কণ্ঠস্বর-সুশাসন মানে সামরিক শাসন বা জঙ্গিবাদ নয় by রাহাত খান

উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক শাসনের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার একটু বেশি হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের দরুন সর্বস্তরে দুর্নীতি রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় পায় এবং সুশাসন যায় নির্বাসনে_ এগুলো মোটেও অসত্য ভাষণ নয়। তবে সামরিক শাসনে এসব রাষ্ট্রীয় ব্যাধির কোনো চিকিৎসা নেই। বরং দুর্নীতি,


ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দেশ শাসনে রাজনীতিকদের যোগ্যতা নেই ইত্যাদি বলে সামরিক শাসকদের যারা ক্ষমতায় আনে, কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা যায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন ও পাচার, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশটাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার
কৃতিত্ব তাদেরই বেশি

লেখার মতো বিষয় আছে অনেকগুলো। কোনটা নিয়ে লিখব, সেটা নির্বাচন করা এই মুহূর্তে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে আলোচনার দাবি রাখে তো দেশি-বিদেশি অনেক ক'টা বিষয়ই। যেমন_ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক পাকিস্তানের নির্বাচিত রাজনীতিক ইউসুফ রাজা গিলানিকে অযোগ্য বলে রায় দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে বরখাস্ত করেছেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। বলতে হয়, গভীর রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকটের মধ্যে পড়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে এ ধরনের এবং অন্যান্য ধরনের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংকট বরাবরই ছিল। তবে বলতেই হয়, এবারের রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক সংকট চরমে।
পাকিস্তানের হালফিল এবং অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশটির প্রতিটি সংকটের পেছনে রয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনীর কিছু অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেল এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পটু কিছু রাজনীতিক। এবারও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারে সংকটের নতুন একটি কৌশল সংযোজিত হয়েছে মাত্র। আগে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রপূর্ণ রাজনীতির খেলোয়াড় ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছুসংখ্যক জেনারেল এবং পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে অভিলাষী রাজনৈতিক দল বা জোট। এবার এই দ্বিমাত্রিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। সেনাবাহিনীর উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেল এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সুসংগঠিত, সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিরাই যে এবার ক্ষমতা জুগিয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
জন্ম নেওয়ার পর থেকে এখনাবধি পাকিস্তানের যাবতীয় সংকট ও ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেল। তারা কেন যে রাজনীতিকদের ঘৃণা করে, সেটা তারাই জানে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রহস্যজনক মৃত্যু ও ক্যান্সার বলে চালিয়ে দেওয়া, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলীর এক জনসভায় আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা, ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে পূর্বাহ্নে ঘোষিত দেশব্যাপী প্রথম সাধারণ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিয়ে এসব কর্মকাণ্ড এবং ষড়যন্ত্রের আসল হোতা বা খলনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের ক্ষমতারোহণ, এসবই অখণ্ড পাকিস্তান ধ্বংসের বীজ বপন করেছিল। পাকিস্তান যে বর্তমানে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ নানা সংকটে ভুগছে এবং প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দশায় উপনীত হয়েছে, সেসবের পথিকৃৎ হিসেবে অসম্ভব বাঙালি ও গণতন্ত্রবিদ্বেষী আইয়ুব খান তো আছেনই, পাকিস্তান প্রায় ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে আসার খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও আছেন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, জেনারেল জিয়াউল হক এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। বর্তমান সেনানায়ক জেনারেল কায়ানি বহমান বিশ্ব বাস্তবতার কারণে, ইউনিফর্ম পরে প্রকাশ্যে পাকিস্তানে ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হতে পারছেন না বটে, তবে তিনি যে নেপথ্যে থেকে ক্ষমতার নানা চাল চেলে কার্যত দেশ শাসন করতে চাইছেন, এটা আর কোনো গোপন বিষয় নয়।
পাকিস্তান এখনও টিকে আছে। তবে ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ এবং বর্তমানে রাজনীতিবিদ হিসেবে যথেষ্টই জনপ্রিয় ইমরান খান কিছুদিন আগে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সম্পর্কে প্রকাশ্যে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে পাকিস্তান কতদিন তার বর্তমান অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয় বৈকি। ইমরান খান বলেছেন, বেলুচিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন-শোষণ, অত্যাচার ও অবিচারের বিপক্ষে বেলুচবাসীর সঙ্গে পাকিস্তানের যে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং বেলুচিস্তানে অসহায়, নিরীহ বেলুচদের যেভাবে নির্বিবাদে হত্যা করা হচ্ছে তা ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) পাকসেনাদের নির্বিবাদে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বেলুচিস্তানে পাকসেনাদের পরাজয় সময়ের ব্যাপার। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ শুধু নামে পাকিস্তান। কার্যত সেটা জঙ্গিদের শক্ত ঘাঁটি। প্রায় স্বাধীন আরেকটা দেশ।
বিশ্বে পাকিস্তানের প্রধান পরিচিতি এখন বিশ্ব সন্ত্রাসের কেন্দ্র বা রাজধানী হিসেবে। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন মাঝে মধ্যে পাকিস্তানে ফিরে আসে বটে, তবে পাকিস্তানে এ যাবৎ কোনো নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই পুরো মেয়াদ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। জারদারি-গিলানি সরকার পুরো মেয়াদ পূরণ করতে পারবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের একটা ধারণা জন্মেছিল। তবে নেপথ্যে কায়ানি, প্রকাশ্যে সেনা সমর্থিত হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট এবং বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফ_ এই ত্রয়ীর সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে জারদারি-গিলানি রাজনৈতিক সরকার কতদিন টেকে, সেটা দেখার বিষয়। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান টিকবে কি টিকবে না, পাকিস্তান শাসনের গোটা পরিপ্রেক্ষিতে সেটাও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়।
