রঙ্গব্যঙ্গ-অরাজনৈতিক জুজুর ভয়! by মোস্তফা কামাল
এ দেশে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না এমন কোনো মানুষ বোধ হয় পাওয়া যাবে না। রিকশাওয়ালা-ঠেলাগাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে সমাজের ওপরতলার মানুষ; সবাই-ই দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পেটে ভাত নেই, হাঁড়িতে চাল নেই; তাতে কী! রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় শরিক হওয়া চাই।
রিকশাওয়ালা রিকশার পেডেলে চাপ দিয়েই শুরু করে, 'কন তো স্যার! কাজটা কি ঠিক হইল? এই যে এতগুলা লোককে জেলে ঢুকাইল! এরা কি নিজেরা গাড়ি পোড়াইছে? নাকি কাউকে হুকুম দিছে, এই! গাড়িডা পোড়া! গাড়ি পোড়াইলেই আমাগো ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হইব!'
আরেকজন রিকশাওয়ালা চোখ রাঙিয়ে বলল, 'এই! এত বক বক করিস কেন? কী হয়েছে? বুঝছি, তুই বিএনপি করিস। নাকি জামায়াত করিস? তোরা দেশের শত্রু। উল্টাপাল্টা কথা বলবি, একেবারে টুঁটি চিপে ধরব, বুঝলি?'
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানেও রাজনীতির এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঝড় ওঠে। রাজনীতির ধূলিঝড় প্রায়ই যেন কালবৈশাখীতে রূপ নেয়। সেই ঝড় একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশটাকে।
এ অবস্থা তো আর নতুন কিছু নয়! তাই সবার মনে শঙ্কা, কোথায় চলেছে এই দেশ! কী হবে এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি? পান থেকে চুন খসলেই মানুষের শঙ্কার পারদটা যেন শীর্ষবিন্দুতে গিয়ে ঠেকে। কথায় বলে না, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমাদের দেশের মানুষের হয়েছে সেই অবস্থা। রাজনীতিতে কালো মেঘ জমার আগেই মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এই বুঝি অরাজনৈতিক অপশক্তি গ্রাস করল দেশটাকে! আবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল দেশকে!
আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা বুঝতে চান না। তাঁরা অবশ্য সাধারণ মানুষের কথা ভাবেনও না। ক্ষমতায় কিভাবে যাওয়া যায় এবং কিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় তাঁরা লিপ্ত রয়েছেন। আর এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তাঁরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এর ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সংঘাত, মারামারি, কাটাকাটি।
হানাহানির রাজনীতির প্রসঙ্গে আমাদের রাজনীতিকরা অবশ্য ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁরা বলেন, আমরা রাজনীতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাই না। আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকে কিছু অশুভ শক্তি। তারাই আমাদের উস্কে দেয়। সেই উস্কানিতে আমরাও ডুগডুগি বাজিয়ে মাঠে নেমে পড়ি! একবারও আমরা ভাবি না, আমরা এসব করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি।
প্রসঙ্গক্রমে এক প্রবীণ রাজনীতিক হারিছ উদ্দিন একটা গল্প বললেন। গল্পটা এ রকম, 'একবার এক লোক গাছের ডালে বসে সেই ডালটি-ই কুড়াল দিয়ে কাটছিল। তো, সেখান দিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। তিনি লোকটির গাছ কাটা দেখে বুঝতে পারলেন, লোকটা নিশ্চয়ই পাগল। তা না হলে কি আর গাছের ডালে বসে সেই ডাল কাটে! ভদ্রলোক পাগলটাকে থামিয়ে বললেন, এই পাগলা, এভাবে ডাল কাটলে তো তুমি নিজেই পড়ে মরবে! তুমি আরেকটা ডালে বসো, তারপর ওই ডালটা কাটো।
পাগল লোকটা দাঁত খিটমিট করে বলল, 'আমার গাছ আমি কিভাবে কাটব সেটা কি আপনার বলে দিতে হবে? যান যান! অত বেশি ওস্তাদি করতে হবে না!'
তারপর যা ঘটার তা-ই ঘটল। পাগল লোকটা ডালের নিচে চাপা পড়ে মারা গেল। আমাদের রাজনীতিকে এই গল্পের সঙ্গেই তুলনা করলেন হারিছ উদ্দিন। তাঁর গল্প শুনে পান দোকানদার মোখলেস হো হো করে হেসে বলল, 'আপনার গল্পটা তো বেশ চমৎকার! আপনার এই গল্পটা যদি বড় বড় নেতাকে শোনানো যেত!'
জবাবে হারিছ উদ্দিন বললেন, 'লাভ নেই, কোনো লাভ নেই। তাঁরা এসব গল্প শুনবেন না। অবশ্য শোনার সময়ও তাঁদের নেই। তাঁরা সবাই যাঁর যাঁর ধান্দা করছেন, বুঝলে! কেউ টাকা বানানোর ধান্দা, কেউ জমি, বাড়ি দখলের ধান্দা আবার কেউ প্রজেক্ট ভাগানোর ধান্দা!'
