সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা এবং আমাদের প্রত্যাশার বাস্তবতা by ওয়াহিদ নবি
সেনানায়কদের হাত থেকে সরকারের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে আসার পর ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। চার-চারটি সরকার নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু কোনো দল পর পর দুবার নির্বাচিত হতে সক্ষম হয়নি। কেন এমন হলো? আমাদের গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া প্রয়োজন।
প্রথম যে কথাটি মনে আসে তা হচ্ছে, কেন একটি দল জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অন্যান্য সম্ভাব্য কারণও থাকতে পারে।
আমাদের গণতন্ত্র খুবই নতুন। মাত্র ২০ বছরের। এটা আমরা বুঝতে চাই না কখনো কখনো। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্র ৯০০ বছরের এবং সেখানে এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। অনেক সমস্যা দূর করতে তাদের বহু বছর লেগেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে ৪০ শিলিং বা এর ওপরে যাঁদের সম্পত্তি ছিল, তাঁরাই শুধু ভোট দিতে পেরেছেন বহু বছর ধরে। তার চেয়েও বড় কথা, গণতন্ত্র প্রচলনের ৭০০ বছর পর মহিলারা ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছেন এবং সেটাও ভোট দেওয়ার অধিকার পাওয়ার জন্য জীবন দান করার পর।
আমাদের বুঝতে হবে, গঠনমূলক কাজ করার জন্য কোনো সরকারের পাঁচ বছর যথেষ্ট সময় নয়। অবশ্য এটাও ঠিক যে ভালো কাজ না করলে বা মন্দ কাজ করলে একটি দল পুনর্নির্বাচিত হবে না। সমস্যা আমাদের জন্য এই যে প্রতিটি নির্বাচনে সরকার বদল হলে আমাদের দেশে উন্নয়নমূলক কাজ তেমন কিছুই হবে না। এ প্রসঙ্গে আরো দু-একটি কথা এসে যায়। আমরা বলি যে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ভালো নন। এ জন্য মাঝেমধ্যে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতা দখল করেছেন। কিন্তু তাঁরা যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভালো কিছু করেননি, তা ইতিহাস বলে দেয়। অরাজনৈতিক সরকার দুই নেত্রীকে মাইনাস করার কথা বলেছিল, কিন্তু জনগণ তাদেরই মাইনাস করে দিয়েছে। আমাদের মুরব্বিজনরা দুই নেত্রীর এক টেবিলে বসার কথা মাঝেমধ্যেই বলেন, কিন্তু তা কেন যে হচ্ছে না, সে সম্পর্কে কিছু বলেন না। আসলেই ধর্ম যাদের রাজনৈতিক মূলধন, তাদের সঙ্গে পার্থিব আদর্শে বিশ্বাসীদের আপস সম্ভব কি না, এটা ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে যেখানে ধর্মের নাম করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করা হয়েছে। তবু দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে কাজ করার মতো একটা সম্পর্ক থাকলে ভালো হয়। কী করলে সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে, সেটা সবাইকে ভাবতে হবে। কাজটি খুব সহজ নয়। উপদেশ দেওয়ার জন্য মুরবি্বদের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর সময় কাটানোর জন্য তাঁরা ভূরি ভূরি উপদেশ দিয়ে চলেছেন, যার বেশির ভাগই গণতন্ত্রের আদর্শের পরিপন্থী। চাকরি করার সময় তাঁরা কী অবদান রেখেছিলেন, তা অনেকেই আজ জানতে চায়।
পাঁচ বছরে একটি সরকার উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে না- এটা যদি আমরা বিশ্বাস করি, তবে সরকার পরিবর্তন করার আগে বা ভোট দেওয়ার আগে আমাদের কিছু চিন্তা করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত মানুষ হিসেবে আমরা প্রাত্যহিকতার আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। আর তা জেনেই সংবাদমাধ্যম উত্তেজনাকর সংবাদ পরিবেশন করে। একটি সরকারের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা বিচার করার সময় তারা ইদানীং কী করছে শুধু তা না দেখে তাদের দীর্ঘকালীন কাজের বা অকাজের তালিকা দেখা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত আমরা ধনী দেশের মানুষ নই। দারিদ্র্যের কারণে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা অনেক সমস্যায় জর্জরিত। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের সব সমস্যা দূর করে দেবে। কিন্তু পদ্মা সেতু বানাতে যে অর্থের প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। অন্য দেশ থেকে অর্থ জোগাড় করতে হয় এবং এ জন্য প্রচুর সময় লাগে। দারিদ্র্য দুর্নীতির জন্ম দেয়। এ জন্য দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যেহেতু আমরা দুর্নীতির শিকার, তাই প্রায় সব সময় অভিযোগ উঠলেই আমরা ধরে নিই অভিযোগটা সত্য (এবং প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়)। আরো একটি কথা মনে রাখতে হবে যে সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা থাকে। এর একটা বড় অংশ হচ্ছেন আমলারা। যদিও তাঁদের কার্যকলাপের জন্য রাজনীতিবিদরা দায়ী হবেন, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমলারা সবাই সজ্জন নন। বিভিন্ন সরকারি অফিসে কাজের জন্য যাঁরা গেছেন এটা তাঁরা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। এটা আমাদের বুঝতে হবে এবং মনে রাখতে হবে এ জন্য আমাদের অনেকের আমলাতন্ত্রের প্রতি একটা অবাস্তব শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।
এবার বর্তমান সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার কথা বিবেচনা করা যাক। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকার এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে যেখানে ১৫ কোটি মানুষ বাস করে, সেখানে এটি একটি বড় সাফল্য। কয়েক বছর আগে সারের দাবিতে কৃষকদের জীবন দিতে হয়েছিল। সরকার সার সমস্যার সমাধান করেছে। বিদ্যুৎ সমস্যা আমাদের একটি বড় সমস্যা। এ সরকার বিদ্যুৎ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে চাহিদা আরো বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে; কিন্তু সরবরাহ আরো ভালো করতে হবে। আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে, আমরা একটি সমস্যার সামগ্রিক পরিকল্পনা করি না। এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি। সিটমহলগুলোর একটি সমাধান করেছে সরকার। পাঠ্য বই সরবরাহের ব্যাপারে ভালো কাজ করেছে সরকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় সত্ত্বেও। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। জঙ্গিদের অত্যাচার থেমে গেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এটি একটি বিশাল কাজ। আমরা মাঝেমধ্যে অধৈর্য হয়ে পড়ছি। আমাদের বুঝতে হবে যে সরকারকে দেশি-বিদেশি অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। রাজধানীর যানজট দূর করার জন্য উড়াল সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তায় বেশ কিছু নতুন বাস দেওয়া হয়েছে। সরকার উপযুক্ততার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহ সামাল দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে গিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে সাফল্য অর্জন করেছে। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বেড়েছে। এ ছাড়া অনেক সফলতা রয়েছে। অবশ্য সাফল্যের তালিকা আরো দীর্ঘতর হলে ভালো হতো।
শেয়ার মার্কেটে ধস সরকারের জন্য একটা খারাপ খবর। সরকার এ সমস্যার একটা সমাধান করুক, এটা জনগণ চায়। ছাত্রলীগের কার্যকলাপে মানুষ খুশি নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রীর কিছু উক্তি মানুষ পছন্দ করেনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা। প্রমাণ ছাড়া কোনো কথা বললে বা ঝাঁজালো একটা কিছু তিনি বললে মানুষ ব্যথিত হয়। 'পলিটিশিয়ান' থেকে 'স্টেটসম্যান'-এ তিনি উন্নীত হন- এটাই জনগণ আশা করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে গেলে বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ আরো উন্নত করতে হবে। র্যাবের ভূমিকা আরো স্বচ্ছ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য যে ধরনের পক্ষপাতহীন আচরণ করতে হয়, সেখানেও ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি দ্রুত দূর করতে হবে। কারণ এ বিষয়টি জনগণ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই কাম্য।
