‘পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে’ by আমীন আল রশীদ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে-এই সার্টিফিকেট দিতেই হবে। বুধবার দুপুরে তার এই উক্তির পরে এ নিয়ে ফেসবুকে নানাবিধ রসালো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েছে। একজন প্রস্তাব দিয়েছেন একটি বড় সাদা পেপার শহরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থানে টানিয়ে সেখানে ‘পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে’ বলে মন্তব্য লিখে গণস্বাক্ষরের ব্যবস্থা নেয়া হোক।
এই ঘটনার ঘণ্টা কয়েক পরে রাত সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের পুলিশের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গ তোলেন এবং সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকার সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে পুলিশকে লেলিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন। যদিও তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, তার মনে হয়েছে যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওই কথাটি রসিকতা করে বলেছেন। ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, ‘পত্র-পত্রিকা পড়ে মাননীয় স্পিকার আমরা যেটা বুঝতে পেরেছি তা হলো, মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউমারাসলি কথাটি বলেছেন। হি ডিডেন্ট মিন যে, পুলিশ অনেক খারাপ তাই সাংবাদিকরা তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবেন। এরকম হিউমারাসলি আমরা তো অনেক কিছুই বলি।’ এরকম একটা বিষয় উত্থাপন করে ফজলুল আজিম সংসদের সময় নষ্ট করছেন বলেও ফজলে রাব্বি মিয়া পাল্টা অভিযোগ করেন।
সংসদে এরকম অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হলো- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন এক সময় ‘পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে’ বলে যে দাবিটি করেছেন, যখন সারা দেশেই পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যখন প্রকাশ্যে পুলিশ প্রথম আলোর তিনজন ফটো সাংবাদিককে বলতে গেলে গণধোলাই দিয়েছে, যার একদিন পরেই খোদ আদালত চত্বরে পুলিশ একজন তরুণীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করেছে এবং তাতে বাধা দিতে গেলে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর চড়াও হয়েছে, যার কিছুদিন আগেই সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পুলিশ প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে, যার কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল কাদেরকে পুলিশ চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে, যার কিছুদিন আগে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে এবং তিনি দৌড়ে যখন তার ন্যাম ফ্ল্যাটের বাসভবনে যাচ্ছিলেন তখনও পেছন থেকে তাকে তাড়া করে মারা হয়েছে, যখন পুলিশ সাংবাদিকদের প্রকাশ্য দিবালোকে মারে এবং বলে যে, সাংবাদিক মারলে কিছুই হয় না, যার কিছুদিন আগেই দেশ টেলিভিশনের সাংবাদিক গিয়াস আহমেদকে তার পরিচয় পাবার পরেও পুলিশ মারধর করেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে! অথচ তার সহকর্মী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার আগের দিন সাংবাদিকদের বললেন পুলিশ থেকে দূরে থাকুন। প্রশ্ন হলো পুলিশ যদি আগের চেয়ে ভালোই হবে তাহলে তার থেকে দূরে থাকতে হবে কেন? মন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রীর কথার মধ্যে তো অনেক ফারাক।
এই দুজনের বক্তব্যকে আমরা এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
১. স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি রসিকতা করেও ওই কথা বলে থাকেন তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি পুলিশ হচ্ছে একটা হিংস্র জন্তু, যে কারণে তিনি এর থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। যেমন বড়লোকের বাড়ির সামনে লেখা থাকে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। আমার মনে হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই কথা রসিকতা করে নয়, বরং পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন। যেহেতু পুলিশকে ‘মানুষ’ বানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন দূরে থাকতে।
২. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন যে, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এর ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন হয়েছে। অর্থাৎ তারা এখন একইসঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করছে। যেমন বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে তারা মাঠে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালন করছে। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সরকার ও সরকারি দলের অনুগত বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাই নয় বরং সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নেও পুলিশ দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। সেদিক বিবেচনা করেই হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
তবে আমার মনে হয় পুলিশের ভালো হওয়া খুবই কঠিন। আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি পুলিশ হচ্ছে জনগণের বন্ধু। প্রশ্ন হলো, পুলিশ যদি জনগণের বন্ধুই হবে তাহলে পুলিশের আয়-রোজগার হবে কোত্থেকে? তারা যা বেতন পায় তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। সুতরাং জনগণকে বেকায়দায় ফেলে যদি তারা বাড়তি পয়সা উপার্জন করতেই না পারে তাহলে তার চলবে কী করে? পুলিশ সব সময়ই চায় জনগণ তার কাছে যাবে এবং জনগণের বিপদের সুযোগ নিয়ে সে পয়সা কামাবে।
দ্বিতীয়ত জনগণের করের পয়সায় বেতন হলেও পুলিশের পদায়ন, বদলি সবই হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিশেষ কোনো জেলার লোক হলে সে অন্যায় করে সহজেই পার পেয়ে যাবে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে যে, সে যা কিছুই করুক না কেন তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় আছে, তাকে কোথাও জবাবদিহিতা করতে হবে না, তখন সে সাংবাদিক তো মারবেই। কেননা সাংবাদিক ও পুলিশ- কাগজ কলমে উভয়ই জনগণের সেবক হলেও বাস্তবে এ দুই শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। পুলিশের অন্যায় ও দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিক সহজেই সংবাদ করতে পারে, যা সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের মানুষ শোনে, দেখে এবং পড়ে। কিন্তু সাংবাদিকের কোনো দোষত্রুটি পুলিশ ধরিয়ে দিতে পারলেও সে বিষয়ে জনমত তৈরি করতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সাংবাদিকের উপর পুলিশ চড়াও হয় এবং সেই আক্রোষ মেটায়।
আমীন আল রশীদ: সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি রেডিও
aminalrasheed@gmail.com
সংসদে এরকম অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হলো- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন এক সময় ‘পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে’ বলে যে দাবিটি করেছেন, যখন সারা দেশেই পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যখন প্রকাশ্যে পুলিশ প্রথম আলোর তিনজন ফটো সাংবাদিককে বলতে গেলে গণধোলাই দিয়েছে, যার একদিন পরেই খোদ আদালত চত্বরে পুলিশ একজন তরুণীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করেছে এবং তাতে বাধা দিতে গেলে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর চড়াও হয়েছে, যার কিছুদিন আগেই সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পুলিশ প্রত্যক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে, যার কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল কাদেরকে পুলিশ চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে, যার কিছুদিন আগে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে মারতে মারতে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে এবং তিনি দৌড়ে যখন তার ন্যাম ফ্ল্যাটের বাসভবনে যাচ্ছিলেন তখনও পেছন থেকে তাকে তাড়া করে মারা হয়েছে, যখন পুলিশ সাংবাদিকদের প্রকাশ্য দিবালোকে মারে এবং বলে যে, সাংবাদিক মারলে কিছুই হয় না, যার কিছুদিন আগেই দেশ টেলিভিশনের সাংবাদিক গিয়াস আহমেদকে তার পরিচয় পাবার পরেও পুলিশ মারধর করেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে! অথচ তার সহকর্মী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার আগের দিন সাংবাদিকদের বললেন পুলিশ থেকে দূরে থাকুন। প্রশ্ন হলো পুলিশ যদি আগের চেয়ে ভালোই হবে তাহলে তার থেকে দূরে থাকতে হবে কেন? মন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রীর কথার মধ্যে তো অনেক ফারাক।
এই দুজনের বক্তব্যকে আমরা এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
১. স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি রসিকতা করেও ওই কথা বলে থাকেন তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি পুলিশ হচ্ছে একটা হিংস্র জন্তু, যে কারণে তিনি এর থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। যেমন বড়লোকের বাড়ির সামনে লেখা থাকে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। আমার মনে হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই কথা রসিকতা করে নয়, বরং পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন। যেহেতু পুলিশকে ‘মানুষ’ বানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন দূরে থাকতে।
২. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন যে, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এর ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন হয়েছে। অর্থাৎ তারা এখন একইসঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করছে। যেমন বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে তারা মাঠে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালন করছে। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সরকার ও সরকারি দলের অনুগত বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। শুধু আইন শৃঙ্খলা রক্ষাই নয় বরং সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নেও পুলিশ দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। সেদিক বিবেচনা করেই হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
তবে আমার মনে হয় পুলিশের ভালো হওয়া খুবই কঠিন। আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি পুলিশ হচ্ছে জনগণের বন্ধু। প্রশ্ন হলো, পুলিশ যদি জনগণের বন্ধুই হবে তাহলে পুলিশের আয়-রোজগার হবে কোত্থেকে? তারা যা বেতন পায় তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। সুতরাং জনগণকে বেকায়দায় ফেলে যদি তারা বাড়তি পয়সা উপার্জন করতেই না পারে তাহলে তার চলবে কী করে? পুলিশ সব সময়ই চায় জনগণ তার কাছে যাবে এবং জনগণের বিপদের সুযোগ নিয়ে সে পয়সা কামাবে।
দ্বিতীয়ত জনগণের করের পয়সায় বেতন হলেও পুলিশের পদায়ন, বদলি সবই হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিশেষ কোনো জেলার লোক হলে সে অন্যায় করে সহজেই পার পেয়ে যাবে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে যে, সে যা কিছুই করুক না কেন তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় আছে, তাকে কোথাও জবাবদিহিতা করতে হবে না, তখন সে সাংবাদিক তো মারবেই। কেননা সাংবাদিক ও পুলিশ- কাগজ কলমে উভয়ই জনগণের সেবক হলেও বাস্তবে এ দুই শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। পুলিশের অন্যায় ও দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিক সহজেই সংবাদ করতে পারে, যা সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের মানুষ শোনে, দেখে এবং পড়ে। কিন্তু সাংবাদিকের কোনো দোষত্রুটি পুলিশ ধরিয়ে দিতে পারলেও সে বিষয়ে জনমত তৈরি করতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সাংবাদিকের উপর পুলিশ চড়াও হয় এবং সেই আক্রোষ মেটায়।
আমীন আল রশীদ: সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি রেডিও
aminalrasheed@gmail.com
No comments