আঞ্চলিকতার রোষানলে সিলেট by রশীদ জামীল
‘‘সিলেটের মানুষ আজকাল লেখাপড়া শিখে ভদ্র হয়ে গেছে! সাগর-রুনি পরকিয়ার বলি।’’ এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান গেল ৩০ মে এমন অপরিপক্ষ মন্তব্য করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক নিন্দা কুড়িয়েছেন।
সচেতন বিবেক যখন ভেবে পাচ্ছিল না ‘শিক্ষিত মুর্খ’ টাইপ কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে নেই কেন , সিলেটকে নিয়ে এমন স্থুল বালখিল্যসূলভ কটুক্তির জন্য যখন ফুঁসে উঠেছিল সিলেটের মানুষ দেশে-বিদেশে, যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এটিএন বাংলা বয়কট করার, করেও ছিল, তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সিলেটবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করায় আপাতত সিলেটবাসীর ক্ষোভের আগুন কিছুটা হলেও উপশমিত হয়েছে। জল আরো বেশি ঘোলা হবার আগেই মাহফুজুর রহমানের এই অনুতপ্ত প্রশংসাব্যাঞ্জক।
তবে সাগর রুনি নিয়ে করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক মহলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে তার চিন্তাভাবনা কোন দিকে এগুচ্ছে, জানা যায়নি। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন ও সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকরা যখন মিছিল-সমাবেশ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছেন , তখন তার এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে সর্বমহলে। এ ব্যাপারটি তিনি কীভাবে সামাল দেবেন, তার ব্যাপার। দেখা যাক কোথাকার পানি কোন দিকে গড়ায়।
সিলেটকে নিয়ে এর আগেও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমার মনে পড়ছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীও একবার সিলেট নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সিলেটবাসী লন্ডন না গেলে রিকশা চালাতে হতো। সিলেটকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক এমন মন্তব্যের কারণে সিলেটের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল তাকে। তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছিল সিলেটে। দুই বছর সিলেটে ঢুকতেই দেয়া হয়নি সাঈদীকে।
জগতের সকল মরহুমদের উদ্ধৃত করে তাদের সাক্ষী রেখে ইতিসাস ফাঁদতে পারঙ্গম তৈলাক্ত কলাম লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী একবার বলে বসলেন, ‘‘সিলেটিরা জংলী ভাষায় কথা বলে!’’ নাজেহাল হতে হয়েছিল তাকেও। আজ তিনি লন্ডনের যে এলাকায় বসতি গেড়েছেন, সেই ব্রিকলেনকে বলা হয় সেকেন্ড সিলেট। সিলেটিদের কারণেই সেটা বাংলাটাউন বলে পরিচিত। সেখানকার (বেথনাল গ্রিন ও বো) লোকাল এমপি রোশনারা আলীও এই সিলেটেরই মেয়ে। আর জনাব আ.গা চৌ: সেখানে যে ক’টি পত্রিকায় কলাম লিখে টু পাইস কামাচ্ছেন, সেগুলোর অধিকাংশই সিলেটি মালিকানার পত্রিকা। আবদুল গাফফার চৌধুরী সাহেবকে (তার ভাষায়) জঙ্গলের সাথেই থাকতে হচ্ছে। জঙ্গল ছাড়া মঙ্গলের আর কোনো ঠিকানা উনার কপালেও নসিব হয়নি। আমরা বুঝতে পারি না সিলেট কেন কিছু মানুষের গাত্রদাহের কারণ হয়ে যায়।
দুই.
