করুণাপূর্ণ সিদ্ধান্ত : সংসদ বনাম বিচার বিভাগ by এ এম এম শওকত আলী
সংবিধান অনুযায়ী সংসদ, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের পারস্পরিক অধিক্ষেত্র, ক্ষমতা ও কার্যাবলি ভিন্নতর। এ সত্ত্বেও নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবে সময় সময় সাংঘর্ষিক ও অপ্রীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের এক বিচারকের কিছু স্পর্শকাতর বক্তব্যে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়ে পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজন।
মিডিয়ায় বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত। স্পিকারের এক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বিচারক স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর ফলে সংসদ হয় উত্তপ্ত। সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বিচারকের এহেন আচরণের জন্য বিচারের দাবি উত্থাপন করেন। স্পিকার ছিলেন সম্পূর্ণ শান্ত্ত। তিনি এ বিষয়ে পরবর্তী পর্যায়ে রুলিং বা সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো রুলিং দেননি।
সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সাংঘর্ষিক ঘটনার নজির বিরল। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাটি দ্বিতীয়। দুই দশক আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেটা ছিল কিছুটা ভিন্নতর। জানা যায়, কোনো একটি সংসদীয় কমিটিতে বিচারকদের সম্পর্কে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রী কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কমিটির সভার আলোচনার কপি সংসদকে প্রেরণ করতে বলেন। ওই সময়ের স্পিকারের উক্তি ছিল, 'আইনের হাত লম্বা জানি, কিন্তু এত লম্বা নয় যে তা সংসদ পর্যন্ত আসবে।' এরপর বিষয়টির ইতি হয়। সাম্প্রতিক ঘটনা ছিল কিছুটা বিব্রতকর। কারণ এতে স্পিকারকে দোষারোপ করা হয়, যা কোনো বিচারক সংবিধান অনুযায়ী করতে ক্ষমতাবান নন।
শুনানির সময় বিচারকের মন্তব্য ছিল নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়; সংবিধানসম্মত তো দূরের কথা। রাষ্ট্রীয় তিনটি স্তম্ভের পারস্পরিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা সুশাসনের পূর্বশর্ত। এ ভারসাম্য তখনই হুমকির মুখে পড়ে, যখন কোনো একটি স্তম্ভের কর্মকর্তা অন্যের অধিক্ষেত্রকে তুচ্ছজ্ঞান করেন। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হাইকোর্টের এখতিয়ার সংবিধানে স্বীকৃত। এর উদ্দেশ্য হলো, এ বিভাগ কর্তৃক যাতে আইন ও বিধির প্রয়োগ সঠিক হয়। এর অভাব হলে হবে নির্বাহী স্বেচ্ছাচারিতা; যা জনগণের স্বীকৃত অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। এ ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগ যখন অধিক হয়, তখন তাকে বলা হয় বিচারিক অতিসক্রিয়তা (Judicial activism)। সংসদের ক্ষেত্রেও উচ্চতর আদালতের সংশোধনমূলক এখতিয়ার রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদে অনুমোদিত আইন সংবিধানসম্মত হতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে উচ্চ আদালত তা বাতিল ঘোষণা করতে ক্ষমতাবান। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অলঙ্ঘনীয়। সংসদের তা অমান্য করার কোনো ক্ষমতাই নেই। এর অল্প কিছু উদাহরণ বাংলাদেশে আছে।
আশির দশকে হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ের মামলার রায় ছিল- এ পদক্ষেপ অসাংবিধানিক। মূল যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র। এটাই সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন করার কোনো এখতিয়ার সংসদের নেই। এ রায়ের আলোকে আবার সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে ওই সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে বলা হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক ধারা সংশোধনের কোনো এখতিয়ার সংসদের নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথা ভিন্নতর। কেসভিত্তিক রায়ে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এক রায়ে সব কয়টি চিহ্নিত করে বলা হলে সবাই জানতে পারত। এর ফলে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোনো অবস্থাও সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আলোচ্য ক্ষেত্রে স্পিকারের বিজ্ঞ আচরণের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। দুই স্তম্ভের সাংঘর্ষিক পরিবেশের বিষয় মিডিয়ায় প্রচারিত হলেও তিনি স্পষ্টভাবে তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি সাংঘর্ষিক নয়। বিচারকের উক্তি নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। বিষয়টিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। রুলিংয়ে তিনি বিচারকের বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকেই নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। বলা যায়, এ কাজটি করে তিনি সংবিধান সমুন্নত রাখারই চেষ্টা করেছেন। তবে বিচারক সম্পর্কে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ না থেকে কিছু উক্তিও করেছেন। বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন- এটাই ছিল উক্তি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সংসদে কোনো বক্তব্যের জন্য সংসদ বা সংসদ সদস্যরা বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহি করার জন্য বাধ্য নন।
