসূরি তৈরিতে সচেষ্ট ভূমিকা রাখেন।
একটি ছোট দালান নিয়ে কলেজের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার, মিলনায়তন, খেলার স্থান, টিচার্সরুম ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো কলেজকে একটা সুষ্ঠু আকৃতি দান করে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তাও অপ্রতুল হওয়ায় ২০০৭ থেকে শুরু হয় আবারও সম্প্রসারণ। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার শ্রম, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। সবার সঙ্গে রাত-দিন খেটে এক অনিন্দ্যসুন্দর ‘সিস্টার অগাস্টিন মেরি হল’ এবং বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগ তৈরিতে অবদান রাখেন। ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার, মিস্ত্রি—সবার সঙ্গে থেকে কীভাবে একটু সাশ্রয় হয়, কীভাবে আরও মজবুত হয়, কীভাবে সুন্দর হয়—প্রাণপণ তার প্রচেষ্টা করেছেন এবং এসব করতে গিয়ে নিজের বিশ্রাম, আহার, চিকিৎসা—কোনো কিছুই গুরুত্ব দেননি। তাঁর এই অবদান সংঘ এবং কলেজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। যখন সিস্টারের সময় থাকত তখন কলেজের দাদা, দিদি, শিক্ষক, কর্মী—সবার সঙ্গে তাঁদের সব খবরাখবর নিতেন এবং অত্যন্ত আন্তরিকতায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।
সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত সম্মান বোধ ছিল। পরিবারের, প্যারিসের অবদান তিনি তাঁর সেবা, প্রার্থনা দিয়ে স্মরণ করতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে হলিক্রস সিস্টার সংঘ কলেজ এবং সিস্টার বিশেষ সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
সর্বোপরি সিস্টার শুধু সংঘ, কলেজ, পরিবার, সমাজ ও দেশের নন, তিনি বিশ্বমণ্ডলীর নারীদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে তাঁর চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও কর্মকে উৎসর্গ করেন।
তীর্থযাত্রী সিস্টার মেরিয়ান টেরেসা তীর্থস্থান প্রদর্শন করে ওই পবিত্র স্থানে ২০১১ সালের ২৫ জুন পরম আত্মার সঙ্গে মিলিত হন। অনেক তীর্থযাত্রীরই আকাঙ্ক্ষা থাকে, তীর্থস্থানেই যেন তাঁরা পরম শান্তি পেতে পারেন।
সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার অন্তরে সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল কি না জানি না, তবে তাঁর এই মৃত্যু জীবনকালের এক সুন্দরতম পরিসমাপ্তি বলে মনে করি।
বাংলাদেশের নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর নিরলস শ্রম ও প্রচেষ্টা চিরস্মরণীয়।
বিশ্বাস করি, যে সত্য ও সুন্দরকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করার বাণী যুগে যুগে হলিক্রস কলেজ প্রচার করছে, তা সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হোক।
রীনা দাস
অধ্যক্ষ, মার্টিন লুথার কলেজ, ঢাকা
নিজের জীবনের ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই সংঘকে এমন এক স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন, যা আজ বহু দেশের শত শত ব্রতচারীর ত্যাগ ও কর্মের মহিমায় মহিমান্বিত। সেই ল্যাঁ ম্যাঁ ব্রতচারীদের তীর্থস্থান, যেখানে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের ব্রতচারীরা সমবেত হন এবং পুণ্যভূমিতে নতুন করে জীবনের দর্শন, কর্ম, ত্যাগ ও আদর্শ নানাভাবে মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে ঐশী শক্তিতে পূর্ণ হয়ে আগামী দিনের অঙ্গীকারে বলীয়ান হন। সেই পুণ্য স্থানে যাওয়ার ব্রতচারীদের এক বড় আকাঙ্ক্ষা। সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার অন্তরেও সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল। কলেজের ও সংঘের নানা দায়িত্বের কারণে সে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ২০০৯-১০ সালে ধীরে ধীরে কলেজের সংঘের অনেক দায়িত্বভার উত্তরসূরিদের হাতে দিয়ে তাদের পাশে পাশে থেকে পরামর্শদাতার মতো কাজ করছিলেন।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্বের একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য উত্তরসূরি তৈরি করা। সুযোগ্য নেতৃত্বের একটি বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে, উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। সিস্টার মেরিয়ান টেরেসা কলেজ এবং সংঘের জন্য উত্তরসূরি তৈরিতে সচেষ্ট ভূমিকা রাখেন।
একটি ছোট দালান নিয়ে কলেজের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, ধীরে ধীরে ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার, মিলনায়তন, খেলার স্থান, টিচার্সরুম ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো কলেজকে একটা সুষ্ঠু আকৃতি দান করে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তাও অপ্রতুল হওয়ায় ২০০৭ থেকে শুরু হয় আবারও সম্প্রসারণ। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার শ্রম, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। সবার সঙ্গে রাত-দিন খেটে এক অনিন্দ্যসুন্দর ‘সিস্টার অগাস্টিন মেরি হল’ এবং বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগ তৈরিতে অবদান রাখেন। ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার, মিস্ত্রি—সবার সঙ্গে থেকে কীভাবে একটু সাশ্রয় হয়, কীভাবে আরও মজবুত হয়, কীভাবে সুন্দর হয়—প্রাণপণ তার প্রচেষ্টা করেছেন এবং এসব করতে গিয়ে নিজের বিশ্রাম, আহার, চিকিৎসা—কোনো কিছুই গুরুত্ব দেননি। তাঁর এই অবদান সংঘ এবং কলেজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। যখন সিস্টারের সময় থাকত তখন কলেজের দাদা, দিদি, শিক্ষক, কর্মী—সবার সঙ্গে তাঁদের সব খবরাখবর নিতেন এবং অত্যন্ত আন্তরিকতায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।
সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত সম্মান বোধ ছিল। পরিবারের, প্যারিসের অবদান তিনি তাঁর সেবা, প্রার্থনা দিয়ে স্মরণ করতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে হলিক্রস সিস্টার সংঘ কলেজ এবং সিস্টার বিশেষ সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
সর্বোপরি সিস্টার শুধু সংঘ, কলেজ, পরিবার, সমাজ ও দেশের নন, তিনি বিশ্বমণ্ডলীর নারীদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে তাঁর চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও কর্মকে উৎসর্গ করেন।
তীর্থযাত্রী সিস্টার মেরিয়ান টেরেসা তীর্থস্থান প্রদর্শন করে ওই পবিত্র স্থানে ২০১১ সালের ২৫ জুন পরম আত্মার সঙ্গে মিলিত হন। অনেক তীর্থযাত্রীরই আকাঙ্ক্ষা থাকে, তীর্থস্থানেই যেন তাঁরা পরম শান্তি পেতে পারেন।
সিস্টার মেরিয়ান টেরেসার অন্তরে সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল কি না জানি না, তবে তাঁর এই মৃত্যু জীবনকালের এক সুন্দরতম পরিসমাপ্তি বলে মনে করি।
বাংলাদেশের নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর নিরলস শ্রম ও প্রচেষ্টা চিরস্মরণীয়।
বিশ্বাস করি, যে সত্য ও সুন্দরকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করার বাণী যুগে যুগে হলিক্রস কলেজ প্রচার করছে, তা সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হোক।
রীনা দাস
অধ্যক্ষ, মার্টিন লুথার কলেজ, ঢাকা
No comments