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে থাকি জাতীয় পর্যায়ে সিলেটবিদ্বেষী একটি মহল ঘাপটি মেরে বসে থাকে সবসময়। প্রত্যেক সরকারের আমলেই এরা ক্রিয়াশীল থাকে। বছর দশেক থেকে তাদের অপতৎপরতা চোখে পড়ছে বেশি। এই কিছুদিন আগেও জাতীয় রাজনীতির কল-কাটি নেড়েছেন যারা, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সিলেটের। এম সাইফুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী (আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুণ), দাপটের সাথেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন জাতীয় রাজনীতি। ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি সিলেটবিদ্বেষী একটি মহল। কিন্তু করারও ছিল না কিছু। তারা তাদের যোগ্যতার বলেই নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন সে স্থানে।
হালে সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করা অন্যতম দুই নেতা হলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর এম ইলিয়াস আলী। দু’জনেই আক্রান্ত হয়েছেন। ইলিয়াস আলীকে গুম করে ফেলা হয়েছে। মানুষটির ভাগ্যে কী ঘটছে, আল্লাহই জানেন। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অর্থ কেলেংকারির অভিযোগ। ৭০ লক্ষ টাকার এই কাহিনীর পেছনে আরো কোনো কাহিনী আছে কিনা, থাকলে সেটা কী, আমি জানি না। এটা দেখছে দুদক। চূড়ান্ত ফায়সালা আদালত থেকেই আসুক, জানা যাবে। সুরঞ্জিত দোষী না নির্দোষ, সে ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করছি না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কিছু মানুষ এই ঘটনাকে সামনে এনে সিলেটের দিকেই অপবাদের আঙুল তুললেন। একটি মতো দৈনিকে জনৈক কলাম লেখক সিলেটকে ব্যাঙ্গ করে ‘ছিঃ লেট’ পর্যন্ত বলে বসলেন! যেনো বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযেগ উঠলো! যিনি কিনা সিলেটের! এদেশের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের কথা দেশবাসী বরাবরই শুনে আসছে। কই! কখনো তো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর এলাকা জড়িয়ে কথা উঠেনি। কথা উঠলো সিলেটকে জড়িয়ে! কেন এই সিলেট বিদ্বেষ!
তিন.
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ইঞ্জিনে জ্বালানির উল্লেখযোগ্য আসছে রেমিটেন্স থেকে। আর বিদেশি রেমিটেন্সের সিংহভাগ যোগান দিচ্ছেন প্রবাসী সিলেটিরা। তারপরেও সিলেটের নাম শুনলে যাদের গায়ে বিষফোঁড়া উঠে যায়, আঞ্চলিকতার আওয়াজ তুলে বিভক্তির রেখা টেনে বিকৃত আনন্দ পান যারা, তাদের জ্ঞাতার্তে বলছি, আঞ্চলিকতা একটি আপেক্ষিক শব্দ। দেশপ্রেমের একটি অনুষঙ্গ বললেও বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে না। সঙ্গতকারণেই অঞ্চলপ্রেম গর্ব করার মতোই একটি ব্যাপার। আমরা আমাদের অঞ্চল নিয়ে গর্বিত। তবে অঞ্চল বিদ্বেষ কিন্তু ঠিক না।
জনাব মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ‘‘সিলেটের মানুষ এখন লেখাপড়া শিখে ভদ্র হয়ে গেছেন। তারা সিলেটি ভাষা ছেড়ে দিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখেছেন।’’ মাহফুজ সাহেবদের জ্ঞাতার্তে জানিয়ে দিই, আমরা আমাদের সিলেটি ভাষা ছেড়ে দিয়েছি-এই বিভ্রান্তিকর তথ্য আপনাকে কে দিল? আমরা তো আমাদের ভাষা নিয়ে মোটেও হীনমন্যতায় ভোগছি না। আমরা তো আমাদের ভাষা নিয়ে গর্বিত। এ ভাষা ছেড়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আপনি এ ভাষা সম্পর্কে কতটুকু জানেন? না জেনে তো মূর্খরা কথা বলে। আপনার মতো দায়িত্বশীল একজন মানুষের তো উচিত ছিল জেনে কথা বলা।
সিলেটি ভাষার যে একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য আছে, আপনি কি জানেন? আমি সিলেটের নাগরী লিপির কথাই বলছি। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান এই নাগরী লিপিকে অস্বীকার করে কীভাবে রচিত হতে পারে? নাগরী লিপি সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি লেখ্যলিপি, সিলেটের বাইরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ভারতের আসামের কাছাড় এবং করিমগঞ্জেও এই লিপির প্রচলন ছিল। জানা না থাকলে খোঁজ নিন।
৩২টি বর্ণমালার নাগরী লিপি মূলত সিলেটের মুসলমানদেরই সম্পদ। তাই নাগরীতে রচিত বইয়ের প্রধানত বিষয়বস্তু ছিল নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী, রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত। নাগরী লিপিতে ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ ১৪৪টি গ্রন্থ রয়েছে, অগুলো সম্বন্ধে জানুন। নাগরী বর্ণমালায় লেখা হালতুন নবী, রদ্দে কুফর, হাসর মিছিল, মহববত নামা, শীতালং শাহের হাসর তরান, রাগ বাউল, কিয়ামতনামা, সৈয়দ শাহ নূরের নূর নসিহত, আরকুম শাহের কবিনামা, হকিকতে সিতারা প্রভৃতি গ্রন্থগুলোর সংবাদ আপনার চ্যানেলকে কেউ কোনোদিন দেয়নি মনেহয়! নাগরী সাহিত্য’র উল্লেখযোগ্যরা কয়েকজন হলেন- গোলাম হুছন, মুন্সী ইরফান আলী, দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্লাহ, ওয়াজিদ উল্লাহ, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াসিন প্রমুখ। জনাব, নামগুলো কি শোনা হয়েছে এর আগে? বাংলা ভাষায় আর কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আলাদা লিপি ছিল বা আছে এবং সে ভাষায় স্বতন্ত্র পুস্তক রচিত হয়েছে, আরেকটি উদাহরণ দিতে পারবেন? তাহলে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা চর্চাকে বাঁকা চোখে দেখা হয় কোন যুক্তিতে?
