বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-নয়াদিলি্লকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে by কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন
উপমহাদেশের মনস্তাত্তি্বক ব্যবধান ঘুচতে সময় লাগবে। দেশ বিভক্তির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে উপমহাদেশের এ সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হবে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সনি্নহিত রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান সুযোগ উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি উদারতা ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে
ভারতের কতিপয় রাজ্যের নেতৃবৃন্দ ফেডারেল নিয়মনীতিকে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে যেতে অস্বীকৃতি জানান, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ওপর ভেটো দেন এবং এখন বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সাল থেকে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তিকে বিপদগ্রস্ত করছেন। দু'দেশের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটারের ওপর স্থল সীমান্ত নির্ধারণ ও ৫ হাজার একর অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ই শুধু নয়, উভয় দেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত ১৫০টি ছিটমহল বিনিময়ও রয়েছে। উভয় দেশের জরিপ ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিটমহলের বাসিন্দারা চুক্তি সংশোধনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘকালের দুর্দশার অবসান চান। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বলছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে আগমন ঘটবে।
স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন পড়ে। সংসদ ও রাজ্যগুলোকে তা অনুমোদন করতে হয়। এর অর্থ হলো মমতার এ ব্যাপারে আপত্তিটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধক।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক জাতি নিয়ে গঠিত, দেশের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একই ধর্মাবলম্বী ও দেশের প্রায় সবাই একই ভাষায় কথা বলে। প্রায় ভারতীয় ভূখণ্ড পরিবেষ্টিত দেশটি সনি্নহিত ভারতীয় অঞ্চলের সঙ্গে তার নৃতাত্তি্বক বা জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয়েই পরিচিত এবং এটা তাকে ভারতের নিরপেক্ষ বন্ধুতে পরিণত করেছে। জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দুঃখজনক ইতিহাস এবং যাতে ভারতের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকা পালন করেছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বহুবিধ কারণে, ভারতের দিক থেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করা হবে, এটা ঢাকা প্রত্যাশা করতে পারে।
ঢাকায় শেখ হাসিনার বন্ধুপ্রতিম সরকার ভারতের প্রতি হুমকিস্বরূপ সন্ত্রাসবাদীদের কর্মকাণ্ড হ্রাস করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। কিন্তু দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না ঘটায় সম্পূর্ণরূপে হতবুদ্ধিকর ও হতাশাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ একমত হয়েছিলেন। ভারতেরই একটি রাজ্য সরকারের কারণে সমস্যা সমাধানে এহেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো।
বাংলাদেশ রাজনীতি, শ্রেণী ও পরিচিতি প্রশ্নে বিভক্ত। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশই মনে করে, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখন প্রকৃত বা গুরুত্বপূর্ণ শত্রুতার সম্পর্ক রয়েছে তখন নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান বা সামান্য কিছু উত্তাপ দূর করা গেলে সেটা পুরোপুরি সম্ভব। দু'দেশের মধ্যে অন্তঃস্থায়ী দ্বন্দ্বটা আন্তঃসরকারি ও ট্রাক-২ কর্মকাণ্ডকেও ছাপিয়ে যায়। আসলে এটা দেশ বিভাগ-পরবর্তী মানুষের মধ্যে বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতার ফলশ্রুতি। পূর্ব বাংলার মানসিকতায় বিদ্যমান এই উভয় সংকটের সুরাহা করতে পারেনি ১৯৪৭ অথবা ১৯৭১ সালের ঘটনাও। এর একদিকে রয়েছে ভারতীয় ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আরেক দিকে রয়েছে পাকিস্তানি ধরনের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি।
একদিকে রয়েছেন উদারনীতিকরা, যারা বিশ্বাস করেন, তাদের ধর্ম পরিচয়ের চেয়েও জাতিগতভাবে বাঙালি পরিচয়টাই মুখ্য। অন্যদিকে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী মৌলবাদীরা, যাদের কাছে এখনও ইসলামী উম্মাহর ঐক্যই গুরুত্বপূর্ণ। শেষোক্তদের কাছে ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে বিভক্তিটা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ বিভক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষত মিলিয়ে যেতে এবং একটি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশি পরিচিতি গড়ে উঠতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তবে একটি ইতিবাচক ফললাভের জন্য ভারতকে তার প্রভাবকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ভারতের, বিশেষ করে আমাদের অবহেলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি আবশ্যক। বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারের জন্য নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য সহজ করা, ভিসা কার্যপ্রণালি ও স্থল সীমান্ত সমস্যা সমাধান ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে। কারণ এসব ইস্যু ভারতের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না।
হাসিনা সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য যখন বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার কারণগুলো দূর করার জন্য ভারতের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তখন তথাকথিত 'রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা' দেখিয়ে নয়াদিলি্ল অদূরদর্শী কট্টরপন্থি, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিদদের (যারা ঢাকায় একটি বৈরী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কী অবস্থা হবে সে সম্পর্কে দৃশ্যত তেমন অবগত নয়) বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের এজেন্ডা নির্ধারণে এলাউ করছে। আর এটা ঘটছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময় শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং এতে আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের হাতকে দৃঢ় করবে বলে মনে করা হয়। মানুষের সৃষ্ট ও বাস্তব সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও পরিবহন সংযোগ অবশ্যম্ভাবীরূপে সীমান্তের উভয় অংশে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করবে।
উপমহাদেশের মনস্তাত্তি্বক ব্যবধান ঘুচতে সময় লাগবে। দেশ বিভক্তির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে উপমহাদেশের এ সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হবে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সনি্নহিত রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান সুযোগ উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি উদারতা ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা
ভারতের কতিপয় রাজ্যের নেতৃবৃন্দ ফেডারেল নিয়মনীতিকে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে যেতে অস্বীকৃতি জানান, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ওপর ভেটো দেন এবং এখন বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সাল থেকে ঝুলে থাকা স্থল সীমান্ত চুক্তিকে বিপদগ্রস্ত করছেন। দু'দেশের মধ্যে ৪ হাজার কিলোমিটারের ওপর স্থল সীমান্ত নির্ধারণ ও ৫ হাজার একর অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ই শুধু নয়, উভয় দেশের সীমানার মধ্যে অবস্থিত ১৫০টি ছিটমহল বিনিময়ও রয়েছে। উভয় দেশের জরিপ ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিটমহলের বাসিন্দারা চুক্তি সংশোধনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘকালের দুর্দশার অবসান চান। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বলছেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে আগমন ঘটবে।
স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন পড়ে। সংসদ ও রাজ্যগুলোকে তা অনুমোদন করতে হয়। এর অর্থ হলো মমতার এ ব্যাপারে আপত্তিটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধক।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক জাতি নিয়ে গঠিত, দেশের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ একই ধর্মাবলম্বী ও দেশের প্রায় সবাই একই ভাষায় কথা বলে। প্রায় ভারতীয় ভূখণ্ড পরিবেষ্টিত দেশটি সনি্নহিত ভারতীয় অঞ্চলের সঙ্গে তার নৃতাত্তি্বক বা জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয়েই পরিচিত এবং এটা তাকে ভারতের নিরপেক্ষ বন্ধুতে পরিণত করেছে। জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দুঃখজনক ইতিহাস এবং যাতে ভারতের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকা পালন করেছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বহুবিধ কারণে, ভারতের দিক থেকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করা হবে, এটা ঢাকা প্রত্যাশা করতে পারে।
ঢাকায় শেখ হাসিনার বন্ধুপ্রতিম সরকার ভারতের প্রতি হুমকিস্বরূপ সন্ত্রাসবাদীদের কর্মকাণ্ড হ্রাস করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। কিন্তু দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না ঘটায় সম্পূর্ণরূপে হতবুদ্ধিকর ও হতাশাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ একমত হয়েছিলেন। ভারতেরই একটি রাজ্য সরকারের কারণে সমস্যা সমাধানে এহেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো।
বাংলাদেশ রাজনীতি, শ্রেণী ও পরিচিতি প্রশ্নে বিভক্ত। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশই মনে করে, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যখন প্রকৃত বা গুরুত্বপূর্ণ শত্রুতার সম্পর্ক রয়েছে তখন নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান বা সামান্য কিছু উত্তাপ দূর করা গেলে সেটা পুরোপুরি সম্ভব। দু'দেশের মধ্যে অন্তঃস্থায়ী দ্বন্দ্বটা আন্তঃসরকারি ও ট্রাক-২ কর্মকাণ্ডকেও ছাপিয়ে যায়। আসলে এটা দেশ বিভাগ-পরবর্তী মানুষের মধ্যে বিরাজমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতার ফলশ্রুতি। পূর্ব বাংলার মানসিকতায় বিদ্যমান এই উভয় সংকটের সুরাহা করতে পারেনি ১৯৪৭ অথবা ১৯৭১ সালের ঘটনাও। এর একদিকে রয়েছে ভারতীয় ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আরেক দিকে রয়েছে পাকিস্তানি ধরনের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি।
একদিকে রয়েছেন উদারনীতিকরা, যারা বিশ্বাস করেন, তাদের ধর্ম পরিচয়ের চেয়েও জাতিগতভাবে বাঙালি পরিচয়টাই মুখ্য। অন্যদিকে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী মৌলবাদীরা, যাদের কাছে এখনও ইসলামী উম্মাহর ঐক্যই গুরুত্বপূর্ণ। শেষোক্তদের কাছে ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সঙ্গে বিভক্তিটা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ বিভক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষত মিলিয়ে যেতে এবং একটি আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশি পরিচিতি গড়ে উঠতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। তবে একটি ইতিবাচক ফললাভের জন্য ভারতকে তার প্রভাবকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ভারতের, বিশেষ করে আমাদের অবহেলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি আবশ্যক। বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারের জন্য নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য সহজ করা, ভিসা কার্যপ্রণালি ও স্থল সীমান্ত সমস্যা সমাধান ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে। কারণ এসব ইস্যু ভারতের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না।
হাসিনা সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য যখন বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার কারণগুলো দূর করার জন্য ভারতের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তখন তথাকথিত 'রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা' দেখিয়ে নয়াদিলি্ল অদূরদর্শী কট্টরপন্থি, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিদদের (যারা ঢাকায় একটি বৈরী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে কী অবস্থা হবে সে সম্পর্কে দৃশ্যত তেমন অবগত নয়) বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের এজেন্ডা নির্ধারণে এলাউ করছে। আর এটা ঘটছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিনিময় শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং এতে আমাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের হাতকে দৃঢ় করবে বলে মনে করা হয়। মানুষের সৃষ্ট ও বাস্তব সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও পরিবহন সংযোগ অবশ্যম্ভাবীরূপে সীমান্তের উভয় অংশে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করবে।
উপমহাদেশের মনস্তাত্তি্বক ব্যবধান ঘুচতে সময় লাগবে। দেশ বিভক্তির অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে উপমহাদেশের এ সমস্যা আপনাআপনি সুরাহা হবে। নয়াদিলি্ল ও ঢাকার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান অনেকটা নির্ভর করছে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সনি্নহিত রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান সুযোগ উপলব্ধি করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি উদারতা ও বন্ধুত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা
No comments