সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব গভীর শাসন সঙ্কটের প্রতিফলন by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে এখন সমস্ত শাসন ব্যবস্থারই বেহাল অবস্থা। প্রথমত, এখানে মন্ত্রিসভা বলতে কার্যত যা বোঝায় তা নেই। মাঝে মাঝে এর বৈঠক হয় এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী তার ‘জ্ঞানগর্ভ’ ও ‘দেশপ্রেমমূলক’ নানা বক্তব্য প্রদান করে ভাষণ দেন। এটা-ওটা নির্দেশও তিনি তার পারিষদতুল্য মন্ত্রীদের দিয়ে থাকেন।
কখনও সখনও তিনি তাদের কাউকে কাউকে ধমক-ধামক এবং হুমকিও দেন। এসবই হলো মন্ত্রিসভার রুটিন ব্যাপার। এসব থেকে বোঝা যায়, এই মন্ত্রিসভাটি মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের দ্বারা গঠিত কোনো প্রকৃত মন্ত্রিসভা নয়। এই মন্ত্রিসভা হলো শেখ এবং হাসিনার মন্ত্রিসভা! মন্ত্রিসভার জন্য একাধিক মন্ত্রীর প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু সেরকম কোনো মন্ত্রী নেই, এ কারণে মন্ত্রিসভাকে এভাবেই আখ্যায়িত করা ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?
মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর একক ভূমিকা থাকার জন্য মন্ত্রীদের মধ্যে চিন্তার যে ঐক্য বিভিন্ন নীতি-বিষয়ে থাকা দরকার সেটা নেই। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, সেটাই নীতি। আবার তিনি যে সব সময় একইভাবে কথা বলেন তা নয়। একই বিষয়ে তিনি সুযোগ বুঝে নানা রকম পরস্পরবিরোধী কথাও বলে থাকেন। তার এই ধরনের স্ববিরোধিতা এবং অসংলগ্ন কথাবার্তায় মন্ত্রিসভার কোনো অসুবিধা হয় না। উপরন্তু তারা এসবের ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত থাকেন! দেশে-বিদেশে অবস্থিত আওয়ামী লীগের চামচা বুদ্ধিজীবীরাও গায়ে পড়ে একই কাজ করেন। এর পরিণামে দেখা যায়, মন্ত্রীরা নিজেরাও বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরের বিপরীত মতামত সংবাদ মাধ্যমে দিতে অসুবিধা বোধ করেন না। মনে হয়, মন্ত্রিপরিষদে তাদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় না। হলেও তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
মন্ত্রিসভার মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন যারা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ও সভা-সমিতিতে প্রায়ই নানা বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী একজন। কোনো অর্থমন্ত্রী যে এত অর্থহীন কথা মুখ থেকে নিয়মিত উদগিরণ করতে পারেন এটা সংবাদপত্রে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে বিশ্বাস করা কঠিন। শেয়ারবাজার, বিভিন্ন প্রকল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে তার আবোল-তাবোল কথাবার্তায় হদিস পাওয়া মুশকিল। তবে এই আবোল-তাবোল বকার সময় তিনি আবার মুখ ফসকে অনেক সময় এমন কথাও বলে থাকেন, যা সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ কয়েকদিন আগে তিনি বললেন, পুলিশই হচ্ছে দেশের সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা এবং তাদের জন্যই উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ সব সময়ই সরকারের পেয়ারের সংস্থা। কারণ পুলিশ দিয়েই তারা নিজেদের দুর্নীতি এবং অকর্মণ্যতার মোকাবিলা করে থাকেন। কাজেই অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, পুলিশের কার্যকলাপ এবং অবস্থা এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকেই ভালো! দেশে যখন পুলিশের হাজার রকম দুর্নীতি, অপহরণ, গুম-খুন, নির্যাতন নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য শুধু যে অসত্য তাই নয়, হাস্যকরও বটে। তিনি অবশ্য এরই মধ্যে অনেক লোক হাসানো বক্তব্য দিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এলজিআরডি মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য মন্ত্রীদের এই ধরনের বাগাড়ম্বরের বর্ণনা দেয়ার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও দলনেতাদের ক্ষমতামদমত্ত কথাবার্তার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত। এসব দেখে মনে হয় না যে, বাংলাদেশে কোনো সুস্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মকানুনের শাসন আছে।
এ তো গেল সরকার ও সরকারি প্রশাসনের কথা। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার খবর কী? সেখানে সংকট কতখানি ঘনীভূত হয়েছে এটা এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালত ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার দিকে তাকালে বোঝা যাবে। একে বিতর্ক না বলে প্রকৃতপক্ষে গালাগালি বলাই সঙ্গত। সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদ উভয়েই দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক সংস্থা। কাজেই এ দুইয়ের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত কোনো শাসনব্যবস্থার লক্ষণ নয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার, এই দ্বন্দ্ব এমন কোনো নীতিগত দ্বন্দ্ব নয়, যা সম্মানজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় মার্কিন কংগ্রেস ইস্পাত শিল্প জাতীয়করণ করেছিল। সেখানকার সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেসের সেই সিদ্ধান্ত নাকচ করেছিল, সেটা সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিষয়ক অধিকার লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে। কিন্তু এ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও গালাগালির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের সংবিধানসম্মত রায় মার্কিন কংগ্রেস স্বীকার করে নিয়েছিল। সুষ্ঠু বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় এটাই হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা একটা জমিকে কেন্দ্র করে। সুপ্রিমকোর্ট সংলগ্ন একটি জায়গায় সরকারের রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্ট নিজেদের হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং তৈরি করেছিল। এটা প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। তার আগে ওই জায়গাটিতে ছিল একটি বড় সরকারি নার্সারি। নার্সারিটিকে উচ্ছেদ করে সেখানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ তাদের বিল্ডিং তৈরি করেছিল। যখন তারা এ কাজ করে তখন সুপ্রিমকোর্ট থেকে সেটা বন্ধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন কোর্ট থেকে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের কাজের পরিধি বেড়েছে সে কারণে বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট বিল্ডিংয়ে তাদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। কাজেই ওই জায়গা এখন তাদের দরকার হয়েছে।
এটা হতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হতে পারে না। এর মীমাংসা সুপ্রিমকোর্ট এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই হতে পারত। কিন্তু তার পরিবর্তে এখন দেখা যাচ্ছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ নয়, জাতীয় সংসদ এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে এক কুৎসিত বিবাদ ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের জানা নেই যে, বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি-না এবং সে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কি-না। তবে এ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমে যা জানা গেছে, তাতে মনে হয় না এ ধরনের কোনো আলোচনা ও মীমাংসার চেষ্টা এর আগে হয়েছে। সঙ্কট এখানেই। অন্যভাবে বলা চলে, দেশব্যাপী যে সাধারণ সঙ্কট দেখা যাচ্ছে তার প্রতিফলনই এর মধ্যে ঘটছে। সেটা না হলে, আগেই যা বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্ট সড়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে একটা মীমাংসা করতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ২৯ মে জাতীয় সংসদে বিতর্কের সময় বলেন, ‘আদালত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। উচ্চ আদালতের প্রতি ইঙ্গিত করে স্পিকার বলেন, কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে আলোচনার পরামর্শ দেন তিনি। (সমকাল ৬.৬.১২)। সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বলেন, স্পিকার তাদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা নিজেদের মনে করেন ‘আমরা কি হনু রে!’ (Daily Star 6.6.12)।
এই ভাষা সম্পূর্ণ অসংসদীয় বা আন-পার্লামেন্টারি। তিনি বলেন, সংসদের কোনো সদস্য কোনো বিষয় আলোচনার জন্য উপস্থাপন করলে স্পিকারের দায়িত্ব হচ্ছে তা বিধিমোতাবেক পরিচালনা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্পিকার নিজেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে নিজের পদমর্যাদার অবমাননা করে প্রচলিত সাংবিধানিক রীতিনীতির বিরোধী কাজ করেছেন।
গত মঙ্গলবার ৫.৬.২০১২ তারিখে জাতীয় সংসদের এই বিতর্কে শুধু আওয়ামী লীগ সদস্যরাই নন, তাদের জোট সরকারের অন্য শরিকরাও অংশগ্রহণ করে স্পিকারকে সমর্থন করে সুপ্রিমকোর্টের সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা কোন পর্যায়ে পৌঁছায় এটা বোঝা যাবে যখন আমরা লক্ষ্য করব একজন আওয়ামী লীগ এবং একজন জাতীয় পার্টির সদস্যের বক্তব্য। তারা দু’জনই বলেন, ‘বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক খুব ভাগ্যবান ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তাকে কোনো মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই হাইকোর্টের একজন অতিরিক্ত জজ করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকার তার এই নিয়োগ অনুমোদন না করলেও বর্তমান সরকার তা করেছে।’ বলাই বাহুল্য, এ কাজ আওয়ামী লীগ সরকারের বাহাদুরি হিসেবে তারা দেখাতে চাইলেও এটাকে একটা দুর্নীতি হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। থাক সে কথা। বিচারপতি মানিককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সদস্য বলেন যে, তিনি রাস্তায় যাওয়ার সময় একবার এক ট্রাফিক পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট না করায় তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন! তিনি অন্যের ওপর জুলুম করে মজা পান!! জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বলেন, একবার বিমানের যাত্রী হিসেবে সাধারণ টিকিট কিনে বিজনেস ক্লাসে তাকে আসন করে দিতে বিমান কর্তৃপক্ষকে তিনি বাধ্য করেন!!! তিনি আসলে একজন উন্মাদ!!!! (Daily Star 6.6.2012).