চার.
আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করি না আমরা। আমরা সিলেটবাসী মনে করি ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়েই আমাদের অঞ্চল। কিন্তু বারবার বিভাজনের রেখা কারা টেনে ধরছেন? সিলেটের প্রতি কেন এই বিরাগ? ভুলে গেলে তো হবে না এই সিলেট একদিন একজন ওসমানীকে জন্ম দিয়েছিল। যে ওসমানী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ছিনিয়ে এনেছিলেন লাল সবুজের পতাকা। সিলেটকে অবজ্ঞা করার আগে কি এই ব্যাপারটি মনে পড়ে না?
এছাড়া বাংলা সাহিত্যের জন্য এই সিলেটের ক্ষণজন্মা যারা অবদান রেখেছেন, সেই তালিকা এবং তাদের কিঞ্চিত সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করলে তো দিনের পর দিন কথা বলা যাবে। সিলেটের নিজস্ব বর্ণমালা নাগরী লিপিতে রচিত অসংখ্য গান, কবিতা, রাগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বৈষ্ণব বা পদাবলী সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, লোক সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যে সিলেটের যে অবদান রয়েছে, সেটা অস্বীকার করবেন কীভাবে?। মহাকবি শেখ চান্দ, হাসন রাজা, সৈয়দ মুজতবা আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, নিরব সাধক অধ্যাপক আছদ্দর আলী, কবি আফজাল চৌধুরী, কবি সৈয়দ সুলতান, অধ্যাপক শাহেদ আলী, কবি দিলোয়ার-কতজনের নাম বলবো? বাংলা সাহিত্যের বিরাট একটা অংশ জুড়ে আছেন তারা। বাংলা সাহিত্যকে, ভাষাকে সমৃদ্ধ করণে আমি যাদের নাম নিলাম এবং আরো যারা এই সিলেটের, তাদের অবদানকে খাটো করে দেখবার কি কোনো উপায় আছে?
পাঁচ.
সিলেটে প্রাপ্ত তাম্রশাসন, শিলালিপি, কাহিনী, গাঁথা ইত্যাদি এই অঞ্চলের ভাষা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন বলে ধারণা করা হয়। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণের চর্যাপদে সিলেটের মানুষের কথ্য ভাষার অনেকটা মিল রয়েছে । সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার চর্যাপদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটি আজও অক্ষুন্ন আছে। যেমন, চর্যাপদে ব্যবহৃত হাকম (সেতু) উভাও (দাঁড়াও) মাত (কথা) ইত্যাদি। তার মানে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বলে যে ভাষাকে তাচ্ছিল্য করে বিকৃত ধরনের আনন্দ পেতে চান কেউ কেউ, তারা বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞানও যে রাখেন না, এ কথা বলাই যায়।
আসুন আমরা সিলেটবাসী আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় এবং অধিকার আদায়ে স্বোচ্ছার হই। নতুন করে জাগতে শিখি। নতুন করে ভাবতে শিখি। নয় তো অতি ভদ্রলোকরা বারবার আমাদের অপমান করেই যাবে। জনাব মাহফুজুর রহমান দেশের দু’টি প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলের মালিক হয়েও সিলেট নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে আমরা সিলেটবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করে এ বেলায় পরিস্থিতি ঠা করেছেন তিনি। আমরা আশা করবো আগামীতে যে কেউ সিলেটের ভাষা, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মন্তব্য করার আগে আরো সতর্ক হবেন। শুভ বুদ্ধির জয় হোক।
রশীদ জামীল: লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। সিলেট শহরে থাকেন।
ইমেইল:rashid21bangla@yahoo.com
তবে সাগর রুনি নিয়ে করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক মহলে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে তার চিন্তাভাবনা কোন দিকে এগুচ্ছে, জানা যায়নি। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন ও সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকরা যখন মিছিল-সমাবেশ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছেন , তখন তার এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে সর্বমহলে। এ ব্যাপারটি তিনি কীভাবে সামাল দেবেন, তার ব্যাপার। দেখা যাক কোথাকার পানি কোন দিকে গড়ায়।
সিলেটকে নিয়ে এর আগেও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমার মনে পড়ছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীও একবার সিলেট নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সিলেটবাসী লন্ডন না গেলে রিকশা চালাতে হতো। সিলেটকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক এমন মন্তব্যের কারণে সিলেটের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল তাকে। তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছিল সিলেটে। দুই বছর সিলেটে ঢুকতেই দেয়া হয়নি সাঈদীকে।
জগতের সকল মরহুমদের উদ্ধৃত করে তাদের সাক্ষী রেখে ইতিসাস ফাঁদতে পারঙ্গম তৈলাক্ত কলাম লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী একবার বলে বসলেন, ‘‘সিলেটিরা জংলী ভাষায় কথা বলে!’’ নাজেহাল হতে হয়েছিল তাকেও। আজ তিনি লন্ডনের যে এলাকায় বসতি গেড়েছেন, সেই ব্রিকলেনকে বলা হয় সেকেন্ড সিলেট। সিলেটিদের কারণেই সেটা বাংলাটাউন বলে পরিচিত। সেখানকার (বেথনাল গ্রিন ও বো) লোকাল এমপি রোশনারা আলীও এই সিলেটেরই মেয়ে। আর জনাব আ.গা চৌ: সেখানে যে ক’টি পত্রিকায় কলাম লিখে টু পাইস কামাচ্ছেন, সেগুলোর অধিকাংশই সিলেটি মালিকানার পত্রিকা। আবদুল গাফফার চৌধুরী সাহেবকে (তার ভাষায়) জঙ্গলের সাথেই থাকতে হচ্ছে। জঙ্গল ছাড়া মঙ্গলের আর কোনো ঠিকানা উনার কপালেও নসিব হয়নি। আমরা বুঝতে পারি না সিলেট কেন কিছু মানুষের গাত্রদাহের কারণ হয়ে যায়।
দুই.
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে থাকি জাতীয় পর্যায়ে সিলেটবিদ্বেষী একটি মহল ঘাপটি মেরে বসে থাকে সবসময়। প্রত্যেক সরকারের আমলেই এরা ক্রিয়াশীল থাকে। বছর দশেক থেকে তাদের অপতৎপরতা চোখে পড়ছে বেশি। এই কিছুদিন আগেও জাতীয় রাজনীতির কল-কাটি নেড়েছেন যারা, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সিলেটের। এম সাইফুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী (আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুণ), দাপটের সাথেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন জাতীয় রাজনীতি। ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি সিলেটবিদ্বেষী একটি মহল। কিন্তু করারও ছিল না কিছু। তারা তাদের যোগ্যতার বলেই নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন সে স্থানে।
হালে সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করা অন্যতম দুই নেতা হলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর এম ইলিয়াস আলী। দু’জনেই আক্রান্ত হয়েছেন। ইলিয়াস আলীকে গুম করে ফেলা হয়েছে। মানুষটির ভাগ্যে কী ঘটছে, আল্লাহই জানেন। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অর্থ কেলেংকারির অভিযোগ। ৭০ লক্ষ টাকার এই কাহিনীর পেছনে আরো কোনো কাহিনী আছে কিনা, থাকলে সেটা কী, আমি জানি না। এটা দেখছে দুদক। চূড়ান্ত ফায়সালা আদালত থেকেই আসুক, জানা যাবে। সুরঞ্জিত দোষী না নির্দোষ, সে ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করছি না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কিছু মানুষ এই ঘটনাকে সামনে এনে সিলেটের দিকেই অপবাদের আঙুল তুললেন। একটি মতো দৈনিকে জনৈক কলাম লেখক সিলেটকে ব্যাঙ্গ করে ‘ছিঃ লেট’ পর্যন্ত বলে বসলেন! যেনো বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযেগ উঠলো! যিনি কিনা সিলেটের! এদেশের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের কথা দেশবাসী বরাবরই শুনে আসছে। কই! কখনো তো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর এলাকা জড়িয়ে কথা উঠেনি। কথা উঠলো সিলেটকে জড়িয়ে! কেন এই সিলেট বিদ্বেষ!
