ডার্ক জার্নালিজম by সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে। নিজের প্রতিষ্ঠানেরই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করলো একটি চ্যানেল। আর কাজটি করেছে একুশে টেলিভিশন। রিপোর্টারের নাম মাহাথির ফারুকী। অভিযোগ দুর্নীতির। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে তাকে আবার স্বপদে বহালও রেখেছে একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ।
মাহাথিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি এমএলএম ব্যবসার বিরুদ্ধে অনেক রিপোর্ট করেছেন। প্রতিটি রিপোর্টই ছিল বেশ আক্রমণাত্মক। বেশ জোরশোরেই রিপোর্ট করেছেন মাহাথির। এখন অবশ্য বেশ জোরশোরেই প্রচারণা পাচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। যে এমএলএম ব্যবসার বিরুদ্ধে মাহাথির রিপোর্ট করলেন সেই ব্যবসার সাথেই জড়িত তিনি নিজে।
তার নিজের চ্যানেলেই রিপোর্ট হলো যে তিনি এবং তার স্ত্রী গ্লোবার মানি সুইং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। একুশে টিভির পরিচয়ে এই কোম্পানিতে টাকা খাটাতে মানুষকে প্রভাবিত করেছেন মাহাথির। এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন তিনি আর স্ত্রী কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন।
রিপোর্ট হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে। এখন পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহরের দেয়াল। কিন্তু কেন এখনো একুশে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? আমি এটা জানতে কথা বলেছি একুশে টেলিভিশনের চেযারম্যান আবদুস সালামের সাথে। তার কথা “ মাহাথির এমএলএম ব্যবসার সাথে নিজে জড়িয়ে নৈতিকভাবে ঠিক কাজ করেনি, কিন্ত সে মানুষের অর্থ আত্মসাত করেছেন এমন প্রমাণ এখনো পাইনি।”
মাহাথিরও তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আমরাও পুরো বিষয়টা নিশ্চিত নই যে মাহাথির আসলেই কী করেছেন। আমরা আশা করতে চাই তিনি এ ধরনের কিছু করনেনি।
সাংবাদিকতায় ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বলে এক ধরনের সাংবাদিকতা আছে। এই সাংবাদিকতা হলো সত্য লেখা বা বলার চেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা, কোনো ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এক পক্ষে নিয়ে যাওয়া। হলুদ সাংবাদিকতায় সত্যতা কম থাকে, সূত্রের বরাত থাকে কম, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে রিপোর্টার। রিপোর্টে থাকে না কোনো ভারসাম্য। ন্যায্যতারও কোনো বালাই থাকে না।
কিন্তু একে কি বলা যাবে? কালো সাংবাদিকতা? বেশ ক’বছর আগে ফর্বস ম্যাগাজিনে একটা লেখা পড়েছিলাম যার শিরোনাম ছিলো ‘ডার্ক জার্নালিজম’। সাংবাদিকতায় সরকারের সেন্সরশিপই বড় সমস্যা নয়। এরচেয়ে বড় সমস্যা সাংবাদিকতার নামে এ ধরনের দুর্নীতি।
এই দুর্নীতি এমন যে অনেক সংবাদই আর আলোর মুখ দেখেনা। আবার এমন অনেক সংবাদই করা হয় কোনো না কোনো পক্ষের স্বার্থ হাসিলের জন্য। এ দুটো কাজই হয় অর্থের বিনিময়ে। এই অর্থ রিপোর্টার নিজে হজম করেন বা তার কর্তৃপক্ষের কেউ করে। আর আছে ব্ল্যাক মেইলিংয়ের সংস্কৃতি।
চিনে চেকবুক সাংবাদিকতা নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে ফর্বস ম্যাগাজিন এই ডার্ক জার্নালিজম’র কথা বলেছে। চেকবই কিংবা নগদ যেভাবেই হোক না কেন, আমাদের সাংবাদিকতায় এই সংস্কৃতি চলে আসছে এমনটা শুনা যায় সাংবাদিকদের আড্ডাতেই।
‘Journalists have many ways to drum up extra cash’ বলেছে ফর্বস ম্যাগাজিন। আমাদের এখানে কিছু কিছু সাংবাদিকের অবস্থা দেখলে এমনটা মনে হয়। এমন দু’একজনকে সবাই চেনেন। কি একটা সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক তথাকথিত অর্থ-বাণিজ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন চালান একজন। সেখানে যা লেখা থাকে তার বেশিরভাগেরই নেই কোনো মান। পত্রিকা জুড়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক আর বীমা কোম্পানির প্রেস রিলিজ। আর তার বিনিময়ে থাকে সেইসব ব্যাংক আর বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। সেই ব্যাক্তি এখন দেশের অন্যতম ধনী সাংবাদিক।
তার অনুসারী আছেন আরো বেশ ক’জন। এমনই একজনের কাজ হলো বছর বছর ব্যবসায়ীদের পদক দেয়া। তার বিনিময়ে অর্থ আয়। তিনি অনেক চেষ্টা করেও মূল ধারার সাংবাদিকতায় থাকতে পারেননি। কিন্তু এখানে তিনি সফল।
এমন অনেক উদাহরণ হয়তো দেয়া যাবে। সে তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমনটা হচ্ছে কেন? একটি কারণ হলো দায়বদ্ধতার অভাব। আরেকটি কারণ হলো যদি দেশে দুর্নীতির সংস্কৃতি থাকে, তবে গণমাধ্যমই বা তার থেকে দূরে থাকে কী করে?
সাংবাদিকতায় আছে একটি মুনাফাখোর গোষ্ঠী। এরা আসলে ভুয়া সাংবাদিক। কিন্তু সিস্টেমটাই এমন যে এদের অনেকেই আবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন আর সংস্থায়ও বেশ প্রভাবশালী।
ফর্বস ম্যাগাজিন চিনের কিছু কিছু এলাকায় সাংবাদিকতার এমন অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছে ‘People say that you can be a fruit stand owner one day and a journalist the next.’। বাংলাদেশেও কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন নয়?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
তার নিজের চ্যানেলেই রিপোর্ট হলো যে তিনি এবং তার স্ত্রী গ্লোবার মানি সুইং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। একুশে টিভির পরিচয়ে এই কোম্পানিতে টাকা খাটাতে মানুষকে প্রভাবিত করেছেন মাহাথির। এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন তিনি আর স্ত্রী কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন।
রিপোর্ট হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে। এখন পোস্টারে ছেয়ে গেছে শহরের দেয়াল। কিন্তু কেন এখনো একুশে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? আমি এটা জানতে কথা বলেছি একুশে টেলিভিশনের চেযারম্যান আবদুস সালামের সাথে। তার কথা “ মাহাথির এমএলএম ব্যবসার সাথে নিজে জড়িয়ে নৈতিকভাবে ঠিক কাজ করেনি, কিন্ত সে মানুষের অর্থ আত্মসাত করেছেন এমন প্রমাণ এখনো পাইনি।”
মাহাথিরও তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আমরাও পুরো বিষয়টা নিশ্চিত নই যে মাহাথির আসলেই কী করেছেন। আমরা আশা করতে চাই তিনি এ ধরনের কিছু করনেনি।
সাংবাদিকতায় ‘ইয়েলো জার্নালিজম’ বলে এক ধরনের সাংবাদিকতা আছে। এই সাংবাদিকতা হলো সত্য লেখা বা বলার চেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা, কোনো ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এক পক্ষে নিয়ে যাওয়া। হলুদ সাংবাদিকতায় সত্যতা কম থাকে, সূত্রের বরাত থাকে কম, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে রিপোর্টার। রিপোর্টে থাকে না কোনো ভারসাম্য। ন্যায্যতারও কোনো বালাই থাকে না।
কিন্তু একে কি বলা যাবে? কালো সাংবাদিকতা? বেশ ক’বছর আগে ফর্বস ম্যাগাজিনে একটা লেখা পড়েছিলাম যার শিরোনাম ছিলো ‘ডার্ক জার্নালিজম’। সাংবাদিকতায় সরকারের সেন্সরশিপই বড় সমস্যা নয়। এরচেয়ে বড় সমস্যা সাংবাদিকতার নামে এ ধরনের দুর্নীতি।
এই দুর্নীতি এমন যে অনেক সংবাদই আর আলোর মুখ দেখেনা। আবার এমন অনেক সংবাদই করা হয় কোনো না কোনো পক্ষের স্বার্থ হাসিলের জন্য। এ দুটো কাজই হয় অর্থের বিনিময়ে। এই অর্থ রিপোর্টার নিজে হজম করেন বা তার কর্তৃপক্ষের কেউ করে। আর আছে ব্ল্যাক মেইলিংয়ের সংস্কৃতি।
চিনে চেকবুক সাংবাদিকতা নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে ফর্বস ম্যাগাজিন এই ডার্ক জার্নালিজম’র কথা বলেছে। চেকবই কিংবা নগদ যেভাবেই হোক না কেন, আমাদের সাংবাদিকতায় এই সংস্কৃতি চলে আসছে এমনটা শুনা যায় সাংবাদিকদের আড্ডাতেই।
‘Journalists have many ways to drum up extra cash’ বলেছে ফর্বস ম্যাগাজিন। আমাদের এখানে কিছু কিছু সাংবাদিকের অবস্থা দেখলে এমনটা মনে হয়। এমন দু’একজনকে সবাই চেনেন। কি একটা সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক তথাকথিত অর্থ-বাণিজ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন চালান একজন। সেখানে যা লেখা থাকে তার বেশিরভাগেরই নেই কোনো মান। পত্রিকা জুড়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক আর বীমা কোম্পানির প্রেস রিলিজ। আর তার বিনিময়ে থাকে সেইসব ব্যাংক আর বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। সেই ব্যাক্তি এখন দেশের অন্যতম ধনী সাংবাদিক।
তার অনুসারী আছেন আরো বেশ ক’জন। এমনই একজনের কাজ হলো বছর বছর ব্যবসায়ীদের পদক দেয়া। তার বিনিময়ে অর্থ আয়। তিনি অনেক চেষ্টা করেও মূল ধারার সাংবাদিকতায় থাকতে পারেননি। কিন্তু এখানে তিনি সফল।
এমন অনেক উদাহরণ হয়তো দেয়া যাবে। সে তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমনটা হচ্ছে কেন? একটি কারণ হলো দায়বদ্ধতার অভাব। আরেকটি কারণ হলো যদি দেশে দুর্নীতির সংস্কৃতি থাকে, তবে গণমাধ্যমই বা তার থেকে দূরে থাকে কী করে?
সাংবাদিকতায় আছে একটি মুনাফাখোর গোষ্ঠী। এরা আসলে ভুয়া সাংবাদিক। কিন্তু সিস্টেমটাই এমন যে এদের অনেকেই আবার সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন আর সংস্থায়ও বেশ প্রভাবশালী।
ফর্বস ম্যাগাজিন চিনের কিছু কিছু এলাকায় সাংবাদিকতার এমন অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছে ‘People say that you can be a fruit stand owner one day and a journalist the next.’। বাংলাদেশেও কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন নয়?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: ishtiaquereza@gmail.com
No comments