বিচারকের মন্তব্য সংসদে উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও স্পিকার ছিলেন সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। তিনি বলেছেন, সংবিধানই রাষ্ট্রের ভিত্তি। সংসদ সংবিধানের ভিত্তি। সংসদের নির্বাচনেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ লাভ করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। তাঁর এই নৈর্ব্যক্তিক আচরণ রাষ্ট্রের উচ্চপদে আসীন সব কর্মকর্তা অনুসরণ করলে দেশ যেকোনো ধরনের অপশাসন থেকে মুক্তি পাবে। মূলত রাষ্ট্রের পরিচালনায় নিয়োজিত সর্বস্তরের কর্মকর্তাকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। ছোট হোক, বড় হোক- কোনো কর্মকর্তারই অন্য কোনো কর্মকর্তা বা বিভাগ নিয়ে অশালীন বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কোনো উক্তি করা উচিত নয়। উচ্চ আদালতের বিচারকেরও নয়। এটা কেউ আশা করে না। একজন বিচারক যেমন রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পাদনে নিয়োজিত, তেমনি বিচার বিভাগবহির্ভূত অন্য কর্মকর্তারাও একইভাবে নিয়োজিত। ক্ষেত্র ভিন্নতর হতে পারে। মূল কথা হলো, সবাই সক্রিয়ভাবে সংবিধান সমুন্নত রাখবেন। অন্যথায় রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হবে। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সব স্তম্ভই দুর্বল, বা অকেজো হবে। জনগণ তা আশা করে না।
তিনটি স্তম্ভের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অনেক আইন ও বিধি রয়েছে। এসব আইন ও বিধির সঠিক অনুসরণের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। পক্ষান্তরে কোনো একটি রাষ্ট্রীয় অঙ্গ যদি এসব আইন ও বিধির অপব্যবহার করে, তাহলেই সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি এ বিষয়ে স্পষ্ট। সংসদে আলোচনাকালে কোনো সংসদ সদস্য (ক) যেকোনো আদালতে বিচারাধীন মামলার বিষয় উল্লেখ করতে পারবেন না; (খ) অন্য কোনো সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন না। তবে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারবেন এবং (গ) কোনো কটাক্ষমূলক বক্তব্য দিতে পারবেন না, যদি না এ বক্তব্যের কোনো ভিত্তি লিখিত প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়। এসব অনুসরণীয় বিধির মাধ্যমে অযাচিত বক্তব্য থেকে বিরত থাকলে সাংঘর্ষিক ঘটনাও হবে না।
বিচারকদের বিষয়ে কি এমন কিছু নেই? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাজের মধ্যে একটি অন্যতম কাজ হলো, বিচারকদের জন্য একটি কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি প্রণয়ন করা। দ্বিতীয় প্রধান কাজ হলো কোনো বিচারকের অথবা অন্য কোনো কর্মকর্তার, যাঁকে পদচ্যুত করতে হলে বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, সে বিষয়টি তদন্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা। প্রথমটি না থাকলে দ্বিতীয়টি করা সম্ভব হবে না। প্রথমটি হয়েছে কি না তা জানা নেই। যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় বিষয়টি অস্বচ্ছ থাকবে।
বিগত কয়েক বছরে আদালত অবমাননার মামলার সংখ্যার আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সাবধান হওয়া উচিত। তাঁদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তবে আদালতেরও উচিত হবে, এ ধরনের বিষয়ে অভিযুক্ত যাতে ভবিষ্যতে এমন কাজ না করেন তার জন্য প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এর ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
সংসদীয় কমিটি নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করতে পারে। করাও হয়। এ জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটিও রয়েছে। কিন্তু এসব কমিটির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করা। হুকুম দেওয়া বা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কাজে হস্তক্ষেপ করা নয়। এ ধরনের বিধির মাধ্যমে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সংসদীয় কমিটির যুক্তিসংগত সব সুপারিশই যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অগ্রাহ্য করে, তাহলে তা সঠিক হবে না। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য না হলে তা কমিটিকে জানাতে হবে। যদি খোলা মন নিয়ে দুপক্ষই কাজ করে, তাহলে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের সম্পর্কের কোনো টানাপড়েন হবে না।
সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগকে সংসদ ও বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গিয়ে যদি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংসদ বা বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের দৈনন্দিন ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে সুশাসন ব্যাহত হবে। হস্তক্ষেপ অবশ্যই করতে হবে, তবে তার জন্য সংবিধানসহ আইনি ভিত্তি অবশ্যই থাকতে হবে। আলোচ্য ক্ষেত্রে স্পিকার করুণাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। দৃষ্টান্তটি অনুকরণীয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সাংঘর্ষিক ঘটনার নজির বিরল। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাটি দ্বিতীয়। দুই দশক আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেটা ছিল কিছুটা ভিন্নতর। জানা যায়, কোনো একটি সংসদীয় কমিটিতে বিচারকদের সম্পর্কে ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রী কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কমিটির সভার আলোচনার কপি সংসদকে প্রেরণ করতে বলেন। ওই সময়ের স্পিকারের উক্তি ছিল, 'আইনের হাত লম্বা জানি, কিন্তু এত লম্বা নয় যে তা সংসদ পর্যন্ত আসবে।' এরপর বিষয়টির ইতি হয়। সাম্প্রতিক ঘটনা ছিল কিছুটা বিব্রতকর। কারণ এতে স্পিকারকে দোষারোপ করা হয়, যা কোনো বিচারক সংবিধান অনুযায়ী করতে ক্ষমতাবান নন।
শুনানির সময় বিচারকের মন্তব্য ছিল নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়; সংবিধানসম্মত তো দূরের কথা। রাষ্ট্রীয় তিনটি স্তম্ভের পারস্পরিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা সুশাসনের পূর্বশর্ত। এ ভারসাম্য তখনই হুমকির মুখে পড়ে, যখন কোনো একটি স্তম্ভের কর্মকর্তা অন্যের অধিক্ষেত্রকে তুচ্ছজ্ঞান করেন। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হাইকোর্টের এখতিয়ার সংবিধানে স্বীকৃত। এর উদ্দেশ্য হলো, এ বিভাগ কর্তৃক যাতে আইন ও বিধির প্রয়োগ সঠিক হয়। এর অভাব হলে হবে নির্বাহী স্বেচ্ছাচারিতা; যা জনগণের স্বীকৃত অধিকার ক্ষুণ্ন করবে। এ ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগ যখন অধিক হয়, তখন তাকে বলা হয় বিচারিক অতিসক্রিয়তা (Judicial activism)। সংসদের ক্ষেত্রেও উচ্চতর আদালতের সংশোধনমূলক এখতিয়ার রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদে অনুমোদিত আইন সংবিধানসম্মত হতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে উচ্চ আদালত তা বাতিল ঘোষণা করতে ক্ষমতাবান। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অলঙ্ঘনীয়। সংসদের তা অমান্য করার কোনো ক্ষমতাই নেই। এর অল্প কিছু উদাহরণ বাংলাদেশে আছে।
আশির দশকে হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ের মামলার রায় ছিল- এ পদক্ষেপ অসাংবিধানিক। মূল যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র। এটাই সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন করার কোনো এখতিয়ার সংসদের নেই। এ রায়ের আলোকে আবার সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে ওই সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে বলা হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক ধারা সংশোধনের কোনো এখতিয়ার সংসদের নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথা ভিন্নতর। কেসভিত্তিক রায়ে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এক রায়ে সব কয়টি চিহ্নিত করে বলা হলে সবাই জানতে পারত। এর ফলে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোনো অবস্থাও সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আলোচ্য ক্ষেত্রে স্পিকারের বিজ্ঞ আচরণের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। দুই স্তম্ভের সাংঘর্ষিক পরিবেশের বিষয় মিডিয়ায় প্রচারিত হলেও তিনি স্পষ্টভাবে তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি সাংঘর্ষিক নয়। বিচারকের উক্তি নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। বিষয়টিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। রুলিংয়ে তিনি বিচারকের বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকেই নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। বলা যায়, এ কাজটি করে তিনি সংবিধান সমুন্নত রাখারই চেষ্টা করেছেন। তবে বিচারক সম্পর্কে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ না থেকে কিছু উক্তিও করেছেন। বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন- এটাই ছিল উক্তি। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সংসদে কোনো বক্তব্যের জন্য সংসদ বা সংসদ সদস্যরা বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহি করার জন্য বাধ্য নন।
