ঘুষ সেধেছিল লাভালিনই-তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কাল ঢাকায় আসতে পারে কানাডা পুলিশ by পার্থ সারথি দাস ও মোশতাক আহমদ
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার এসএনসি লাভালিনের সাবেক দুই কর্মকর্তা বাংলাদেশের একাধিক সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ সেধেছিলেন। গত শুক্রবার কানাডার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কানাডার মন্ট্রিয়ল গেজেট পত্রিকায় 'টু ফরমার এসএনসি লাভালিন এক্সিকিউটিভস চার্জড ইন অন্টারিও উইথ করাপশন' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মোহাম্মদ ইসমাইলের বিরুদ্ধে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডা পুলিশের মুখপাত্র করপোরাল লুসি শোরে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত এপ্রিল মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে চাওয়ার এই অভিযোগ আনা হয়েছে। 'করাপশন অব ফরেন পাবলিক অফিশিয়ালস অ্যাক্ট'-এর আওতায় এ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে জানিয়ে প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়, 'এমন এক সময় পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করল, যখন ঘুষ পেতে চাওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত চালাচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেতে আগ্রহী এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার ঘুষ সাধার এ খবর কানাডিয়ান বিজনেস, হেরাল্ড নিউজসহ অন্যান্য সংবাদপত্রেও একইভাবে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এসএনসি লাভালিনের অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিশ।
এদিকে কানাডা পুলিশ পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে তাদের তদন্ত শেষ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে কানাডীয় পুলিশের একটি প্রতিনিধিদল আগামীকাল সোমবার ঢাকায় আসছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মালয়েশিয়া সরকারের প্রস্তাবের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখানোয় এবং নানা অভিযোগ-আপত্তি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো রকমের আপস না করায় এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সরকারের ওপর বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। এ কারণে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তারা বারবার চাপ সৃষ্টি করছে। জানা গেছে, গত চারদলীয় জোট সরকার আমলের পাঁচটি প্রকল্পে দুর্নীতি তদন্তের জন্যও বিশ্বব্যাংক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করছে।
ঘুষ সেধেছিলেন লাভালিনের কর্মকর্তারাই : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিসংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর রয়্যাল কানাডিয়ান মাউনটেড পুলিশ সে দেশের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন ইনকরপোরেটের টরন্টো কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট নথি জব্দ করে। এ ছাড়া গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও পেরেরে ডুহাইমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী কানাডিয়ান পুলিশের হেফাজতে থাকা নথি ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে কানাডার লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে চিঠি পাঠায় দুদক। একই সঙ্গে অনুসন্ধান কাজ গতিশীল করতে উপপরিচালক শিবলীকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সম্প্রতি কানাডার লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট নথিপত্র পাঠায়। এই নথিপত্র পাওয়ার পর দুদকে চলতে থাকা তদন্ত আরো গতি পায়।
এসএনসি-লাভালিনের সাবেক দুই কর্মকর্তা রমেশ ও ইসমাইলকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিশ। আগামীকাল সোমবার টরন্টোর আদালতে হাজির করা হবে তাঁদের। রমেশ লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। ইসমাইল ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রকল্পবিষয়ক পরিচালক। কানাডা পুলিশের মুখপাত্রের সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, এই দুই ব্যক্তি তাঁদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অন্যায় সুবিধা আদায় করতে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। রমেশ ও ইসমাইলের বিরুদ্ধে কানাডা পুলিশ অভিযোগ গঠন করেছিল গত এপ্রিল মাসে। তাঁদের এর মধ্যে কয়েকবার আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কানাডার আইন অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
আসছে কানাডা পুলিশের প্রতিনিধিদল : পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশে আসছে কানাডার মাউন্টেড পুলিশের আট সদস্যের প্রতিনিধিদল। অন্য একটি বিষয় নিয়ে কাজের উপলক্ষে কানাডার এই তদন্ত দলটি শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছে। সেখান থেকেই তাদের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, সোমবার কানাডা পুলিশের দলটি ঢাকায় এসে প্রথমে কানাডীয় হাইকমিশনে যাবে। পরে সেখান থেকে তাদের সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুদক কার্যালয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। প্রতিনিধিদলটি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও মো. বদিউজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির মহাপরিচালক, পরিচালক ও দুই অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গেও কানাডা পুলিশের প্রতিনিধিরা কথা বলবেন। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, কানাডার তদন্ত দল এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত গ্রহণের পাশাপাশি তাদের তদন্তের বিষয়ে মৌখিক বক্তব্য দেবে। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, কানাডা পুলিশ পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শেষ করেছে। তারা তদন্তের প্রতিবেদন হাতে হাতে আমাদের কাছে দিতে চাইছে। এ জন্যই তারা আসছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল- কানাডার এসএনসি-লাভালিন, যুক্তরাজ্যের হালক্রো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একম অ্যান্ড এ জেড এল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হাই পয়েন্ট রেন্ডাল। এগুলোর মধ্যে এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছিল গত বছর। কিন্তু অনুমোদন না দিয়ে বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। বিশ্বব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়েও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এসব অভিযোগ তদন্তে নামে দুদক।