যাই হোক, এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, আদালত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে একটা মীমাংসায় অনায়াসেই আসতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে যেভাবে সুপ্রিমকোর্ট এবং জাতীয় সংসদ পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসিসতভাবে বিতর্ক ও গালাগালিতে নিযুক্ত হয়েছেন—এটা লঘুভাবে নেয়ার কোনো ব্যাপার নয়। এটা শুধু একজন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সদস্যদের বাকবিতণ্ডা নয়। বর্তমান রাষ্ট্রের গভীর দেশে যে দ্বন্দ্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার প্রতিফলনই এসবের মাধ্যমে ঘটছে। দুই পক্ষই যেভাবে নিজেদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত করার জন্য সংবিধানের আশ্রয় গ্রহণ করে বিতর্ক করেছে তার থেকে এটা বোঝারও অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের সংবিধানও এখন বাস্তবতার কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। আদালত ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক সম্পর্ক অবসানের ক্ষেত্রে সংবিধান শেষ পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহৃত হয় সেটাও দেখার বিষয়। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও শাসন ব্যবস্থা যে এক সমাধান অযোগ্য সঙ্কটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অনৈক্য এবং দ্বন্দ্বের মধ্যেই এর পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে।
বদরুদ্দীন উমর: বাম রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত লেখক ও কলামিস্ট
মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর একক ভূমিকা থাকার জন্য মন্ত্রীদের মধ্যে চিন্তার যে ঐক্য বিভিন্ন নীতি-বিষয়ে থাকা দরকার সেটা নেই। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, সেটাই নীতি। আবার তিনি যে সব সময় একইভাবে কথা বলেন তা নয়। একই বিষয়ে তিনি সুযোগ বুঝে নানা রকম পরস্পরবিরোধী কথাও বলে থাকেন। তার এই ধরনের স্ববিরোধিতা এবং অসংলগ্ন কথাবার্তায় মন্ত্রিসভার কোনো অসুবিধা হয় না। উপরন্তু তারা এসবের ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত থাকেন! দেশে-বিদেশে অবস্থিত আওয়ামী লীগের চামচা বুদ্ধিজীবীরাও গায়ে পড়ে একই কাজ করেন। এর পরিণামে দেখা যায়, মন্ত্রীরা নিজেরাও বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরের বিপরীত মতামত সংবাদ মাধ্যমে দিতে অসুবিধা বোধ করেন না। মনে হয়, মন্ত্রিপরিষদে তাদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় না। হলেও তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
মন্ত্রিসভার মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন যারা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ও সভা-সমিতিতে প্রায়ই নানা বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী একজন। কোনো অর্থমন্ত্রী যে এত অর্থহীন কথা মুখ থেকে নিয়মিত উদগিরণ করতে পারেন এটা সংবাদপত্রে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে বিশ্বাস করা কঠিন। শেয়ারবাজার, বিভিন্ন প্রকল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে তার আবোল-তাবোল কথাবার্তায় হদিস পাওয়া মুশকিল। তবে এই আবোল-তাবোল বকার সময় তিনি আবার মুখ ফসকে অনেক সময় এমন কথাও বলে থাকেন, যা সরকারের পক্ষে ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ কয়েকদিন আগে তিনি বললেন, পুলিশই হচ্ছে দেশের সব থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা এবং তাদের জন্যই উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ সব সময়ই সরকারের পেয়ারের সংস্থা। কারণ পুলিশ দিয়েই তারা নিজেদের দুর্নীতি এবং অকর্মণ্যতার মোকাবিলা করে থাকেন। কাজেই অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, পুলিশের কার্যকলাপ এবং অবস্থা এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকেই ভালো! দেশে যখন পুলিশের হাজার রকম দুর্নীতি, অপহরণ, গুম-খুন, নির্যাতন নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য শুধু যে অসত্য তাই নয়, হাস্যকরও বটে। তিনি অবশ্য এরই মধ্যে অনেক লোক হাসানো বক্তব্য দিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এলজিআরডি মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য মন্ত্রীদের এই ধরনের বাগাড়ম্বরের বর্ণনা দেয়ার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও দলনেতাদের ক্ষমতামদমত্ত কথাবার্তার সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত। এসব দেখে মনে হয় না যে, বাংলাদেশে কোনো সুস্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মকানুনের শাসন আছে।
