সাংবাদিকদের মানববন্ধনে অপ্রীতিকর ঘটনা
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে গতকাল রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এ সময় এটিএন বাংলার সাংবাদিক-কর্মচারীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ঘটনায় প্রেসক্লাব এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে সাংবাদিক নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর তাঁরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন।
ওই সমাবেশে গতকালের হামলার ঘটনার নিন্দা, সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবি, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বিতর্কিত ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আজ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করবেন সাংবাদিকরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আগামীকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির বিপক্ষে যায় এমন কোনো কর্মসূচিতে শিল্পীদের অংশ না নেওয়ার আহ্বানও জানান সাংবাদিক নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানান। এ ছাড়া হামলায় জড়িত এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের জাতীয় পর্যায়ের চারটি সাংবাদিক সংগঠন থেকে একযোগে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনগুলো। তবে গতকাল সন্ধ্যায় নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এটিএন বাংলার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তারা কাউকে আক্রমন করেনি বরং তারাই আক্রান্ত হয়েছে।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন করার কথা ছিল। সকালে প্রেসক্লাবের সামনে অন্য একটি সংগঠনের কর্মসূচির কারণে মানববন্ধন শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মানববন্ধন যখন শুরু হয়, তখন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক নেতারা জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে কর্মসূচি নির্ধারণের বিষয় নিয়ে সভা করছিলেন। তাই ওই মুহূর্তে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আগের কর্মসূচিতে এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের মধ্যে দু-একজনকে দেখা গেলেও গতকাল বেশ কয়েকজন রিপোর্টারসহ সিনিয়র সাংবাদিকরা কর্মসূচিতে হাজির হন। মানববন্ধন শুরুর পর ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান মাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি সবাইকে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। একই সঙ্গে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তাটি বন্ধ করে দিতে পুলিশকেও আহ্বান জানান তিনি। বক্তব্যের একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বলেন, 'সাগর-রুনির মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, তা তাদের কার্যকলাপই প্রমাণ দিচ্ছে। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের কথাবার্তা প্রমাণ করছে, তিনি বিষয়টি জানেন এবং এর সঙ্গে তিনি জড়িত। আমি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের কাছে এটিএন বাংলার কার্যালয় ঘেরাওয়ের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি।'
এই বক্তব্য শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি শওকত মিল্টন, এস এম বাবু, মাহমুদুর রহমান, নাদিরা কিরণসহ কয়েকজন জাহাঙ্গীরের দিকে এগিয়ে যান। শওকত মিল্টন জাহাঙ্গীরের শার্টের কলার চেপে ধরে বলেন, 'কর্মসূচি ঘোষণা করার আপনি কে?' ওই সময় এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন, প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী, বিশেষ প্রতিনিধি মাহমুদুর রহমান, কেরামতউল্লাহ বিপ্লব, এস এম বাবু, মনিউর রহমান ও প্রতিবেদক রাহাত মিনহাজ জাহাঙ্গীর আলম প্রধানকে ধাক্কা দিয়ে, টেনে প্রেসক্লাবের ভেতরে নিয়ে যান। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কিছু সাংবাদিক জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ওই সময় এটিএন বাংলার কিছু ক্যামেরাম্যানসহ গাড়িচালকও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। লাঞ্ছিত জাহাঙ্গীর জটলা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে প্রেসক্লাবে ঢুকে যান। সেখানে তাঁকে ধাওয়া করে হামলা করেন শওকত মিল্টনসহ কয়েকজন। এমন পরিস্থিতিতে অন্য সাংবাদিকরা এগিয়ে যান। ওই সময় প্রেসক্লাব থেকে ধাওয়া করে এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। এ সময় সভা থেকে বের হয়ে আসেন সাংবাদিক নেতারা। একপর্যায়ে বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও রুহুল আমিন গাজী এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপুর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দুপুর ১টার কিছু সময় পর আবার মানববন্ধনে অংশ নেন সাংবাদিকরা। ওই সময় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মানববন্ধনে সাংবাদিকদের বক্তব্য চলাকালে সেখানে যোগ দেন এটিএন বাংলার সাংবাদিকরাও। তবে মানববন্ধন শেষ হওয়ার আগে (পৌনে ২টার দিকে) তাঁরা সেখান থেকে চলে যান।
মানববন্ধনে হামলার প্রতিবাদ ও সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ তুলে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, 'দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছেন। তাই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীরা সাংবাদিকদের ঐক্য নষ্ট করছে। ডিবি তদন্ত করে আদালতে গিয়ে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি আশ্বাস দিলেও আসামিরা গ্রেপ্তার হলো না।' তিনি বলেন, 'মাহফুজুর রহমান বললেন, সাগর-রুনি পরকীয়ার বলি। তাঁদের বাসায় মদের আড্ডা বসত। এ অভিযোগ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করতে না পারলে আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' র্যাবকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, 'আপনারা লাশ তুলে আবার ভিসেরা রিপোর্ট করিয়েছেন। এখন তদন্তের নামে টালবাহানা করছেন। কয়েক দিন পর আদালতে গিয়ে বলবেন, আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া হবে না।'
ইকবাল সোবহান চৌধুরী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ' আগামীকাল (আজ সোমবার) সকাল ১১টায় এখানে আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করব। সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবি এবং ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এ সমাবেশে সবাইকে যোগ দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।' তিনি এটিএন বাংলার সাংবাদিক এবং শিল্পীদের সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, 'পুরো জাতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাইছে। আমরা বুঝতে পারি না, সেখানে একজনের পক্ষে কেন টক-শো হচ্ছে? মানববন্ধন হচ্ছে?'
সাংবাদিক নেতারা সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে ডাকা কর্মসূচির বিরোধী কোনো কর্মসূচিতে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশ না নিতে অনুরোধ জানান। সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, 'এটিএন বাংলার চেয়ারম্যানকে খুনি বলে বক্তব্য দেওয়ার জের ধরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে, তা দুঃখজনক। তবে আমরাও সাগর-রুনির হত্যার বিচার চাই। এটিএন পরিবার চায়, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান চান। এতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই।'
মানববন্ধনে বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভুঁইয়া ও শওকত মাহমুদ, প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি ওমর ফারুক ও আবদুস শহিদ, সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ ও বাকের হোসাইন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, সিনিয়র সাংবাদিক আলতাফ মাহমুদ, শাহ আলমগীর প্রমুখ বক্তব্য দেন। কর্মসূচি পরিচালনা করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু।
এদিকে সংবাদপত্র সম্পাদনা সহকারী ফোরাম এক বিবৃতিতে সংগঠনের আহ্বায়ক ও ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধানকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে।
পরিকল্পিত হামলার দাবি এটিএন বাংলার : সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে হামলার ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং তাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে এটিএন বাংলা। গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এটিএন বাংলার বার্তা বিভাগের প্রধান জ ই মামুন বলেন, সাগর রুনি-হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী এবং বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্যে জ ই মামুন বলেন, 'সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় দেশের সব গণমাধ্যমকর্মীর মতো এটিএন পরিবারের কর্মীরাও মর্মাহত। ঘটনার বিচার দাবিতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন, সমাবেশসহ সব কর্মসূচিতে এটিএন বাংলার সাংবাদিকরা সব সময় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আজ (গতকাল রবিবার) মানববন্ধন শুরুর আগেই সাংবাদিক নেতা পরিচয়ে একজন এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করে অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেন। কিন্তু সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা আগেই বলেছিলেন, এমন কোনো কর্মসূচি তাঁদের নেই। তাই আমাদের একজন সহকর্মী প্রতিবাদ করলে ওই সাংবাদিক নেতা ক্ষিপ্ত ও মারমুখী হয়ে ওঠেন।' জ ই মামুন আরো বলেন, 'সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি সেখানে গিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি। কিন্তু আকস্মিকভাবে কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালান। এমনকি তাঁরা আমাকেও আক্রমণ করেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা বড় বড় কাঠের টুকরো নিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। একপর্যায়ে তাঁরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেন। এ সময় তাঁরা আমার নাম ধরে গালিগালাজ করতে থাকেন। আমাকে টেনে নিয়ে মারধরের চেষ্টা করেন। আমার সহকর্মীরা সেই আক্রমণ থেকে রক্ষা না করলে আমাকে এখন হাসপাতালে থাকতে হতো।'
জ ই মামুন সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, 'এটিএন বাংলার সাংবাদিক ও কলাকুশলীরা আপনাদের সহকর্মী। কোনোভাবেই প্রতিপক্ষ নয়। কাজেই এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না, যাতে এটিএন বাংলার সাংবাদিক ও কলাকুশলীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা কোনো সুবিধাবাদী মহল ফায়দা আদায় করতে পারে।'
যেভাবে এটিএন বাংলার সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন, সেটি সঠিক ছিল কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জ ই মামুন বলেন, 'আমরা কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাইনি। তারাই আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।'
এদিকে 'শিল্পী সমাজ'-এর ব্যানারে আজ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠেয় 'মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন' কর্মসূচিটি গতকাল সন্ধ্যায় স্থগিত করা হয়েছে।
ওই সমাবেশে গতকালের হামলার ঘটনার নিন্দা, সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবি, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বিতর্কিত ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আজ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করবেন সাংবাদিকরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আগামীকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির বিপক্ষে যায় এমন কোনো কর্মসূচিতে শিল্পীদের অংশ না নেওয়ার আহ্বানও জানান সাংবাদিক নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানান। এ ছাড়া হামলায় জড়িত এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের জাতীয় পর্যায়ের চারটি সাংবাদিক সংগঠন থেকে একযোগে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনগুলো। তবে গতকাল সন্ধ্যায় নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এটিএন বাংলার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তারা কাউকে আক্রমন করেনি বরং তারাই আক্রান্ত হয়েছে।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন করার কথা ছিল। সকালে প্রেসক্লাবের সামনে অন্য একটি সংগঠনের কর্মসূচির কারণে মানববন্ধন শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে মানববন্ধন যখন শুরু হয়, তখন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক নেতারা জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে কর্মসূচি নির্ধারণের বিষয় নিয়ে সভা করছিলেন। তাই ওই মুহূর্তে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আগের কর্মসূচিতে এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের মধ্যে দু-একজনকে দেখা গেলেও গতকাল বেশ কয়েকজন রিপোর্টারসহ সিনিয়র সাংবাদিকরা কর্মসূচিতে হাজির হন। মানববন্ধন শুরুর পর ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান মাইকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি সবাইকে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। একই সঙ্গে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তাটি বন্ধ করে দিতে পুলিশকেও আহ্বান জানান তিনি। বক্তব্যের একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বলেন, 'সাগর-রুনির মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, তা তাদের কার্যকলাপই প্রমাণ দিচ্ছে। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের কথাবার্তা প্রমাণ করছে, তিনি বিষয়টি জানেন এবং এর সঙ্গে তিনি জড়িত। আমি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের কাছে এটিএন বাংলার কার্যালয় ঘেরাওয়ের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছি।'
এই বক্তব্য শেষ হতেই সেখানে উপস্থিত এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি শওকত মিল্টন, এস এম বাবু, মাহমুদুর রহমান, নাদিরা কিরণসহ কয়েকজন জাহাঙ্গীরের দিকে এগিয়ে যান। শওকত মিল্টন জাহাঙ্গীরের শার্টের কলার চেপে ধরে বলেন, 'কর্মসূচি ঘোষণা করার আপনি কে?' ওই সময় এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন, প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী, বিশেষ প্রতিনিধি মাহমুদুর রহমান, কেরামতউল্লাহ বিপ্লব, এস এম বাবু, মনিউর রহমান ও প্রতিবেদক রাহাত মিনহাজ জাহাঙ্গীর আলম প্রধানকে ধাক্কা দিয়ে, টেনে প্রেসক্লাবের ভেতরে নিয়ে যান। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কিছু সাংবাদিক জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ওই সময় এটিএন বাংলার কিছু ক্যামেরাম্যানসহ গাড়িচালকও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। লাঞ্ছিত জাহাঙ্গীর জটলা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে প্রেসক্লাবে ঢুকে যান। সেখানে তাঁকে ধাওয়া করে হামলা করেন শওকত মিল্টনসহ কয়েকজন। এমন পরিস্থিতিতে অন্য সাংবাদিকরা এগিয়ে যান। ওই সময় প্রেসক্লাব থেকে ধাওয়া করে এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। এ সময় সভা থেকে বের হয়ে আসেন সাংবাদিক নেতারা। একপর্যায়ে বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও রুহুল আমিন গাজী এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপুর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দুপুর ১টার কিছু সময় পর আবার মানববন্ধনে অংশ নেন সাংবাদিকরা। ওই সময় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মানববন্ধনে সাংবাদিকদের বক্তব্য চলাকালে সেখানে যোগ দেন এটিএন বাংলার সাংবাদিকরাও। তবে মানববন্ধন শেষ হওয়ার আগে (পৌনে ২টার দিকে) তাঁরা সেখান থেকে চলে যান।
মানববন্ধনে হামলার প্রতিবাদ ও সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ তুলে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, 'দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছেন। তাই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীরা সাংবাদিকদের ঐক্য নষ্ট করছে। ডিবি তদন্ত করে আদালতে গিয়ে ব্যর্থতার কথা স্বীকার করল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি আশ্বাস দিলেও আসামিরা গ্রেপ্তার হলো না।' তিনি বলেন, 'মাহফুজুর রহমান বললেন, সাগর-রুনি পরকীয়ার বলি। তাঁদের বাসায় মদের আড্ডা বসত। এ অভিযোগ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করতে না পারলে আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' র্যাবকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, 'আপনারা লাশ তুলে আবার ভিসেরা রিপোর্ট করিয়েছেন। এখন তদন্তের নামে টালবাহানা করছেন। কয়েক দিন পর আদালতে গিয়ে বলবেন, আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া হবে না।'
ইকবাল সোবহান চৌধুরী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ' আগামীকাল (আজ সোমবার) সকাল ১১টায় এখানে আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করব। সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবি এবং ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এ সমাবেশে সবাইকে যোগ দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।' তিনি এটিএন বাংলার সাংবাদিক এবং শিল্পীদের সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, 'পুরো জাতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাইছে। আমরা বুঝতে পারি না, সেখানে একজনের পক্ষে কেন টক-শো হচ্ছে? মানববন্ধন হচ্ছে?'
সাংবাদিক নেতারা সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে ডাকা কর্মসূচির বিরোধী কোনো কর্মসূচিতে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশ না নিতে অনুরোধ জানান। সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, 'এটিএন বাংলার চেয়ারম্যানকে খুনি বলে বক্তব্য দেওয়ার জের ধরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে, তা দুঃখজনক। তবে আমরাও সাগর-রুনির হত্যার বিচার চাই। এটিএন পরিবার চায়, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান চান। এতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই।'
মানববন্ধনে বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভুঁইয়া ও শওকত মাহমুদ, প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি ওমর ফারুক ও আবদুস শহিদ, সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ ও বাকের হোসাইন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, আজিজুল ইসলাম ভুঁইয়া, সিনিয়র সাংবাদিক আলতাফ মাহমুদ, শাহ আলমগীর প্রমুখ বক্তব্য দেন। কর্মসূচি পরিচালনা করেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু।
এদিকে সংবাদপত্র সম্পাদনা সহকারী ফোরাম এক বিবৃতিতে সংগঠনের আহ্বায়ক ও ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধানকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে।
পরিকল্পিত হামলার দাবি এটিএন বাংলার : সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে হামলার ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং তাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে এটিএন বাংলা। গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এটিএন বাংলার বার্তা বিভাগের প্রধান জ ই মামুন বলেন, সাগর রুনি-হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী এবং বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্যে জ ই মামুন বলেন, 'সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় দেশের সব গণমাধ্যমকর্মীর মতো এটিএন পরিবারের কর্মীরাও মর্মাহত। ঘটনার বিচার দাবিতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন, সমাবেশসহ সব কর্মসূচিতে এটিএন বাংলার সাংবাদিকরা সব সময় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আজ (গতকাল রবিবার) মানববন্ধন শুরুর আগেই সাংবাদিক নেতা পরিচয়ে একজন এটিএন বাংলার সাংবাদিকদের খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করে অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেন। কিন্তু সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা আগেই বলেছিলেন, এমন কোনো কর্মসূচি তাঁদের নেই। তাই আমাদের একজন সহকর্মী প্রতিবাদ করলে ওই সাংবাদিক নেতা ক্ষিপ্ত ও মারমুখী হয়ে ওঠেন।' জ ই মামুন আরো বলেন, 'সাংবাদিকদের সঙ্গে আমি সেখানে গিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি। কিন্তু আকস্মিকভাবে কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালান। এমনকি তাঁরা আমাকেও আক্রমণ করেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা বড় বড় কাঠের টুকরো নিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। একপর্যায়ে তাঁরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেন। এ সময় তাঁরা আমার নাম ধরে গালিগালাজ করতে থাকেন। আমাকে টেনে নিয়ে মারধরের চেষ্টা করেন। আমার সহকর্মীরা সেই আক্রমণ থেকে রক্ষা না করলে আমাকে এখন হাসপাতালে থাকতে হতো।'
জ ই মামুন সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, 'এটিএন বাংলার সাংবাদিক ও কলাকুশলীরা আপনাদের সহকর্মী। কোনোভাবেই প্রতিপক্ষ নয়। কাজেই এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না, যাতে এটিএন বাংলার সাংবাদিক ও কলাকুশলীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা কোনো সুবিধাবাদী মহল ফায়দা আদায় করতে পারে।'
যেভাবে এটিএন বাংলার সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন, সেটি সঠিক ছিল কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জ ই মামুন বলেন, 'আমরা কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাইনি। তারাই আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।'
এদিকে 'শিল্পী সমাজ'-এর ব্যানারে আজ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠেয় 'মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন' কর্মসূচিটি গতকাল সন্ধ্যায় স্থগিত করা হয়েছে।
No comments