'তাইলে তো আর কোনো আশা-ভরসা নাই!' পান দোকানদার মোখলেস বলল।
হারিছ উদ্দিন বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'আশা-ভরসা! কিসের আশা-ভরসা?'
মোখলেস উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, 'দেশ কি তাইলে এইভাবেই চলব?'
হারিছ উদ্দিন ধমকের সুরে বললেন, 'এই মিয়া! তোমারে এসব নিয়া কে ভাবতে বলল? তুমি ছাপোষা পান দোকানদার! তোমার কাজ পান বেচা, তুমি পান বেচো! তুমি দেশ নিয়া ভাবলে কিছু হবে? যাদের ভাবার তারা যদি না ভাবে তাহলে তোমার-আমার ভেবে কোনো লাভ আছে? নেই।'
মোখলেস গম্ভীর মুখে বলল, 'হ বুঝছি! এখন থেকে আমাদেরই ভাবতে হইব! আপনাদের দেশ নিয়ে ভাবার কথা। আপনারা কি ভাবেন? ভাবেন না।'
হারিছ উদ্দিন কোনো কথা বললেন না। তাঁর মনটা বেশ খারাপ হয়েছে। তিনি অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ মির্জা ফখরুলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তাকিয়ে দেখেন, টিভিতে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য প্রচার করছে। তিনি বলছেন, 'চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে তাহলে স্বাগত জানাব। আর অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটলে প্রতিরোধ করব।'
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য শোনার পর হারিছ উদ্দিন শ্লেষের সঙ্গে বললেন, 'এহ! প্রতিরোধ করবে! এসব বক্তব্য শুনলে স্রেফ গা জ্বলে। এদের প্রতিরোধের ধরন আমরা দেখছি না! গর্তে লুকিয়ে কূল পায় না! প্রতিরোধ করবে! ইস! আমি যদি একবার নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! তাহলে তাঁকে শেষবারের জন্য অনুরোধ করে বলতাম, নেত্রী, আপনি দেশের অভিভাবক। আপনি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে অন্তত একবার বৈঠকে বসেন। আলোচনা করেন। এখন দেশের যে অবস্থা, তাতে আপনাদের দুজনের মধ্যে সমঝোতা খুবই দরকার। আপনাদের দুজনের একগুঁয়েমির কারণে যেন দেশে আবার কোনো অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে। আমাদের বারবার অরাজনৈতিক শক্তির জুজুর ভয় দেখানো হয়। আমরা সেই ভয়ে আর ভীত হতে চাই না। আমাদের মনের সেই ভয় তাড়ানোর ব্যবস্থা করুন। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে বলি, দুনেত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হোক; জুজুর ভয় দূর হোক!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
আরেকজন রিকশাওয়ালা চোখ রাঙিয়ে বলল, 'এই! এত বক বক করিস কেন? কী হয়েছে? বুঝছি, তুই বিএনপি করিস। নাকি জামায়াত করিস? তোরা দেশের শত্রু। উল্টাপাল্টা কথা বলবি, একেবারে টুঁটি চিপে ধরব, বুঝলি?'
রাস্তার পাশে চায়ের দোকানেও রাজনীতির এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঝড় ওঠে। রাজনীতির ধূলিঝড় প্রায়ই যেন কালবৈশাখীতে রূপ নেয়। সেই ঝড় একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশটাকে।
এ অবস্থা তো আর নতুন কিছু নয়! তাই সবার মনে শঙ্কা, কোথায় চলেছে এই দেশ! কী হবে এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি? পান থেকে চুন খসলেই মানুষের শঙ্কার পারদটা যেন শীর্ষবিন্দুতে গিয়ে ঠেকে। কথায় বলে না, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমাদের দেশের মানুষের হয়েছে সেই অবস্থা। রাজনীতিতে কালো মেঘ জমার আগেই মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এই বুঝি অরাজনৈতিক অপশক্তি গ্রাস করল দেশটাকে! আবার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল দেশকে!
আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা বুঝতে চান না। তাঁরা অবশ্য সাধারণ মানুষের কথা ভাবেনও না। ক্ষমতায় কিভাবে যাওয়া যায় এবং কিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় তাঁরা লিপ্ত রয়েছেন। আর এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে তাঁরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এর ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সংঘাত, মারামারি, কাটাকাটি।
হানাহানির রাজনীতির প্রসঙ্গে আমাদের রাজনীতিকরা অবশ্য ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁরা বলেন, আমরা রাজনীতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাই না। আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকে কিছু অশুভ শক্তি। তারাই আমাদের উস্কে দেয়। সেই উস্কানিতে আমরাও ডুগডুগি বাজিয়ে মাঠে নেমে পড়ি! একবারও আমরা ভাবি না, আমরা এসব করে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি।
প্রসঙ্গক্রমে এক প্রবীণ রাজনীতিক হারিছ উদ্দিন একটা গল্প বললেন। গল্পটা এ রকম, 'একবার এক লোক গাছের ডালে বসে সেই ডালটি-ই কুড়াল দিয়ে কাটছিল। তো, সেখান দিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। তিনি লোকটির গাছ কাটা দেখে বুঝতে পারলেন, লোকটা নিশ্চয়ই পাগল। তা না হলে কি আর গাছের ডালে বসে সেই ডাল কাটে! ভদ্রলোক পাগলটাকে থামিয়ে বললেন, এই পাগলা, এভাবে ডাল কাটলে তো তুমি নিজেই পড়ে মরবে! তুমি আরেকটা ডালে বসো, তারপর ওই ডালটা কাটো।
পাগল লোকটা দাঁত খিটমিট করে বলল, 'আমার গাছ আমি কিভাবে কাটব সেটা কি আপনার বলে দিতে হবে? যান যান! অত বেশি ওস্তাদি করতে হবে না!'
তারপর যা ঘটার তা-ই ঘটল। পাগল লোকটা ডালের নিচে চাপা পড়ে মারা গেল। আমাদের রাজনীতিকে এই গল্পের সঙ্গেই তুলনা করলেন হারিছ উদ্দিন। তাঁর গল্প শুনে পান দোকানদার মোখলেস হো হো করে হেসে বলল, 'আপনার গল্পটা তো বেশ চমৎকার! আপনার এই গল্পটা যদি বড় বড় নেতাকে শোনানো যেত!'
জবাবে হারিছ উদ্দিন বললেন, 'লাভ নেই, কোনো লাভ নেই। তাঁরা এসব গল্প শুনবেন না। অবশ্য শোনার সময়ও তাঁদের নেই। তাঁরা সবাই যাঁর যাঁর ধান্দা করছেন, বুঝলে! কেউ টাকা বানানোর ধান্দা, কেউ জমি, বাড়ি দখলের ধান্দা আবার কেউ প্রজেক্ট ভাগানোর ধান্দা!'
'তাইলে তো আর কোনো আশা-ভরসা নাই!' পান দোকানদার মোখলেস বলল।
হারিছ উদ্দিন বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, 'আশা-ভরসা! কিসের আশা-ভরসা?'
মোখলেস উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, 'দেশ কি তাইলে এইভাবেই চলব?'
হারিছ উদ্দিন ধমকের সুরে বললেন, 'এই মিয়া! তোমারে এসব নিয়া কে ভাবতে বলল? তুমি ছাপোষা পান দোকানদার! তোমার কাজ পান বেচা, তুমি পান বেচো! তুমি দেশ নিয়া ভাবলে কিছু হবে? যাদের ভাবার তারা যদি না ভাবে তাহলে তোমার-আমার ভেবে কোনো লাভ আছে? নেই।'
মোখলেস গম্ভীর মুখে বলল, 'হ বুঝছি! এখন থেকে আমাদেরই ভাবতে হইব! আপনাদের দেশ নিয়ে ভাবার কথা। আপনারা কি ভাবেন? ভাবেন না।'
হারিছ উদ্দিন কোনো কথা বললেন না। তাঁর মনটা বেশ খারাপ হয়েছে। তিনি অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ মির্জা ফখরুলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। তাকিয়ে দেখেন, টিভিতে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য প্রচার করছে। তিনি বলছেন, 'চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যদি তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে তাহলে স্বাগত জানাব। আর অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটলে প্রতিরোধ করব।'
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য শোনার পর হারিছ উদ্দিন শ্লেষের সঙ্গে বললেন, 'এহ! প্রতিরোধ করবে! এসব বক্তব্য শুনলে স্রেফ গা জ্বলে। এদের প্রতিরোধের ধরন আমরা দেখছি না! গর্তে লুকিয়ে কূল পায় না! প্রতিরোধ করবে! ইস! আমি যদি একবার নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! তাহলে তাঁকে শেষবারের জন্য অনুরোধ করে বলতাম, নেত্রী, আপনি দেশের অভিভাবক। আপনি বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে অন্তত একবার বৈঠকে বসেন। আলোচনা করেন। এখন দেশের যে অবস্থা, তাতে আপনাদের দুজনের মধ্যে সমঝোতা খুবই দরকার। আপনাদের দুজনের একগুঁয়েমির কারণে যেন দেশে আবার কোনো অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে। আমাদের বারবার অরাজনৈতিক শক্তির জুজুর ভয় দেখানো হয়। আমরা সেই ভয়ে আর ভীত হতে চাই না। আমাদের মনের সেই ভয় তাড়ানোর ব্যবস্থা করুন। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে বলি, দুনেত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হোক; জুজুর ভয় দূর হোক!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments