এক্সপেরিমেন্ট অব্যাহত by এম আবদুল হাফিজ
দু-দু'জন বিশিষ্ট বিদেশি ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। তাদের আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বড়জোর ঝাপসা ধারণাই দেওয়া হয়েছিল দেশবাসীকে। তাই তারা কৌতূহলোদ্দীপ্ত হয়ে শুধু শুধু শাসকদের আতিথেয়তা ও আচার-অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখেছে এবং সাতপাঁচ ভেবেছে এবং এখনও ভাবছে।
ইত্যবসরে একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন হয়তো এখন নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অন্য কোনো স্ট্র্যাটেজিক স্পটে দাবার চাল নির্ধারণে ব্যস্ত। হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে, হয়তো ইউরোপে। পূর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনে বড্ড জ্বালাতন করছেন রুশরা।
হিলারি অবশ্য শুধু বাংলাদেশকে উদ্দেশ করেই এদেশে আসেননি। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও পশ্চিমারা এদেশকে একটি বৃহত্তর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক বলয়েও খানিকটা প্রাসঙ্গিকতা দেয়। পাশ্চাত্যের জন্য সমস্যা হয়েছে যে, বিশ্বের নতুন ভরকেন্দ্র ক্রমেই ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং এখন এশিয়া-প্যাসিফিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও উৎপাদনে আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলই বিশ্বকে প্রভাবিত করতে চলেছে। এখানেও পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিকূলে চীনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক পরাশক্তি মেনে নিতে পারছে না। তাই নানা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ এবং অবস্থানের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাস।
এই স্ট্র্যাটেজিক বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের মূল খুঁটি ভারত হলেও একে নিশ্ছিদ্র করতে ভৌগোলিক ও স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান সাপেক্ষে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' পত্রিকাটিতে হেনরি কিসিঞ্জার রচিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে চীনকে পরিবেষ্টনের নীতিকে জোরালো সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এই নীতি বাস্তবায়নে ভারতসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সেই লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র এবং একটি ব্যর্থ সরকার শাসিত দেশকেও 'গুড হিউমারে' রাখতে হয়। আসতে হয় রুডইয়ার্ড কিপলিং বর্ণিত 'কমজাত'দের দেশে। এসেই যখন পড়া, তখন তো কিছু কিছু চবঢ় ঃধষশং এ দেশবাসীকে অভিভূত করারও সুযোগ হয়। শাসক শ্রেণীরও একজন হিলারি বা প্রণব মুখার্জির সফরের চমকে দেশের কদর্য বাস্তবতাকে দেশের জনগণের দৃষ্টি থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও সরিয়ে রাখা যায়। এসব সফর তাদের জন্য নেহাতই রুটিন এবং কোনোক্রমেই তার মধ্যে তাত্তি্বক কোনো কিছু আবিষ্কারের অবকাশ নেই।
বৃহৎ বা উদীয়মান বৃহৎ শক্তিগুলো কখনও কিছু দিতে আসে না, বড়জোর কিছু নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আসে। আসে এদেশে সাম্রাজ্যবাদের পয়েন্টম্যানদের সঙ্গে নিভৃত আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে। হিলারির সঙ্গে প্রণব বাবুর সফর কাকতালীয় হতে পারে। কিন্তু তারা উভয়েই প্রকারান্তরে একই প্রকার স্বার্থের প্রতিভু। বিশ্লেষকদের ফোকাস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডির ওপরই অধিক হওয়া সত্ত্বেও অতিথিদ্বয়ের মধ্যে 'বাঙালি' প্রণব মুখার্জিই বাজিমাৎ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত বলেই জানতাম। তিনি রবীন্দ্র এবং সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে ভিন্ন সত্তায়ও নিজকে প্রকাশ করেছেন। তিনিও তার ভারতীয় অতিথির সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং উপনিষদভিত্তিক রবীন্দ্রদর্শনেও ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করেছেন। তবে প্রণব বাবু বেরসিকের মতো ছন্দপতন ঘটিয়েছেন সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ টেনে, যদিও তিনি তার উল্লেখ মুনশিয়ানার সঙ্গেই করেছেন। বলেছেন যে তারা ভারতীয়রাও সীমান্তে অব্যাহত বাংলাদেশি হত্যায় চিন্তিত। এতটাই যে, তারা সীমান্তরক্ষীদের ঘড়হ-খবঃযধষ হাতিয়ারে সজ্জিত করার কথা ভাবছেন। অথবা সীমান্তে সন্ধ্যার পর সান্ধ্য আইন বলবৎ রাখার কথাও বিবেচনায় রয়েছে। তাহলে কি সীমান্তে বাংলাদেশি দেখা মাত্র তাকে গুলি করার বিএসএফের অধিকার অপরিবর্তিতই থাকবে?