আমাদের সুধীজনরা যা-ই বলুন না কেন, আকাশ থেকে সহসাই কোনো আদর্শ ব্যক্তি নেমে আসছেন না এই মর্ত্যলোকে। আমাদের যা আছে, তা নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে, চলতে হবে। বর্তমান সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলনা করতে হবে পূর্ববর্তী সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার সঙ্গে। ইলিয়াস আলীকে এখনো পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার সমাধানও হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারের আমলেও সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছিল। বিরোধী দলের জনসভায় বোমা মেরে বহু মানুষকে হতাহত করা হয়েছিল। জনগণের প্রতিনিধিদের হত্যা করা হয়েছিল। তৎকালীন ক্ষমতাসীনরাই জড়িত ছিল এসব দুষ্কর্মে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে সরকার একটা বিশেষ অসুবিধায় রয়েছে। বিরোধী দলের ব্যর্থতাগুলো ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিচির (Friedrich Nietzsche) সর্বজন পরিচিত উক্তি আমাদের মনে রাখতে হবে- 'মানুষের স্মরণশক্তি খুবই কম'। বেশ কয়েক বছর আগে ঘটা আজকের বিরোধী দলের ব্যর্থতার কথা মানুষ অনেকটাই ভুলে গেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে- তারা কী করেছে, তা জনগণকে গুছিয়ে বলতে পারে না। তারা বিরোধী দলের সঙ্গে ঝগড়া করাটাই বেশি উপভোগ করে। ড. ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত নন। ব্যস। ফুলস্টপ। সোহেল তাজ পদত্যাগ করে আমেরিকা চলে গেছেন। এসব নিয়ে টানাহেঁচড়া কেন? বিতর্কিত ব্যাপার নিয়ে যত ঘাঁটাঘাঁটি হবে- সরকার ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের জন্য ভালো হবে যদি তারা বাকি সময়টা গঠনমূলক কাজে মন দেয় এবং জনসংযোগমূলক কাজকে গুরুত্ব দেয়।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী চিকিৎসক
আমাদের গণতন্ত্র খুবই নতুন। মাত্র ২০ বছরের। এটা আমরা বুঝতে চাই না কখনো কখনো। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্র ৯০০ বছরের এবং সেখানে এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। অনেক সমস্যা দূর করতে তাদের বহু বছর লেগেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে ৪০ শিলিং বা এর ওপরে যাঁদের সম্পত্তি ছিল, তাঁরাই শুধু ভোট দিতে পেরেছেন বহু বছর ধরে। তার চেয়েও বড় কথা, গণতন্ত্র প্রচলনের ৭০০ বছর পর মহিলারা ভোট দেওয়ার অধিকার পেয়েছেন এবং সেটাও ভোট দেওয়ার অধিকার পাওয়ার জন্য জীবন দান করার পর।
আমাদের বুঝতে হবে, গঠনমূলক কাজ করার জন্য কোনো সরকারের পাঁচ বছর যথেষ্ট সময় নয়। অবশ্য এটাও ঠিক যে ভালো কাজ না করলে বা মন্দ কাজ করলে একটি দল পুনর্নির্বাচিত হবে না। সমস্যা আমাদের জন্য এই যে প্রতিটি নির্বাচনে সরকার বদল হলে আমাদের দেশে উন্নয়নমূলক কাজ তেমন কিছুই হবে না। এ প্রসঙ্গে আরো দু-একটি কথা এসে যায়। আমরা বলি যে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ভালো নন। এ জন্য মাঝেমধ্যে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতা দখল করেছেন। কিন্তু তাঁরা যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভালো কিছু করেননি, তা ইতিহাস বলে দেয়। অরাজনৈতিক সরকার দুই নেত্রীকে মাইনাস করার কথা বলেছিল, কিন্তু জনগণ তাদেরই মাইনাস করে দিয়েছে। আমাদের মুরব্বিজনরা দুই নেত্রীর এক টেবিলে বসার কথা মাঝেমধ্যেই বলেন, কিন্তু তা কেন যে হচ্ছে না, সে সম্পর্কে কিছু বলেন না। আসলেই ধর্ম যাদের রাজনৈতিক মূলধন, তাদের সঙ্গে পার্থিব আদর্শে বিশ্বাসীদের আপস সম্ভব কি না, এটা ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে যেখানে ধর্মের নাম করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করা হয়েছে। তবু দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে কাজ করার মতো একটা সম্পর্ক থাকলে ভালো হয়। কী করলে সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে, সেটা সবাইকে ভাবতে হবে। কাজটি খুব সহজ নয়। উপদেশ দেওয়ার জন্য মুরবি্বদের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাকরিজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর সময় কাটানোর জন্য তাঁরা ভূরি ভূরি উপদেশ দিয়ে চলেছেন, যার বেশির ভাগই গণতন্ত্রের আদর্শের পরিপন্থী। চাকরি করার সময় তাঁরা কী অবদান রেখেছিলেন, তা অনেকেই আজ জানতে চায়।
পাঁচ বছরে একটি সরকার উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারবে না- এটা যদি আমরা বিশ্বাস করি, তবে সরকার পরিবর্তন করার আগে বা ভোট দেওয়ার আগে আমাদের কিছু চিন্তা করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত মানুষ হিসেবে আমরা প্রাত্যহিকতার আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। আর তা জেনেই সংবাদমাধ্যম উত্তেজনাকর সংবাদ পরিবেশন করে। একটি সরকারের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা বিচার করার সময় তারা ইদানীং কী করছে শুধু তা না দেখে তাদের দীর্ঘকালীন কাজের বা অকাজের তালিকা দেখা উচিত। দুর্ভাগ্যবশত আমরা ধনী দেশের মানুষ নই। দারিদ্র্যের কারণে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা অনেক সমস্যায় জর্জরিত। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের সব সমস্যা দূর করে দেবে। কিন্তু পদ্মা সেতু বানাতে যে অর্থের প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। অন্য দেশ থেকে অর্থ জোগাড় করতে হয় এবং এ জন্য প্রচুর সময় লাগে। দারিদ্র্য দুর্নীতির জন্ম দেয়। এ জন্য দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যেহেতু আমরা দুর্নীতির শিকার, তাই প্রায় সব সময় অভিযোগ উঠলেই আমরা ধরে নিই অভিযোগটা সত্য (এবং প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়)। আরো একটি কথা মনে রাখতে হবে যে সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা থাকে। এর একটা বড় অংশ হচ্ছেন আমলারা। যদিও তাঁদের কার্যকলাপের জন্য রাজনীতিবিদরা দায়ী হবেন, তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমলারা সবাই সজ্জন নন। বিভিন্ন সরকারি অফিসে কাজের জন্য যাঁরা গেছেন এটা তাঁরা মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন। এটা আমাদের বুঝতে হবে এবং মনে রাখতে হবে এ জন্য আমাদের অনেকের আমলাতন্ত্রের প্রতি একটা অবাস্তব শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে।
এবার বর্তমান সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতার কথা বিবেচনা করা যাক। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকার এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশে যেখানে ১৫ কোটি মানুষ বাস করে, সেখানে এটি একটি বড় সাফল্য। কয়েক বছর আগে সারের দাবিতে কৃষকদের জীবন দিতে হয়েছিল। সরকার সার সমস্যার সমাধান করেছে। বিদ্যুৎ সমস্যা আমাদের একটি বড় সমস্যা। এ সরকার বিদ্যুৎ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে চাহিদা আরো বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে; কিন্তু সরবরাহ আরো ভালো করতে হবে। আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে, আমরা একটি সমস্যার সামগ্রিক পরিকল্পনা করি না। এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি। সিটমহলগুলোর একটি সমাধান করেছে সরকার। পাঠ্য বই সরবরাহের ব্যাপারে ভালো কাজ করেছে সরকার অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় সত্ত্বেও। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। জঙ্গিদের অত্যাচার থেমে গেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি হয়েছে। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এটি একটি বিশাল কাজ। আমরা মাঝেমধ্যে অধৈর্য হয়ে পড়ছি। আমাদের বুঝতে হবে যে সরকারকে দেশি-বিদেশি অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। রাজধানীর যানজট দূর করার জন্য উড়াল সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তায় বেশ কিছু নতুন বাস দেওয়া হয়েছে। সরকার উপযুক্ততার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহ সামাল দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে গিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণে সাফল্য অর্জন করেছে। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বেড়েছে। এ ছাড়া অনেক সফলতা রয়েছে। অবশ্য সাফল্যের তালিকা আরো দীর্ঘতর হলে ভালো হতো।
শেয়ার মার্কেটে ধস সরকারের জন্য একটা খারাপ খবর। সরকার এ সমস্যার একটা সমাধান করুক, এটা জনগণ চায়। ছাত্রলীগের কার্যকলাপে মানুষ খুশি নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রীর কিছু উক্তি মানুষ পছন্দ করেনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা। প্রমাণ ছাড়া কোনো কথা বললে বা ঝাঁজালো একটা কিছু তিনি বললে মানুষ ব্যথিত হয়। 'পলিটিশিয়ান' থেকে 'স্টেটসম্যান'-এ তিনি উন্নীত হন- এটাই জনগণ আশা করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে গেলে বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ আরো উন্নত করতে হবে। র্যাবের ভূমিকা আরো স্বচ্ছ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য যে ধরনের পক্ষপাতহীন আচরণ করতে হয়, সেখানেও ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি দ্রুত দূর করতে হবে। কারণ এ বিষয়টি জনগণ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই কাম্য।
আমাদের সুধীজনরা যা-ই বলুন না কেন, আকাশ থেকে সহসাই কোনো আদর্শ ব্যক্তি নেমে আসছেন না এই মর্ত্যলোকে। আমাদের যা আছে, তা নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে, চলতে হবে। বর্তমান সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলনা করতে হবে পূর্ববর্তী সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার সঙ্গে। ইলিয়াস আলীকে এখনো পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার সমাধানও হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারের আমলেও সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছিল। বিরোধী দলের জনসভায় বোমা মেরে বহু মানুষকে হতাহত করা হয়েছিল। জনগণের প্রতিনিধিদের হত্যা করা হয়েছিল। তৎকালীন ক্ষমতাসীনরাই জড়িত ছিল এসব দুষ্কর্মে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে সরকার একটা বিশেষ অসুবিধায় রয়েছে। বিরোধী দলের ব্যর্থতাগুলো ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিচির (Friedrich Nietzsche) সর্বজন পরিচিত উক্তি আমাদের মনে রাখতে হবে- 'মানুষের স্মরণশক্তি খুবই কম'। বেশ কয়েক বছর আগে ঘটা আজকের বিরোধী দলের ব্যর্থতার কথা মানুষ অনেকটাই ভুলে গেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে- তারা কী করেছে, তা জনগণকে গুছিয়ে বলতে পারে না। তারা বিরোধী দলের সঙ্গে ঝগড়া করাটাই বেশি উপভোগ করে। ড. ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত নন। ব্যস। ফুলস্টপ। সোহেল তাজ পদত্যাগ করে আমেরিকা চলে গেছেন। এসব নিয়ে টানাহেঁচড়া কেন? বিতর্কিত ব্যাপার নিয়ে যত ঘাঁটাঘাঁটি হবে- সরকার ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের জন্য ভালো হবে যদি তারা বাকি সময়টা গঠনমূলক কাজে মন দেয় এবং জনসংযোগমূলক কাজকে গুরুত্ব দেয়।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী চিকিৎসক
No comments