পাকিস্তান প্রসঙ্গের এখানেই ইতি। উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক শাসনের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার একটু বেশি হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের দরুন সর্বস্তরে দুর্নীতি রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় পায় এবং সুশাসন যায় নির্বাসনে_ এগুলো মোটেও অসত্য ভাষণ নয়। তবে সামরিক শাসনে এসব রাষ্ট্রীয় ব্যাধির কোনো চিকিৎসা নেই। বরং দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দেশ শাসনে রাজনীতিকদের যোগ্যতা নেই ইত্যাদি বলে সামরিক শাসকদের যারা ক্ষমতায় আনে, কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা যায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন ও পাচার, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশটাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার কৃতিত্ব তাদেরই বেশি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটু ধীরক্রমে হলেও দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমে আসতে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জোরদার ও শক্তিশালী হতে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যত জোরদার হয়, সুশাসন বা আইনের শাসনও ফিরতে শুরু করে তত দ্রুততার সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে বর্তমান ও অতীতের একটা তুলনামূলক বিচার এসেই যায়। এই যেমন বর্তমান সরকারের গত সাড়ে তিন বছর এবং ২০০১-০৬ শাসন পর্বের তুলনা। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০০১-০৬ শাসন পর্বের জঙ্গি উত্থান, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, গুম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার, প্রায় 'আজান' দিয়ে দুর্নীতি, দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণভাবে দলীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার যেসব নমুনা দেখা গেছে, সেসবের নজির পাওয়া ভার। বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর অবশ্যই কোনো ধোয়া তুলসীপাতা নয়; দুর্নীতি, দলীয়করণ ইত্যাদি এই আমলেও হয়েছে, হচ্ছে। তবে পাশাপাশি সত্যের খাতিরে বলতে হয়, বর্তমান সরকারের আমলে ২০০১-০৬ শাসন পর্বে সংঘটিত দুঃশাসনের মাত্রা সর্বাংশে না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জঙ্গি উত্থান, বোমাবাজি, রাজনৈতিক হত্যা আর নেই বললেই চলে। এখন অপরাধ যে-ই করুক অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধ দমনে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। ২০০১-০৬ শাসন মেয়াদে মন্ত্রী, দলীয় কর্মী, হাওয়া ভবনের পেয়ারের লোকের ক্ষেত্রে আইনের কোনো রকম প্রয়োগ ছিল না। বাংলাভাই এবং শায়খ আবদুর রহমান প্রমুখ ছয়জনকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দিতে হয়েছিল নেহাতই পশ্চিমা ও দাতাগোষ্ঠীর চাপে। আজ বিরোধী দল সোচ্চার তাদের 'জাতীয়' নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায়। এ ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষই দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ। পাশাপাশি এও তো বলতে হয়, বিগত শাসনামলে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় খোদ দেশের বিরোধীদলীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকেই হত্যা করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের আশ্রয়পুষ্ট জঙ্গিরা যদি ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার (আইভী রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন কর্মী-সমর্থককে ঠিকই হত্যা করেছিল) অপচেষ্টা না-ই করবে, তাহলে গ্রেনেড হামলাকারীরা সরকার অনুগত পুলিশের নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় কীভাবে নিরাপদে পলায়ন করতে পেরেছিল? কেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা ভিন্ন খাতে নিয়ে গিয়ে 'জজ মিয়া'র নাটক তৈরি করেছিল?
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্ত, অপরাধ যে-ই করুক, তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যারা দলীয় রাজনীতিবিদ বা স্বার্থান্বেষী মহলের হয়ে কাজ করছেন তাদের ছাড়া সত্যাশ্রয়ী লোকেরা আশা করি স্বীকার করবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্তমানে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ অপরাধ ও অপরাধীর বেলায় তুলনামূলক বিচারে আগের চেয়ে আইনের প্রয়োগ যে বেশি হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি বর্তমান ও নিকট অতীতের তুলনামূলক বিচারে শুধু বলতে চাই, আইনের প্রয়োগ তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমাদের সুশীল সমাজের একাংশের অভ্যাস, তালগোল পাকিয়ে দুই প্রধান দলকেই এক প্যাকেটবন্দি করা। আমার মতে এটা ঠিক নয়। টেক্কাকে টেক্কা বলতে হবে। সেটাই সত্যের প্রকাশ।
আর একটি বিষয়ে বিস্তৃত লেখার ইচ্ছা ছিল। তবে সেটি করার উপায় নেই । শুধু মনের দুঃখ প্রকাশ করে এটুকু বলে রাখি, বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা এম কে আনোয়ার সম্প্রতি বর্তমান সরকার প্রসঙ্গে এমন একটি উক্তি করেছেন, যা তার ব্যক্তিত্ব ও সম্মানের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি বলেছেন, দাবি না মানলে (নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি) বর্তমান সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামানো হবে। পাকিস্তানের সাবেক সিভিল সার্ভিসের একজন উজ্জ্বল তারকা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সবার কাছে ভদ্র-সজ্জন বলে পরিচিত এম কে আনোয়ারের কাছ থেকে এ ধরনের অসাংবিধানিক বক্তব্য আশা করিনি। এটা জামায়াতের সঙ্গে মিশে রাজনীতি করার বিষক্রিয়া কি-না জানি না; তবে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানি, শ্রদ্ধাভাজন লোক তিনি, তার কাছ থেকে এ ধরনের জঙ্গি-উক্তি শুধু আমি কেন, কেউই আশা করে না।

রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.