বিচারকের মন্তব্য সংসদে উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও স্পিকার ছিলেন সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। তিনি বলেছেন, সংবিধানই রাষ্ট্রের ভিত্তি। সংসদ সংবিধানের ভিত্তি। সংসদের নির্বাচনেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ লাভ করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। তাঁর এই নৈর্ব্যক্তিক আচরণ রাষ্ট্রের উচ্চপদে আসীন সব কর্মকর্তা অনুসরণ করলে দেশ যেকোনো ধরনের অপশাসন থেকে মুক্তি পাবে। মূলত রাষ্ট্রের পরিচালনায় নিয়োজিত সর্বস্তরের কর্মকর্তাকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। ছোট হোক, বড় হোক- কোনো কর্মকর্তারই অন্য কোনো কর্মকর্তা বা বিভাগ নিয়ে অশালীন বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কোনো উক্তি করা উচিত নয়। উচ্চ আদালতের বিচারকেরও নয়। এটা কেউ আশা করে না। একজন বিচারক যেমন রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পাদনে নিয়োজিত, তেমনি বিচার বিভাগবহির্ভূত অন্য কর্মকর্তারাও একইভাবে নিয়োজিত। ক্ষেত্র ভিন্নতর হতে পারে। মূল কথা হলো, সবাই সক্রিয়ভাবে সংবিধান সমুন্নত রাখবেন। অন্যথায় রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হবে। এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় সব স্তম্ভই দুর্বল, বা অকেজো হবে। জনগণ তা আশা করে না।
তিনটি স্তম্ভের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অনেক আইন ও বিধি রয়েছে। এসব আইন ও বিধির সঠিক অনুসরণের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। পক্ষান্তরে কোনো একটি রাষ্ট্রীয় অঙ্গ যদি এসব আইন ও বিধির অপব্যবহার করে, তাহলেই সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি এ বিষয়ে স্পষ্ট। সংসদে আলোচনাকালে কোনো সংসদ সদস্য (ক) যেকোনো আদালতে বিচারাধীন মামলার বিষয় উল্লেখ করতে পারবেন না; (খ) অন্য কোনো সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবেন না। তবে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বক্তব্য দিতে পারবেন এবং (গ) কোনো কটাক্ষমূলক বক্তব্য দিতে পারবেন না, যদি না এ বক্তব্যের কোনো ভিত্তি লিখিত প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়। এসব অনুসরণীয় বিধির মাধ্যমে অযাচিত বক্তব্য থেকে বিরত থাকলে সাংঘর্ষিক ঘটনাও হবে না।
বিচারকদের বিষয়ে কি এমন কিছু নেই? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাজের মধ্যে একটি অন্যতম কাজ হলো, বিচারকদের জন্য একটি কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি প্রণয়ন করা। দ্বিতীয় প্রধান কাজ হলো কোনো বিচারকের অথবা অন্য কোনো কর্মকর্তার, যাঁকে পদচ্যুত করতে হলে বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, সে বিষয়টি তদন্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা। প্রথমটি না থাকলে দ্বিতীয়টি করা সম্ভব হবে না। প্রথমটি হয়েছে কি না তা জানা নেই। যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় বিষয়টি অস্বচ্ছ থাকবে।
বিগত কয়েক বছরে আদালত অবমাননার মামলার সংখ্যার আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সাবধান হওয়া উচিত। তাঁদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তবে আদালতেরও উচিত হবে, এ ধরনের বিষয়ে অভিযুক্ত যাতে ভবিষ্যতে এমন কাজ না করেন তার জন্য প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এর ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
সংসদীয় কমিটি নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করতে পারে। করাও হয়। এ জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটিও রয়েছে। কিন্তু এসব কমিটির ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করা। হুকুম দেওয়া বা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কাজে হস্তক্ষেপ করা নয়। এ ধরনের বিধির মাধ্যমে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সংসদীয় কমিটির যুক্তিসংগত সব সুপারিশই যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অগ্রাহ্য করে, তাহলে তা সঠিক হবে না। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য না হলে তা কমিটিকে জানাতে হবে। যদি খোলা মন নিয়ে দুপক্ষই কাজ করে, তাহলে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের সম্পর্কের কোনো টানাপড়েন হবে না।
সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগকে সংসদ ও বিচার বিভাগের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে গিয়ে যদি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংসদ বা বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের দৈনন্দিন ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে সুশাসন ব্যাহত হবে। হস্তক্ষেপ অবশ্যই করতে হবে, তবে তার জন্য সংবিধানসহ আইনি ভিত্তি অবশ্যই থাকতে হবে। আলোচ্য ক্ষেত্রে স্পিকার করুণাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। দৃষ্টান্তটি অনুকরণীয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments