বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-শিক্ষকদের জন্য আরেকটু করুন by আশীষ দাশগুপ্ত

দেশে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যাও বিশাল। সমস্যা জর্জরিত এ রাষ্ট্রের পক্ষে রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়_ এ বাস্তবতাবোধ শিক্ষকদের রয়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তারও যথার্থতা শিক্ষক সমাজ বিবেচনা করে


বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের একটি প্রধান সমস্যা শিক্ষকদের সমস্যা। রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রী মোটামুটি সন্তোষজনক ও সম্মানজনকভাবে করেছেন। প্রায় ২০ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় তিন অর্থবছরে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত পেঁৗছানোর আগে যদিও রেজিস্টার্ড প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অভিনব পদ্ধতির সব আন্দোলন করেছেন। শেষ পর্যায়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষকদের অবস্থান ধর্মঘট, অনশন, শিক্ষকদের ওপর পুলিশি অ্যাকশন, একজন শিক্ষকের মৃত্যু_ এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা শেষে সমস্যাটির একটি সমাধান হয়েছে। সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাই সমস্যা সমাধানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। আরেকটি সমস্যার সমাধান প্রধানমন্ত্রীকে বের করতে হবে। এ সমস্যাটিও শিক্ষাক্ষেত্রের। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকদের সমস্যা। রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার বৈষম্যের মতোই বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের একই রকম বৈষম্য ও সমস্যা বিদ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা বহুদিন ধরে বিভিন্ন সরকারের আমলে আন্দোলন করে আসছেন। বেসরকারি শিক্ষকদের ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯২, ১৯৯৪, ২০০০ এবং ২০০৬ সালে দেশব্যাপী সংঘটিত শিক্ষক ধর্মঘটের ইতিহাস সচেতন দেশবাসীর স্মরণ থাকার কথা।
১৯৭৩ সালে ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মঘটী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে দু'বার আলোচনায় বসে কতগুলো বাস্তব সমাধান দিয়েছিলেন। সব শিক্ষককে সমহারে ৭৫ টাকা এবং কর্মচারীদের ৫০ টাকা হারে কল্যাণ ভাতা প্রদান, শিক্ষকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের জন্য বোর্ডের প্রশ্ন প্রণয়ন, পরীক্ষক ও টেবুলেটর হওয়া এবং শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও শিক্ষা বোর্ড কমিটির সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের আশ্বাস তিনিই দিয়েছিলেন এবং কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে ওই সময়ের মধ্যেই জাতীয়করণের সুপারিশ সত্যি সত্যিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৫ সালে বিয়োগান্ত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে শিক্ষকদের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে অন্ধকারের এক দুর্যোগকাল। সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষক আন্দোলন সৃষ্টি হয় দালাল নেতৃত্বে। শিক্ষকদের করা হয় একান্ত দয়া ও করুণার পাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পশ্চাৎপদ সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। তবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিরোধ বন্ধ হয়নি। সামরিক শাসক ও তাদের পোষ্য দালাল শিক্ষক নেতাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৮৬ সালে প্রায় ২ মাসব্যাপী শিক্ষক ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৯৪ সালে আরেকটি ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকায় প্রেস ক্লাবের সামনে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে অবস্থান সমাবেশ এবং অনশন কর্মসূচি পালন করেন। ৭ দিনের অবস্থান ও অনশনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ধর্মঘটী শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া বা তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ না আসায় আজকের প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শিক্ষকদের অনশন ভাঙিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন_ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদের আর রাজপথে আন্দোলন করতে হবে না।
'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে জনগণ কিছু পায়'_ প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সময়ের এ বক্তব্যটিও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশে মাত্র ৩১৭টি সরকারি বিদ্যালয়। দেশে যে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৫৭ জন শিক্ষার্থী এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলো, শতাংশের হিসাবে তার ৯০ ভাগই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। সুতরাং তাদের দাবি উপেক্ষার সুযোগ কোথায়? সারাদেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিস্তৃত যে নেটওয়ার্ক, তারা আন্দোলনে নেমে পড়লে জাতির যে মানবিক ক্ষতি হবে_ বঙ্গবন্ধুকন্যারই সে উপলব্ধি সর্বাধিক বলে শিক্ষক সমাজ বিবেচনা করে। সরকারি কর্মচারীদের মতো শিক্ষক-কর্মচারীরা বাড়ি ভাড়া, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, চিকিৎসা ভাতা কিছুই পান না। যা পান, তা লজ্জাকর। মূল বেতনের শুধু ১০০ ভাগ ও এর সঙ্গে ১০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ও ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং সারাজীবনে মাত্র ১টি ইনক্রিমেন্ট। সরকারি কর্মচারীদের চাকরির বয়স বর্ধিত হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের বয়স বর্ধিত হয় না। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষকদের চাকরির বয়সও বর্ধিত হয় না। শিক্ষক-কর্মচারীদের এমন কিছু সমস্যা রয়েছে, যার সমাধানে বাড়তি কোনো টাকার প্রয়োজন নেই। নতুন শিক্ষক নিয়োগে যে অর্থ ব্যয় হবে, সে অর্থেই প্রবীণ ও দক্ষ শিক্ষকদের বয়স বৃদ্ধি করে চাকরিতে ধরে রাখা যায়। বাজেটে বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, ইনক্রিমেন্ট এবং উৎসব ভাতা প্রদানের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কোনো অর্থেই অলাভজনক হবে না।
দেশে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যাও বিশাল। সমস্যা জর্জরিত এ রাষ্ট্রের পক্ষে রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়_ এ বাস্তবতাবোধ শিক্ষকদের রয়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তারও যথার্থতা শিক্ষক সমাজ বিবেচনা করে। দীর্ঘ বছরের অচলায়তন ভেঙে একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি চালু, নানা প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে স্কুল ও মাদ্রাসায় বিনামূল্যে বই বিতরণ; নতুন প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি; ছাত্রীদের পাশাপাশি ছাত্রদেরও উপবৃত্তি প্রদান, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু, পাবলিক পরীক্ষার ফল সময়মতো প্রকাশ_ এসবের তাৎপর্য শিক্ষক সমাজ ইতিবাচকভাবেই দেখে। এসব পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়নের জন্যই দরকার শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থান আরেকটু উন্নত করা।
প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও উদ্যোগে আমাদের দেশের বহু সমস্যার উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং দেশের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সদিচ্ছার সর্বোচ্চ নিদর্শন রাখবেন, উদ্যোগী হবেন এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের সম্ভাব্য আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন_ মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজের এমনটাই প্রত্যাশা।

আশীষ দাশগুপ্ত :সাবেক প্রধান শিক্ষক
 

No comments

Powered by Blogger.