তিন.
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ইঞ্জিনে জ্বালানির উল্লেখযোগ্য আসছে রেমিটেন্স থেকে। আর বিদেশি রেমিটেন্সের সিংহভাগ যোগান দিচ্ছেন প্রবাসী সিলেটিরা। তারপরেও সিলেটের নাম শুনলে যাদের গায়ে বিষফোঁড়া উঠে যায়, আঞ্চলিকতার আওয়াজ তুলে বিভক্তির রেখা টেনে বিকৃত আনন্দ পান যারা, তাদের জ্ঞাতার্তে বলছি, আঞ্চলিকতা একটি আপেক্ষিক শব্দ। দেশপ্রেমের একটি অনুষঙ্গ বললেও বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে না। সঙ্গতকারণেই অঞ্চলপ্রেম গর্ব করার মতোই একটি ব্যাপার। আমরা আমাদের অঞ্চল নিয়ে গর্বিত। তবে অঞ্চল বিদ্বেষ কিন্তু ঠিক না।
জনাব মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ‘‘সিলেটের মানুষ এখন লেখাপড়া শিখে ভদ্র হয়ে গেছেন। তারা সিলেটি ভাষা ছেড়ে দিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখেছেন।’’ মাহফুজ সাহেবদের জ্ঞাতার্তে জানিয়ে দিই, আমরা আমাদের সিলেটি ভাষা ছেড়ে দিয়েছি-এই বিভ্রান্তিকর তথ্য আপনাকে কে দিল? আমরা তো আমাদের ভাষা নিয়ে মোটেও হীনমন্যতায় ভোগছি না। আমরা তো আমাদের ভাষা নিয়ে গর্বিত। এ ভাষা ছেড়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। আপনি এ ভাষা সম্পর্কে কতটুকু জানেন? না জেনে তো মূর্খরা কথা বলে। আপনার মতো দায়িত্বশীল একজন মানুষের তো উচিত ছিল জেনে কথা বলা।
সিলেটি ভাষার যে একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য আছে, আপনি কি জানেন? আমি সিলেটের নাগরী লিপির কথাই বলছি। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান এই নাগরী লিপিকে অস্বীকার করে কীভাবে রচিত হতে পারে? নাগরী লিপি সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি লেখ্যলিপি, সিলেটের বাইরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ভারতের আসামের কাছাড় এবং করিমগঞ্জেও এই লিপির প্রচলন ছিল। জানা না থাকলে খোঁজ নিন।
৩২টি বর্ণমালার নাগরী লিপি মূলত সিলেটের মুসলমানদেরই সম্পদ। তাই নাগরীতে রচিত বইয়ের প্রধানত বিষয়বস্তু ছিল নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী, রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত। নাগরী লিপিতে ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ ১৪৪টি গ্রন্থ রয়েছে, অগুলো সম্বন্ধে জানুন। নাগরী বর্ণমালায় লেখা হালতুন নবী, রদ্দে কুফর, হাসর মিছিল, মহববত নামা, শীতালং শাহের হাসর তরান, রাগ বাউল, কিয়ামতনামা, সৈয়দ শাহ নূরের নূর নসিহত, আরকুম শাহের কবিনামা, হকিকতে সিতারা প্রভৃতি গ্রন্থগুলোর সংবাদ আপনার চ্যানেলকে কেউ কোনোদিন দেয়নি মনেহয়! নাগরী সাহিত্য’র উল্লেখযোগ্যরা কয়েকজন হলেন- গোলাম হুছন, মুন্সী ইরফান আলী, দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্লাহ, ওয়াজিদ উল্লাহ, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াসিন প্রমুখ। জনাব, নামগুলো কি শোনা হয়েছে এর আগে? বাংলা ভাষায় আর কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আলাদা লিপি ছিল বা আছে এবং সে ভাষায় স্বতন্ত্র পুস্তক রচিত হয়েছে, আরেকটি উদাহরণ দিতে পারবেন? তাহলে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা চর্চাকে বাঁকা চোখে দেখা হয় কোন যুক্তিতে?