গতি পেয়েছে দুদকের তদন্ত : গত বছর সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক (তৎকালীন সহকারী পরিচালক) মির্জা জাহিদুল আলমকে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ে অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। অনুসন্ধান শেষে তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অভিযোগটি নথিভুক্ত করার সুপারিশ জানিয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে তদন্ত শেষে গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাংকের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতি অনুসন্ধানে নেমে মির্জা জাহিদুল ইসলাম প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে গত বছর ২৯ নভেম্বর পরামর্শক কাজের জন্য আবেদন করা যুক্তরাজ্যের হাই পয়েন্ট রেন্ডেল লিমিটেড, এসএনসি লাভালিন, এইকম নিউজিল্যান্ড, হ্যালক্রো গ্রুপ ও জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টের কাছে চিঠি পাঠান। একই সঙ্গে তথ্য চেয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।
যে কারণে ক্ষুব্ধ বিশ্বব্যাংক : বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া সরকারের অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু করেছে। গত ১০ এপ্রিল এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। গত ২৮ মে মালয়েশিয়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রকল্প প্রস্তাবনা বাংলাদেশের সেতু বিভাগের কাছে উপস্থাপন করে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন শর্ত শিথিল করে চূড়ান্ত প্রকল্প প্রস্তাব পেশ করতে মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিনিধিদলের আগামী ২৮ জুন আবারও বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। এই মেয়াদ শেষ হলে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ তৈরি হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস না করেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে মালয়েশিয়ার সহযোগিতায়। সরকারের এ মনোভাবের কারণেই বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি দুদককে পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতি তদন্তে চিঠি দেয়। এ ছাড়া সংস্থাটি সরকারকে চাপে রাখতে বেশ কয়েক বছর আগের বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্যও সক্রিয় মনোভাব দেখাতে শুরু করে। যোগাযোগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ার কারণেই বিশ্বব্যাংক বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
দুদক কর্মকর্তার বক্তব্য : পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে এসএনসি লাভালিনের কাছ থেকে কোনো ঘুষ চাওয়া হয়েছিল কি না এবং লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব বা অন্য কেউ কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কি না, এ বিষয়ে কথা বলার আগে দুদক অপেক্ষা করছে কানাডা পুলিশের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার জন্য। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মীর জয়নুল আবেদিন শিবলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক কানাডা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিবেদনটি পেলে আরো কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে মন্ত্রী ও সচিবদের ঘুষ বা কমিশন দাবির বিষয়ে দুদকের কাছে কোনো তথ্য নেই।
এদিকে কানাডা পুলিশ পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে তাদের তদন্ত শেষ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে কানাডীয় পুলিশের একটি প্রতিনিধিদল আগামীকাল সোমবার ঢাকায় আসছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মালয়েশিয়া সরকারের প্রস্তাবের বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখানোয় এবং নানা অভিযোগ-আপত্তি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো রকমের আপস না করায় এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সরকারের ওপর বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে। এ কারণে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তারা বারবার চাপ সৃষ্টি করছে। জানা গেছে, গত চারদলীয় জোট সরকার আমলের পাঁচটি প্রকল্পে দুর্নীতি তদন্তের জন্যও বিশ্বব্যাংক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করছে।
ঘুষ সেধেছিলেন লাভালিনের কর্মকর্তারাই : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতিসংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর রয়্যাল কানাডিয়ান মাউনটেড পুলিশ সে দেশের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন ইনকরপোরেটের টরন্টো কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট নথি জব্দ করে। এ ছাড়া গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও পেরেরে ডুহাইমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী কানাডিয়ান পুলিশের হেফাজতে থাকা নথি ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের মাধ্যমে কানাডার লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে চিঠি পাঠায় দুদক। একই সঙ্গে অনুসন্ধান কাজ গতিশীল করতে উপপরিচালক শিবলীকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সম্প্রতি কানাডার লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট নথিপত্র পাঠায়। এই নথিপত্র পাওয়ার পর দুদকে চলতে থাকা তদন্ত আরো গতি পায়।
এসএনসি-লাভালিনের সাবেক দুই কর্মকর্তা রমেশ ও ইসমাইলকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে কানাডা পুলিশ। আগামীকাল সোমবার টরন্টোর আদালতে হাজির করা হবে তাঁদের। রমেশ লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। ইসমাইল ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রকল্পবিষয়ক পরিচালক। কানাডা পুলিশের মুখপাত্রের সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, এই দুই ব্যক্তি তাঁদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অন্যায় সুবিধা আদায় করতে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। রমেশ ও ইসমাইলের বিরুদ্ধে কানাডা পুলিশ অভিযোগ গঠন করেছিল গত এপ্রিল মাসে। তাঁদের এর মধ্যে কয়েকবার আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কানাডার আইন অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
আসছে কানাডা পুলিশের প্রতিনিধিদল : পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আগামীকাল সোমবার বাংলাদেশে আসছে কানাডার মাউন্টেড পুলিশের আট সদস্যের প্রতিনিধিদল। অন্য একটি বিষয় নিয়ে কাজের উপলক্ষে কানাডার এই তদন্ত দলটি শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছে। সেখান থেকেই তাদের বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, সোমবার কানাডা পুলিশের দলটি ঢাকায় এসে প্রথমে কানাডীয় হাইকমিশনে যাবে। পরে সেখান থেকে তাদের সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুদক কার্যালয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। প্রতিনিধিদলটি দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও মো. বদিউজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির মহাপরিচালক, পরিচালক ও দুই অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গেও কানাডা পুলিশের প্রতিনিধিরা কথা বলবেন। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, কানাডার তদন্ত দল এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত গ্রহণের পাশাপাশি তাদের তদন্তের বিষয়ে মৌখিক বক্তব্য দেবে। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, কানাডা পুলিশ পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শেষ করেছে। তারা তদন্তের প্রতিবেদন হাতে হাতে আমাদের কাছে দিতে চাইছে। এ জন্যই তারা আসছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল- কানাডার এসএনসি-লাভালিন, যুক্তরাজ্যের হালক্রো গ্রুপ, নিউজিল্যান্ডের একম অ্যান্ড এ জেড এল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান হাই পয়েন্ট রেন্ডাল। এগুলোর মধ্যে এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছিল গত বছর। কিন্তু অনুমোদন না দিয়ে বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। বিশ্বব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়েও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। বিশ্বব্যাংকের এসব অভিযোগ তদন্তে নামে দুদক।
গতি পেয়েছে দুদকের তদন্ত : গত বছর সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক (তৎকালীন সহকারী পরিচালক) মির্জা জাহিদুল আলমকে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ে অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। অনুসন্ধান শেষে তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অভিযোগটি নথিভুক্ত করার সুপারিশ জানিয়ে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে তদন্ত শেষে গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাংকের কাছেও পাঠানো হয়েছে।
পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত দুর্নীতি অনুসন্ধানে নেমে মির্জা জাহিদুল ইসলাম প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে গত বছর ২৯ নভেম্বর পরামর্শক কাজের জন্য আবেদন করা যুক্তরাজ্যের হাই পয়েন্ট রেন্ডেল লিমিটেড, এসএনসি লাভালিন, এইকম নিউজিল্যান্ড, হ্যালক্রো গ্রুপ ও জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টের কাছে চিঠি পাঠান। একই সঙ্গে তথ্য চেয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়।
যে কারণে ক্ষুব্ধ বিশ্বব্যাংক : বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই বাংলাদেশ মালয়েশিয়া সরকারের অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু করেছে। গত ১০ এপ্রিল এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। গত ২৮ মে মালয়েশিয়া সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রকল্প প্রস্তাবনা বাংলাদেশের সেতু বিভাগের কাছে উপস্থাপন করে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন শর্ত শিথিল করে চূড়ান্ত প্রকল্প প্রস্তাব পেশ করতে মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিনিধিদলের আগামী ২৮ জুন আবারও বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। এই মেয়াদ শেষ হলে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সুযোগ তৈরি হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস না করেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছে মালয়েশিয়ার সহযোগিতায়। সরকারের এ মনোভাবের কারণেই বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি দুদককে পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতি তদন্তে চিঠি দেয়। এ ছাড়া সংস্থাটি সরকারকে চাপে রাখতে বেশ কয়েক বছর আগের বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্যও সক্রিয় মনোভাব দেখাতে শুরু করে। যোগাযোগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ার কারণেই বিশ্বব্যাংক বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
দুদক কর্মকর্তার বক্তব্য : পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে এসএনসি লাভালিনের কাছ থেকে কোনো ঘুষ চাওয়া হয়েছিল কি না এবং লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব বা অন্য কেউ কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কি না, এ বিষয়ে কথা বলার আগে দুদক অপেক্ষা করছে কানাডা পুলিশের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার জন্য। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মীর জয়নুল আবেদিন শিবলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক কানাডা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিবেদনটি পেলে আরো কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে মন্ত্রী ও সচিবদের ঘুষ বা কমিশন দাবির বিষয়ে দুদকের কাছে কোনো তথ্য নেই।
No comments