হত্যা গুম নিখোঁজের কূলকিনারা হয় না by মাসুদুল আলম তুষার

হত্যা, গুম ও নিখোঁজের আলোচিত ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্রমেই। অভিযোগ শোনার মধ্যেই থেমে থাকছে তদন্ত। খোঁজখবর নেওয়া হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গৎবাঁধা জবাব মিলছে- 'আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। তদন্ত চলছে।' কিন্তু আসামি গ্রেপ্তার নেই, এমনকি অপরাধী শনাক্তের কাজটিও হয়নি।


এতে প্রশ্ন জাগছে- তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন করবে কে? কবে মিলবে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর সমাধান?
আলোচিত নানা অপরাধমূলক ঘটনার তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, 'সব ঘটনারই তদন্ত চলছে। তদন্ত মূলত চলমান প্রক্রিয়া। সময় মেপে অগ্রগতি পাওয়া যায় না। যেকোনো সময় তদন্তে সফলতা আসতে পারে। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে তদন্তকারী ও সংস্থার পরিবর্তনও ঘটছে। হত্যা, নিখোঁজের ঘটনাগুলো পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গেই তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো প্রকার গাফিলতি নেই।'
তবে মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, 'হত্যা, গুম, নিখোঁজসহ অপরাধমূলক আলোচিত নানা ঘটনার কূলকিনারা না হওয়া এক ধরনের অশুভ সংকেত। দেশে গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে এবং তাদের বিশেষভাবে এ ধরনের তদন্তের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারাই এখন ব্যর্থতার দায় মেনে হাত গুটিয়ে ফেলছে। অথচ তাদের রাখা হয়েছে এ কাজের জন্যই।' তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদন্তে 'অগ্রগতি শূন্যতার' নেপথ্যে কখনো দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছার অভাব থাকতে পারে, আবার কখনো বিশেষ মহলের চাপ থাকতে পারে। কিন্তু সব কিছুকে এড়িয়ে ঘটনাগুলোর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। না হলে অপরাধীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতে থাকবে। যা আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি। সার্বিক অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, দেশের নাগরিককে কারা নিয়ে হত্যা ও গুম করছে, তা উদ্ঘাটনের দায়িত্ব কার? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা হওয়া অভিযোগ ও মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আড়াই বছরে সারা দেশে শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয়েছেন। রাজধানীর বাইরে অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর অধিকাংশ ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে নূ্যনতম ৭৬ জনের দীর্ঘদিনেও কোনো খোঁজ মেলেনি। পরিবারের শঙ্কা- তাঁরা গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। অন্যদের লাশ উদ্ধার হলেও খুনি শনাক্ত হয়নি। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক আলোচিত হত্যা, নিখোঁজ, অপহরণ, গুমসহ প্রায় অর্ধশত অভিযোগ রয়েছে তদন্তাধীন। এগুলোর ব্যাপারে দীর্ঘ সময়েও অগ্রগতি দাবি করতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত 'নিখোঁজ' ঘটনা প্রাইভেটকারের চালকসহ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়া। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আদালতে জানাচ্ছে অগ্রগতির সংবাদ। কিন্তু প্রতিটি প্রতিবেদনই দেখা যাচ্ছে একই ধাঁচে তৈরি। সারাংশ- 'এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।' ইলিয়াস আলীর মতোই প্রতিটি নিখোঁজ ঘটনার প্রায় অভিন্ন পরিণতি। বছর পেরিয়েও মিলছে না তদন্তে অগ্রগতি। নিখোঁজ ঘটনাগুলোর রহস্য অজানাই থেকে যাচ্ছে।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ প্রসঙ্গে পুলিশের গুলশান জোনের উপকমিশনার লুৎফুল কবীরকে প্রশ্ন করা হলে সাফ জবাব, 'ব্রেক থ্রু দেওয়ার মতো কিছু নেই। তদন্ত অগ্রগতির সংবাদ নিয়মিত আদালতকে অবহিত করা হচ্ছে।'
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ঘুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরে গিয়েছিল। সেখান থেকে আদালতের নির্দেশে তদন্ত বর্তেছে র‌্যাবের ওপর। র‌্যাবের তদন্ত টিম ভিসেরা রিপোর্টের জন্য সাগর-রুনির মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। কিন্তু হত্যার কোনো ক্লু উদ্ঘাটনের দাবি এখনো তারা করতে পারেনি। এ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসা থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তাঁর স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পরও এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি সাড়ে চার মাসে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ এপ্রিল ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম ও তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম আদালতে হাজির হয়ে তদন্তে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেন। এর পর আদালত তদন্ত কাজ র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্ত কাজের অংশ হিসেবে যা যা করণীয় করা হচ্ছে। সর্বশেষ এটিএন বাংলায় গিয়ে সহকর্মীদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। সংগ্রহ করা হয়েছে ভিডিও ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র। সেগুলো যাচাই চলছে। তদন্তের ফলাফল নিয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। তবে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
গত ৫ মার্চ রাতে গুলশানে নিজ বাসার কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলীকে। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। সৌদি নাগরিক খালাফ হত্যা ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ থাকায় তদন্তে তাৎক্ষণিক তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু এ মামলায় এখন পর্যন্ত ঘাতক শনাক্ত হয়নি। কিছু অনুমিত বিষয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন তদন্তকারীরা। কার্যত ফলাফল শূন্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কার্যক্রম। এ মামলার তদন্তভার বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এমনকি বিদেশি এ নাগরিক কেন ও কোথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সে সম্পর্কেও ধারণা মেলেনি।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সৌদি নাগরিক খালাফ হত্যাসহ নিখোঁজ, গুপ্তহত্যার অভিযোগ ওঠা বেশ কিছু মামলা ডিবির কাছে এসেছে। এর কয়েকটি অধিকতর তদন্তের জন্য ইতিমধ্যেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে। সব ঘটনার তদন্তে সব সময় দ্রুত ফলাফল মেলে না। ধারাবাহিক তদন্তে ঘটনাগুলোর নেপথ্যে থাকা অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগলেও হতাশ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।'
গত ৪ এপ্রিল নিখোঁজ হন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম। ৬ এপ্রিল ঘাটাইল থানার পুলিশ আমিনুলের লাশ উদ্ধারের পর কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন দাবি করে, আমিনুল গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেও তাঁরা সন্দেহ পোষণ করেন। এ ঘটনার তদন্ত প্রসঙ্গে আশুলিয়া থানার ওসি শেখ বদরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমিনুলকে খুঁজে না পাওয়ার ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। পরে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়েছে টাঙ্গাইলে। সেখানে হত্যা মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে আশুলিয়া থানায় কোনো মামলা না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে ঘটনা তদন্ত আর এগোয়নি।' টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, লাশ উদ্ধার ও পরিচয় শনাক্তের পর তদন্ত খুব বেশি এগোয়নি। আমিনুলের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরের হিজলহাটী গ্রামে। আর তিনি অবস্থান করতেন সাভার, আশুলিয়াসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। সে ক্ষেত্রে কী ধরনের বিরোধে ও কাদের মাধ্যমে তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন, তা তদন্তকালে স্পষ্ট হয়নি। বর্তমানে মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের এসআই দুলাল বলেন, 'পূর্বশত্রুতা ও কিছু বিরোধ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। আমিনুলের বাসস্থান, কর্মস্থল ও ঘটনাস্থল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হওয়ায় হত্যার কারণ এবং খুনিদের চিহ্নিত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুনির্দিষ্ট কারো সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়নি।'
গত বছরের ২ অক্টোবর পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক ও ঝুট ব্যবসায়ী আবদুল করিম হাওলাদার (৫০) নিখোঁজ হন। তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তার অভিযোগ করেন, পুলিশের লোক পরিচয়ে করিম হাওলাদারকে তুলে নেওয়া হয়। এত দিনে লোকটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে, তা জানতে পারলাম না। মামলার তদন্ত থানা থেকে ডিবিতে গেছে। সেখানকার কর্মকর্তারা শুধু বলছেন, চেষ্টা করছেন। এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি তারা।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকা থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আকতারকে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা খানম বলেন, 'থানায় দায়ের করা অভিযোগের কোনো গুরুত্বই নেই। কী তদন্ত হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এত দিনেও পুলিশ কোনো সংবাদ জানাতে পারল না।'
এ ছাড়া গত বছরের ২০ অক্টোবর সাভার থেকে নিখোঁজ হন রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ ওরফে নূর হাজি। এর পর ৩ ডিসেম্বর শ্যামলী থেকে নিখোঁজ হন তাঁর জামাতা আবদুল মান্নান ও ইকবাল। তাঁদের কাউকেই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। গত ২৮ নভেম্বর রাতে রাজধানীর হাতিরপুল এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সূর্যসেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল আমিন ও মাসুম হোসেন। গত ৮ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ দুটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। এর একটি লাশ ইসমাইলের বলে স্বজনরা শনাক্ত করেন। অন্য দুজনের খোঁজ মেলেনি। এ ছাড়া গত বছরের ৮ ডিসেম্বর মিরপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী কালাম শেখ, তাঁর মামাত ভাই আবুল বাশার শেখ, আবদুর রহিম ও যাত্রাবাড়ীর আতাউর রহমান ওরফে ইসরাফিল। গত বছরের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে অপহৃত হন ফেনীর সোনাগাজীর যুবলীগ নেতা সারোয়ার জাহান, ৪ জুলাই টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে সজল ও ইমরান নামে দুই তরুণকে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। ১২ জুলাই সজলের লাশ পাওয়া যায় ঢাকা বাইপাস সড়কের পাশে সমর সিংহ গ্রামে। পরদিন ইমরানের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ার একটি ইটখোলায়। এসব নিখোঁজ, অপহরণ ও হত্যার ঘটনাগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। এর বাইরেও বেশ কিছু নিখোঁজ ঘটনার সাধারণ ডায়েরি রয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশের থানাগুলোতে। যেগুলোর তদন্ত ফলাফল কার্যত শূন্য।

No comments

Powered by Blogger.