এ তো গেল সরকার ও সরকারি প্রশাসনের কথা। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার খবর কী? সেখানে সংকট কতখানি ঘনীভূত হয়েছে এটা এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালত ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার দিকে তাকালে বোঝা যাবে। একে বিতর্ক না বলে প্রকৃতপক্ষে গালাগালি বলাই সঙ্গত। সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদ উভয়েই দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক সংস্থা। কাজেই এ দুইয়ের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত কোনো শাসনব্যবস্থার লক্ষণ নয়।
লক্ষণীয় ব্যাপার, এই দ্বন্দ্ব এমন কোনো নীতিগত দ্বন্দ্ব নয়, যা সম্মানজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সময় মার্কিন কংগ্রেস ইস্পাত শিল্প জাতীয়করণ করেছিল। সেখানকার সুপ্রিমকোর্ট কংগ্রেসের সেই সিদ্ধান্ত নাকচ করেছিল, সেটা সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিষয়ক অধিকার লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে। কিন্তু এ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ও গালাগালির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের সংবিধানসম্মত রায় মার্কিন কংগ্রেস স্বীকার করে নিয়েছিল। সুষ্ঠু বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় এটাই হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন সুপ্রিমকোর্ট ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা একটা জমিকে কেন্দ্র করে। সুপ্রিমকোর্ট সংলগ্ন একটি জায়গায় সরকারের রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্ট নিজেদের হেড কোয়ার্টার বিল্ডিং তৈরি করেছিল। এটা প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। তার আগে ওই জায়গাটিতে ছিল একটি বড় সরকারি নার্সারি। নার্সারিটিকে উচ্ছেদ করে সেখানে সড়ক ও জনপথ বিভাগ তাদের বিল্ডিং তৈরি করেছিল। যখন তারা এ কাজ করে তখন সুপ্রিমকোর্ট থেকে সেটা বন্ধের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন কোর্ট থেকে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের কাজের পরিধি বেড়েছে সে কারণে বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট বিল্ডিংয়ে তাদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। কাজেই ওই জায়গা এখন তাদের দরকার হয়েছে।
এটা হতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হতে পারে না। এর মীমাংসা সুপ্রিমকোর্ট এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই হতে পারত। কিন্তু তার পরিবর্তে এখন দেখা যাচ্ছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ নয়, জাতীয় সংসদ এ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে এক কুৎসিত বিবাদ ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের জানা নেই যে, বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি-না এবং সে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কি-না। তবে এ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমে যা জানা গেছে, তাতে মনে হয় না এ ধরনের কোনো আলোচনা ও মীমাংসার চেষ্টা এর আগে হয়েছে। সঙ্কট এখানেই। অন্যভাবে বলা চলে, দেশব্যাপী যে সাধারণ সঙ্কট দেখা যাচ্ছে তার প্রতিফলনই এর মধ্যে ঘটছে। সেটা না হলে, আগেই যা বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্ট সড়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই এ ব্যাপারে একটা মীমাংসা করতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের স্পিকার ২৯ মে জাতীয় সংসদে বিতর্কের সময় বলেন, ‘আদালত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। কিন্তু দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। উচ্চ আদালতের প্রতি ইঙ্গিত করে স্পিকার বলেন, কেবল নিজেদের বিষয়টি দেখলে সরকার কীভাবে চলবে? সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।’ এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে আলোচনার পরামর্শ দেন তিনি। (সমকাল ৬.৬.১২)। সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারপতি বলেন, স্পিকার তাদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা নিজেদের মনে করেন ‘আমরা কি হনু রে!’ (Daily Star 6.6.12)।
এই ভাষা সম্পূর্ণ অসংসদীয় বা আন-পার্লামেন্টারি। তিনি বলেন, সংসদের কোনো সদস্য কোনো বিষয় আলোচনার জন্য উপস্থাপন করলে স্পিকারের দায়িত্ব হচ্ছে তা বিধিমোতাবেক পরিচালনা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্পিকার নিজেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে নিজের পদমর্যাদার অবমাননা করে প্রচলিত সাংবিধানিক রীতিনীতির বিরোধী কাজ করেছেন।
গত মঙ্গলবার ৫.৬.২০১২ তারিখে জাতীয় সংসদের এই বিতর্কে শুধু আওয়ামী লীগ সদস্যরাই নন, তাদের জোট সরকারের অন্য শরিকরাও অংশগ্রহণ করে স্পিকারকে সমর্থন করে সুপ্রিমকোর্টের সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা কোন পর্যায়ে পৌঁছায় এটা বোঝা যাবে যখন আমরা লক্ষ্য করব একজন আওয়ামী লীগ এবং একজন জাতীয় পার্টির সদস্যের বক্তব্য। তারা দু’জনই বলেন, ‘বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক খুব ভাগ্যবান ব্যক্তি। আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তাকে কোনো মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই হাইকোর্টের একজন অতিরিক্ত জজ করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী বিএনপি সরকার তার এই নিয়োগ অনুমোদন না করলেও বর্তমান সরকার তা করেছে।’ বলাই বাহুল্য, এ কাজ আওয়ামী লীগ সরকারের বাহাদুরি হিসেবে তারা দেখাতে চাইলেও এটাকে একটা দুর্নীতি হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। থাক সে কথা। বিচারপতি মানিককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সদস্য বলেন যে, তিনি রাস্তায় যাওয়ার সময় একবার এক ট্রাফিক পুলিশ অফিসার তাকে স্যালুট না করায় তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন! তিনি অন্যের ওপর জুলুম করে মজা পান!! জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বলেন, একবার বিমানের যাত্রী হিসেবে সাধারণ টিকিট কিনে বিজনেস ক্লাসে তাকে আসন করে দিতে বিমান কর্তৃপক্ষকে তিনি বাধ্য করেন!!! তিনি আসলে একজন উন্মাদ!!!! (Daily Star 6.6.2012).
যাই হোক, এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, আদালত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে একটা মীমাংসায় অনায়াসেই আসতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে যেভাবে সুপ্রিমকোর্ট এবং জাতীয় সংসদ পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসিসতভাবে বিতর্ক ও গালাগালিতে নিযুক্ত হয়েছেন—এটা লঘুভাবে নেয়ার কোনো ব্যাপার নয়। এটা শুধু একজন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সদস্যদের বাকবিতণ্ডা নয়। বর্তমান রাষ্ট্রের গভীর দেশে যে দ্বন্দ্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার প্রতিফলনই এসবের মাধ্যমে ঘটছে। দুই পক্ষই যেভাবে নিজেদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত করার জন্য সংবিধানের আশ্রয় গ্রহণ করে বিতর্ক করেছে তার থেকে এটা বোঝারও অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের সংবিধানও এখন বাস্তবতার কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। আদালত ও জাতীয় সংসদের দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক সম্পর্ক অবসানের ক্ষেত্রে সংবিধান শেষ পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহৃত হয় সেটাও দেখার বিষয়। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী ও শাসন ব্যবস্থা যে এক সমাধান অযোগ্য সঙ্কটের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অনৈক্য এবং দ্বন্দ্বের মধ্যেই এর পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে।
বদরুদ্দীন উমর: বাম রাজনীতিবিদ, প্রখ্যাত লেখক ও কলামিস্ট
No comments