সংসদের সার্বভৌমত্বঃ নতুন করে পুরনো তর্ক by আমীন আল রশীদ
তর্কটা অনেকদিনের। কিন্তু সুরাহা নেই। সুরাহা অবশ্য নেইও। কেননা সংসদ সার্বভৌম কি না, তা নিয়ে দু’রকমের মতামত আছে। যারা বলেন সংসদ সার্বভৌম তাদের যুক্তি হলো, জনগণ সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায় এবং সংসদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। আর রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন বিচারপতিকে।
সুতরাং মর্যাদাগত দিক দিয়ে সংসদ বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বে। এরকমও অনেকে বলেন যে, সংসদ যেহেতু আইন প্রণয়ন করে এবং সেই আইনের আলোকেই সব প্রতিষ্ঠান চলে, সুতরাং সংসদের অবস্থান সবার উপরে। তাছাড়া সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ আর সকল ক্ষমতার মালিক যেহেতু জনগণ এবং সংসদ সদস্যরা সেই জনগণেরই প্রতিনিধি, সুতরাং সংসদ সার্বভৌম। তাছাড়া যে সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রের মূল তিন অঙ্গ আইন বিভাগ অর্থাৎ সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সৃষ্টি, সেই সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাও যেখানে সংসদের, সে হিসেবেও সংসদ সার্বভৌম।
কিন্তু যারা দাবি করেন সংসদ সার্বভৌম নয়, তাদের যুক্তি হলো সংসদ যত আইনই করুক না কেন, যদি সেটা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে উচ্চ আদালত সেটা বাতিল করতে পারে। যেমন ৭ অনুচ্ছেদেরই ২ ধারায় বলা হয়েছে : ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ এ কারণে সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় আইনের ব্যাখ্যাদাতা। অর্থাৎ সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে কিন্তু সেটার ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো গণ্ডগোল দেখা দিলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়।
সংবিধানের সবশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হলো এবং এখনও বলা হচ্ছে যে, উচ্চ আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন, সুতরাং সেটিকে আর সংবিধানে রাখার সুযোগ নেই। এখানে আমরা দেখছি, যে সংসদ সদস্যরা বলছেন সংসদ সার্বভৌম তারাই কিন্তু নিজেদের সুবিধার প্রশ্নে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রশ্নে আদালতকে নিজেদের অভিভাবক বলে জাহির করছেন। এখানে কিঞ্চিত স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়।
তবে আমাদের বিচার বিভাগ আসলেই কতটা স্বাধীন, তার কিছুটা আন্দাজ করা যায় ৫ জুন সংসদে দেয়া তোফায়েল আহমেদ এবং মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্য থেকে। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী ভাগ্যবান। তাকে আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি তাকে কনফার্ম করেনাই। এবার আমরা তাকে কনফার্ম করলাম। কিন্তু তিনি আজকে আমাদের বিরুদ্ধে, এই সংসদের বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তার নিন্দা জানাবার ভাষা আমার জানা নাই।' এ সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের দয়ায় কোনো লিখিত পরীক্ষা ছাড়া যোগ্যতা ছাড়া বিচারক হয়েছেন।’
প্রসঙ্গত, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু তোফায়েল আহমেদ বা মুজিবুল হকের কথার সারাংশ দাঁড়ায় এই যে, রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ করলেও সেখানে আইনমন্ত্রীর তথা সরকারের সম্মতি থাকতে হয়। তাছাড়া বিচারকদের পদোন্নতি, বয়স বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও যে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়, সেরকম উদাহরণও দেশে কম নেই।
দ্বিতীয়ত,সংবিধানের ৪৮ এর ৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে,এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩)দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে না হলেও বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। তার মানে বিচারবিভাগ স্বাধীন হলেও রাজনৈতিক প্রভাবমূক্ত নয়।
এ প্রসঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, সংসদ ও বিচারবিভাগ কেউই সার্বভৌম নয়; বরং সার্বভৌম হচ্ছে সেই জনগণ যাদেরকে সংবিধানে বলা হয়েছে সকল ক্ষমতার মালিক। তবে প্রশ্নটা যতটা না সার্বভৌমত্বের, তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার এবং সঙ্গত কারণেই এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য তথা ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে পটভূমিটা বলা দরকার।
হাইকোর্ট এলাকা থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সরিয়ে নিতে উচ্চ আদালত অনেক আগেই নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে সড়ক ভবনের ‘সি’ ব্লক পুরোপুরি এবং ‘এ’ ব্লকের দুটি কক্ষ খালি করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে আদালতের সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে। কিন্তু তর্কটা নতুন করে শুরু হয় গত ২৯ মে।
রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম সংসদের বৈঠকে ওইদিন পয়েন্ট অব অর্ডারে প্রশ্নটি তোলেন। তিনি বলেন, ‘আদালত সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মানতে গিয়ে এখন জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। কেননা দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে সড়ক ভবনটি ওখানে আছে। সারা দেশের স্থল যোগাযোগের মূল কাজগুলো এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং তড়িঘড়ি করে ভবনটি এখান থেকে সরিয়ে নিলে তা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করবে।’ এ বিষয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ নিজেও উচ্চ আদালত সম্পর্কে কিছু কথা বলেন। যেখানে তিনি বিচারকদের সহনশীল হবার পরামর্শ দেন। স্পিকার কিছুটা খেদের সঙ্গেই বলেন, সাধারণ মানুষ যেখানে বছরের পর বছর ঘুরেও বিচার পায় না, আদালত সেখানে নিজেদের বিষয়ে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত দিলে সেটা ঠিক ভালো দেখায় না। আদালতের কোনো সিদ্ধান্তে সরকারের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায় কি না, সেটিও বিচারকদের বিবেচনা করা উচিত বলে স্পিকার মত দেন।
এই ঘটনার পরে গত ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি ফিরিয়ে না দেওয়া সংক্রান্ত আদালত অবমাননার মামলার শুনানীতে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে স্পিকারের বক্তব্যটি উঠে আসে। যদিও সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা আছে : ‘সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ অর্থাৎ এখানে সংসদ সদস্যদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে স্পিকারের ওই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ৫ জুন আদালত যেসব মন্তব্য করেছেন তাকে সংবিধানের এই ৭৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে সংসদ সদস্যরা অভিযোগ তোলেন।
৫ জুনের শুনানীতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘স্পিকার সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিয়েছেন। তিনি সংসদের দায়মুক্তির (৭৮ অনুচ্ছেদ) অপব্যবহার করেছেন। কেননা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি এবং সংসদের রীতিনীতি অনুযায়ী, স্পিকার নিজে কোনো বিতর্ক ও আলোচনায় অংশ নিতে পারেন না।’ আদালত বলেন, ‘আমি কি হনুরে’—এ ধরনের মন্তব্য কি স্পিকার করতে পারেন? এটা কি সংসদের ভাষা? উনি সংসদের পিতা। স্পিকার সংসদের দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে যা খুশি বলতে পারেন না। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় স্পিকার থামাননি। এমনকি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে আদালত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ এবং ‘স্পিকারের ওই বক্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হওয়া উচিত’ বলেও মন্তব্য করেন।
এরপর ওইদিনই অর্থাৎ ৫ জুন সন্ধ্যায় সংসদের বৈঠকে বিষয়টি পয়েন্ট অব অর্ডারে তোলেন মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যকে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে দাবি করেন। এরপর এ বিষয়ের উপর একে একে বক্তব্য দেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, মইনুদ্দিন খান বাদল, মুজিবুল হক চুন্নু এবং সবশেষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাদের সকলের কথার সুরই ছিল এক আর তা হলো সংসদ সার্বভৌম। কেননা বিচার বিভাগ যত স্বাধীনই হোক তা সংসদের ঊর্ধ্বে নয়। সেলিম বেলেন, বিচার বিভাগের হাত লম্বা। কিন্তু সেটি সংসদের চেয়ে বড় নয়। এ সময় তারা স্পিকার সম্পর্কে ‘কটূক্তি’ করায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে তিনদিনের মধ্যে বিচারপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়ারও দাবি জানান। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার দাবি জানান। অন্যথায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পুনরায় বিচারপতিদের ইমপিচ বা অভিশংসনের ব্যবস্থা সংযোজন করার কথাও বলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল-সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিতে রাষ্ট্রপতি কোনো বিচারপতিকে অভিশংসিত করতে পারবেন। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে বিচারপতিদের বিচারের ক্ষেত্রে একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করা হয়।
স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতির ওই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংসদের অধিবেশন কক্ষ যখন উত্তপ্ত তখন একটা বিষয় আমরা খেয়াল করে দেখলাম যে, সংসদ সদস্যদের তীরগুলো কেবল বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর দিকেই। তারা এই বিচারপতির অতীত কর্মকাণ্ডও টেনে আনেন। যেমন তিনি স্যালুট না করার অপরাধে একজন পুলিশকে সাজা দিয়েছিলেন। বিমানের তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে প্রথম শ্রেণীতে যেতে না পারায় বিমানের এমডিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের অনেক সম্মানীয় ব্যক্তিকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। এসব প্রসঙ্গ টেনে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘উনি (শামসুদ্দীন চৌধুরী) একজন স্যাডিস্ট মানুষ, যে কি না অন্যকে অপমান করে আনন্দ পায়।’ একজন বিচারপতি সম্পর্কে সংসদ সদস্যরা সংসদের বৈঠকে যেসব কথা বলেছেন, এই কথাগুলোই তারা যদি সংসদের বাইরে কোথাও বলতেন তাহলে আমরা নিশ্চিত যে, তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। কিন্তু ৭৮ অনুচ্ছেদের বলে তারা রেহাই পাবেন। এ কারণেই সংসদ সদস্যরা দাবি করেন যে, সংসদ সার্বভৌম।
প্রশ্নটা এখানেই। ৭৮ অনুচ্ছেদ আছে বলেই সংসদে যেমন যা খুশি তাই বলার জায়গা নয়, তেমনি সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে বলেও তারা চাইলেই যেকোনো আইন করতে পারে না। অর্থাৎ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যেমন সংসদ করতে পারে না এবং করলেও সেটা উচ্চ আদালত বাতিল করে দিতে পারে, তেমনি বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং উচ্চ আদালত আইনের ব্যাখ্যাদাতা বলেও তারা স্পিকার সম্পর্কে বা সংসদ চলাকালে সংসদ সদস্যরা যেসব কথা বলেন সেই প্রসঙ্গ শুনানীতে টেনে এনে কোনো বিচারপতি মন্তব্য করতে পারেন না। এখানেই চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের প্রশ্ন। একজন যদি আরেকজনের চেয়ে বড় মনে করতে থাকেন, তখন ভারসাম্য নষ্ট হয়।
সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের সম্পর্কটা পরস্পর দ্বিমুখী নয় বরং একে অপরের পরিপূরক। এ কারণেই বলা হয় বিচার বিভাগ স্বাধীন। আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পোক্ত করার জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিশংসনের দায়িত্বটি সংসদের বদলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এখন যদি সংসদ সদস্যরা বলেন যে, তারা আবার বাহাত্তরের আলোকে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করবেন এবং বিচারপতিদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করবেন, সেটা বোধ হয় খুব ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ এতে করে বিচার বিভাগের মধ্যে ভয় কাজ করবে। কেননা, যখনই দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো সরকার গঠিত হবে এবং তখন যদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রায় চলে যায়, তখন দেখা যাবে দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতিতে ওই বিচারপতিকে ইমপিচ করা হচ্ছে। এতে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য যেমন নষ্ট হবে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রধানতম এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মর্যাদাগত ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত থাকবে; যা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। কেননা, আইন ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি হলে তার পরিণতি তৃতীয় শক্তি। আর তৃতীয় শক্তি মানে যে ভালো কিছু নয়, তা এদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর বহুবার দেখেছে।
আমীন আল রশীদ: সিনিয়র রিপোর্টার এবিসি রেডিও,
‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক’ বইয়ের লেখক
ইমেইল: aminalrasheed@gmail.com
কিন্তু যারা দাবি করেন সংসদ সার্বভৌম নয়, তাদের যুক্তি হলো সংসদ যত আইনই করুক না কেন, যদি সেটা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে উচ্চ আদালত সেটা বাতিল করতে পারে। যেমন ৭ অনুচ্ছেদেরই ২ ধারায় বলা হয়েছে : ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ এ কারণে সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় আইনের ব্যাখ্যাদাতা। অর্থাৎ সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে কিন্তু সেটার ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো গণ্ডগোল দেখা দিলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়।
সংবিধানের সবশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়েও যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হলো এবং এখনও বলা হচ্ছে যে, উচ্চ আদালত যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন, সুতরাং সেটিকে আর সংবিধানে রাখার সুযোগ নেই। এখানে আমরা দেখছি, যে সংসদ সদস্যরা বলছেন সংসদ সার্বভৌম তারাই কিন্তু নিজেদের সুবিধার প্রশ্নে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রশ্নে আদালতকে নিজেদের অভিভাবক বলে জাহির করছেন। এখানে কিঞ্চিত স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়।
তবে আমাদের বিচার বিভাগ আসলেই কতটা স্বাধীন, তার কিছুটা আন্দাজ করা যায় ৫ জুন সংসদে দেয়া তোফায়েল আহমেদ এবং মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্য থেকে। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী ভাগ্যবান। তাকে আবদুল মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি তাকে কনফার্ম করেনাই। এবার আমরা তাকে কনফার্ম করলাম। কিন্তু তিনি আজকে আমাদের বিরুদ্ধে, এই সংসদের বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তার নিন্দা জানাবার ভাষা আমার জানা নাই।' এ সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের দয়ায় কোনো লিখিত পরীক্ষা ছাড়া যোগ্যতা ছাড়া বিচারক হয়েছেন।’
প্রসঙ্গত, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু তোফায়েল আহমেদ বা মুজিবুল হকের কথার সারাংশ দাঁড়ায় এই যে, রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ করলেও সেখানে আইনমন্ত্রীর তথা সরকারের সম্মতি থাকতে হয়। তাছাড়া বিচারকদের পদোন্নতি, বয়স বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও যে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়, সেরকম উদাহরণও দেশে কম নেই।
দ্বিতীয়ত,সংবিধানের ৪৮ এর ৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে,এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩)দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে না হলেও বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন। তার মানে বিচারবিভাগ স্বাধীন হলেও রাজনৈতিক প্রভাবমূক্ত নয়।
এ প্রসঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, সংসদ ও বিচারবিভাগ কেউই সার্বভৌম নয়; বরং সার্বভৌম হচ্ছে সেই জনগণ যাদেরকে সংবিধানে বলা হয়েছে সকল ক্ষমতার মালিক। তবে প্রশ্নটা যতটা না সার্বভৌমত্বের, তার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার এবং সঙ্গত কারণেই এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য তথা ‘চেক এন্ড ব্যালান্স’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে পটভূমিটা বলা দরকার।
হাইকোর্ট এলাকা থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সরিয়ে নিতে উচ্চ আদালত অনেক আগেই নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে সড়ক ভবনের ‘সি’ ব্লক পুরোপুরি এবং ‘এ’ ব্লকের দুটি কক্ষ খালি করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে আদালতের সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে। কিন্তু তর্কটা নতুন করে শুরু হয় গত ২৯ মে।
রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম সংসদের বৈঠকে ওইদিন পয়েন্ট অব অর্ডারে প্রশ্নটি তোলেন। তিনি বলেন, ‘আদালত সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মানতে গিয়ে এখন জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। কেননা দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে সড়ক ভবনটি ওখানে আছে। সারা দেশের স্থল যোগাযোগের মূল কাজগুলো এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং তড়িঘড়ি করে ভবনটি এখান থেকে সরিয়ে নিলে তা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করবে।’ এ বিষয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ নিজেও উচ্চ আদালত সম্পর্কে কিছু কথা বলেন। যেখানে তিনি বিচারকদের সহনশীল হবার পরামর্শ দেন। স্পিকার কিছুটা খেদের সঙ্গেই বলেন, সাধারণ মানুষ যেখানে বছরের পর বছর ঘুরেও বিচার পায় না, আদালত সেখানে নিজেদের বিষয়ে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত দিলে সেটা ঠিক ভালো দেখায় না। আদালতের কোনো সিদ্ধান্তে সরকারের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায় কি না, সেটিও বিচারকদের বিবেচনা করা উচিত বলে স্পিকার মত দেন।
এই ঘটনার পরে গত ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি ফিরিয়ে না দেওয়া সংক্রান্ত আদালত অবমাননার মামলার শুনানীতে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে স্পিকারের বক্তব্যটি উঠে আসে। যদিও সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা আছে : ‘সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ অর্থাৎ এখানে সংসদ সদস্যদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে স্পিকারের ওই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ৫ জুন আদালত যেসব মন্তব্য করেছেন তাকে সংবিধানের এই ৭৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে সংসদ সদস্যরা অভিযোগ তোলেন।
৫ জুনের শুনানীতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘স্পিকার সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিয়েছেন। তিনি সংসদের দায়মুক্তির (৭৮ অনুচ্ছেদ) অপব্যবহার করেছেন। কেননা সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি এবং সংসদের রীতিনীতি অনুযায়ী, স্পিকার নিজে কোনো বিতর্ক ও আলোচনায় অংশ নিতে পারেন না।’ আদালত বলেন, ‘আমি কি হনুরে’—এ ধরনের মন্তব্য কি স্পিকার করতে পারেন? এটা কি সংসদের ভাষা? উনি সংসদের পিতা। স্পিকার সংসদের দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে যা খুশি বলতে পারেন না। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় স্পিকার থামাননি। এমনকি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে আদালত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ এবং ‘স্পিকারের ওই বক্তব্যের জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হওয়া উচিত’ বলেও মন্তব্য করেন।
এরপর ওইদিনই অর্থাৎ ৫ জুন সন্ধ্যায় সংসদের বৈঠকে বিষয়টি পয়েন্ট অব অর্ডারে তোলেন মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যকে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে দাবি করেন। এরপর এ বিষয়ের উপর একে একে বক্তব্য দেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, মইনুদ্দিন খান বাদল, মুজিবুল হক চুন্নু এবং সবশেষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাদের সকলের কথার সুরই ছিল এক আর তা হলো সংসদ সার্বভৌম। কেননা বিচার বিভাগ যত স্বাধীনই হোক তা সংসদের ঊর্ধ্বে নয়। সেলিম বেলেন, বিচার বিভাগের হাত লম্বা। কিন্তু সেটি সংসদের চেয়ে বড় নয়। এ সময় তারা স্পিকার সম্পর্কে ‘কটূক্তি’ করায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে তিনদিনের মধ্যে বিচারপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়ারও দাবি জানান। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার দাবি জানান। অন্যথায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পুনরায় বিচারপতিদের ইমপিচ বা অভিশংসনের ব্যবস্থা সংযোজন করার কথাও বলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল-সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিতে রাষ্ট্রপতি কোনো বিচারপতিকে অভিশংসিত করতে পারবেন। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে বিচারপতিদের বিচারের ক্ষেত্রে একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করা হয়।
স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতির ওই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংসদের অধিবেশন কক্ষ যখন উত্তপ্ত তখন একটা বিষয় আমরা খেয়াল করে দেখলাম যে, সংসদ সদস্যদের তীরগুলো কেবল বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর দিকেই। তারা এই বিচারপতির অতীত কর্মকাণ্ডও টেনে আনেন। যেমন তিনি স্যালুট না করার অপরাধে একজন পুলিশকে সাজা দিয়েছিলেন। বিমানের তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে প্রথম শ্রেণীতে যেতে না পারায় বিমানের এমডিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের অনেক সম্মানীয় ব্যক্তিকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। এসব প্রসঙ্গ টেনে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘উনি (শামসুদ্দীন চৌধুরী) একজন স্যাডিস্ট মানুষ, যে কি না অন্যকে অপমান করে আনন্দ পায়।’ একজন বিচারপতি সম্পর্কে সংসদ সদস্যরা সংসদের বৈঠকে যেসব কথা বলেছেন, এই কথাগুলোই তারা যদি সংসদের বাইরে কোথাও বলতেন তাহলে আমরা নিশ্চিত যে, তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। কিন্তু ৭৮ অনুচ্ছেদের বলে তারা রেহাই পাবেন। এ কারণেই সংসদ সদস্যরা দাবি করেন যে, সংসদ সার্বভৌম।
প্রশ্নটা এখানেই। ৭৮ অনুচ্ছেদ আছে বলেই সংসদে যেমন যা খুশি তাই বলার জায়গা নয়, তেমনি সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে বলেও তারা চাইলেই যেকোনো আইন করতে পারে না। অর্থাৎ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যেমন সংসদ করতে পারে না এবং করলেও সেটা উচ্চ আদালত বাতিল করে দিতে পারে, তেমনি বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং উচ্চ আদালত আইনের ব্যাখ্যাদাতা বলেও তারা স্পিকার সম্পর্কে বা সংসদ চলাকালে সংসদ সদস্যরা যেসব কথা বলেন সেই প্রসঙ্গ শুনানীতে টেনে এনে কোনো বিচারপতি মন্তব্য করতে পারেন না। এখানেই চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের প্রশ্ন। একজন যদি আরেকজনের চেয়ে বড় মনে করতে থাকেন, তখন ভারসাম্য নষ্ট হয়।
সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের সম্পর্কটা পরস্পর দ্বিমুখী নয় বরং একে অপরের পরিপূরক। এ কারণেই বলা হয় বিচার বিভাগ স্বাধীন। আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পোক্ত করার জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিশংসনের দায়িত্বটি সংসদের বদলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এখন যদি সংসদ সদস্যরা বলেন যে, তারা আবার বাহাত্তরের আলোকে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করবেন এবং বিচারপতিদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করবেন, সেটা বোধ হয় খুব ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ এতে করে বিচার বিভাগের মধ্যে ভয় কাজ করবে। কেননা, যখনই দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো সরকার গঠিত হবে এবং তখন যদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রায় চলে যায়, তখন দেখা যাবে দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতিতে ওই বিচারপতিকে ইমপিচ করা হচ্ছে। এতে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য যেমন নষ্ট হবে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রধানতম এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মর্যাদাগত ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত থাকবে; যা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। কেননা, আইন ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি হলে তার পরিণতি তৃতীয় শক্তি। আর তৃতীয় শক্তি মানে যে ভালো কিছু নয়, তা এদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর বহুবার দেখেছে।
আমীন আল রশীদ: সিনিয়র রিপোর্টার এবিসি রেডিও,
‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী : আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক’ বইয়ের লেখক
ইমেইল: aminalrasheed@gmail.com
No comments