চার.
আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করি না আমরা। আমরা সিলেটবাসী মনে করি ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়েই আমাদের অঞ্চল। কিন্তু বারবার বিভাজনের রেখা কারা টেনে ধরছেন? সিলেটের প্রতি কেন এই বিরাগ? ভুলে গেলে তো হবে না এই সিলেট একদিন একজন ওসমানীকে জন্ম দিয়েছিল। যে ওসমানী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ছিনিয়ে এনেছিলেন লাল সবুজের পতাকা। সিলেটকে অবজ্ঞা করার আগে কি এই ব্যাপারটি মনে পড়ে না?
এছাড়া বাংলা সাহিত্যের জন্য এই সিলেটের ক্ষণজন্মা যারা অবদান রেখেছেন, সেই তালিকা এবং তাদের কিঞ্চিত সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করলে তো দিনের পর দিন কথা বলা যাবে। সিলেটের নিজস্ব বর্ণমালা নাগরী লিপিতে রচিত অসংখ্য গান, কবিতা, রাগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে বৈষ্ণব বা পদাবলী সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, লোক সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যে সিলেটের যে অবদান রয়েছে, সেটা অস্বীকার করবেন কীভাবে?। মহাকবি শেখ চান্দ, হাসন রাজা, সৈয়দ মুজতবা আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, নিরব সাধক অধ্যাপক আছদ্দর আলী, কবি আফজাল চৌধুরী, কবি সৈয়দ সুলতান, অধ্যাপক শাহেদ আলী, কবি দিলোয়ার-কতজনের নাম বলবো? বাংলা সাহিত্যের বিরাট একটা অংশ জুড়ে আছেন তারা। বাংলা সাহিত্যকে, ভাষাকে সমৃদ্ধ করণে আমি যাদের নাম নিলাম এবং আরো যারা এই সিলেটের, তাদের অবদানকে খাটো করে দেখবার কি কোনো উপায় আছে?
পাঁচ.
সিলেটে প্রাপ্ত তাম্রশাসন, শিলালিপি, কাহিনী, গাঁথা ইত্যাদি এই অঞ্চলের ভাষা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন বলে ধারণা করা হয়। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণের চর্যাপদে সিলেটের মানুষের কথ্য ভাষার অনেকটা মিল রয়েছে । সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার চর্যাপদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটি আজও অক্ষুন্ন আছে। যেমন, চর্যাপদে ব্যবহৃত হাকম (সেতু) উভাও (দাঁড়াও) মাত (কথা) ইত্যাদি। তার মানে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বলে যে ভাষাকে তাচ্ছিল্য করে বিকৃত ধরনের আনন্দ পেতে চান কেউ কেউ, তারা বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞানও যে রাখেন না, এ কথা বলাই যায়।
আসুন আমরা সিলেটবাসী আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় এবং অধিকার আদায়ে স্বোচ্ছার হই। নতুন করে জাগতে শিখি। নতুন করে ভাবতে শিখি। নয় তো অতি ভদ্রলোকরা বারবার আমাদের অপমান করেই যাবে। জনাব মাহফুজুর রহমান দেশের দু’টি প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলের মালিক হয়েও সিলেট নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে আমরা সিলেটবাসীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করে এ বেলায় পরিস্থিতি ঠা করেছেন তিনি। আমরা আশা করবো আগামীতে যে কেউ সিলেটের ভাষা, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মন্তব্য করার আগে আরো সতর্ক হবেন। শুভ বুদ্ধির জয় হোক।
রশীদ জামীল: লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। সিলেট শহরে থাকেন।
ইমেইল:rashid21bangla@yahoo.com
No comments