প্রয়াত কৃষ্ণস্বামী সুব্রামানিয়াম, যিনি ভারতের স্ট্র্যাটেজির গুরু বলে অভিহিত হতেন, একাধিকবার বলতে শুনেছি যে অস্ত্র থাকলেই তা ব্যবহৃত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত সব রকম হাতিয়ারের ব্যবহার নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ইউরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে তিনটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত দেশ আছে, কিন্তু তারা কখনও পারমাণবিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি।
যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ও কন্ট্রোলকে উপেক্ষা করে অস্ত্রের প্রয়োগ প্রবণতা তখন জন্মে, সম্পর্ক যখন সম্ভবত একপক্ষের 'হৃদয়ের টানের' ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
হিলারি অবশ্য শুধু বাংলাদেশকে উদ্দেশ করেই এদেশে আসেননি। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও পশ্চিমারা এদেশকে একটি বৃহত্তর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক বলয়েও খানিকটা প্রাসঙ্গিকতা দেয়। পাশ্চাত্যের জন্য সমস্যা হয়েছে যে, বিশ্বের নতুন ভরকেন্দ্র ক্রমেই ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং এখন এশিয়া-প্যাসিফিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও উৎপাদনে আগামী দিনগুলোতে এই অঞ্চলই বিশ্বকে প্রভাবিত করতে চলেছে। এখানেও পশ্চিমা স্বার্থের প্রতিকূলে চীনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক পরাশক্তি মেনে নিতে পারছে না। তাই নানা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ এবং অবস্থানের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাস।
এই স্ট্র্যাটেজিক বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের মূল খুঁটি ভারত হলেও একে নিশ্ছিদ্র করতে ভৌগোলিক ও স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান সাপেক্ষে বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স' পত্রিকাটিতে হেনরি কিসিঞ্জার রচিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে চীনকে পরিবেষ্টনের নীতিকে জোরালো সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এই নীতি বাস্তবায়নে ভারতসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সেই লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র এবং একটি ব্যর্থ সরকার শাসিত দেশকেও 'গুড হিউমারে' রাখতে হয়। আসতে হয় রুডইয়ার্ড কিপলিং বর্ণিত 'কমজাত'দের দেশে। এসেই যখন পড়া, তখন তো কিছু কিছু চবঢ় ঃধষশং এ দেশবাসীকে অভিভূত করারও সুযোগ হয়। শাসক শ্রেণীরও একজন হিলারি বা প্রণব মুখার্জির সফরের চমকে দেশের কদর্য বাস্তবতাকে দেশের জনগণের দৃষ্টি থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও সরিয়ে রাখা যায়। এসব সফর তাদের জন্য নেহাতই রুটিন এবং কোনোক্রমেই তার মধ্যে তাত্তি্বক কোনো কিছু আবিষ্কারের অবকাশ নেই।
বৃহৎ বা উদীয়মান বৃহৎ শক্তিগুলো কখনও কিছু দিতে আসে না, বড়জোর কিছু নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আসে। আসে এদেশে সাম্রাজ্যবাদের পয়েন্টম্যানদের সঙ্গে নিভৃত আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে। হিলারির সঙ্গে প্রণব বাবুর সফর কাকতালীয় হতে পারে। কিন্তু তারা উভয়েই প্রকারান্তরে একই প্রকার স্বার্থের প্রতিভু। বিশ্লেষকদের ফোকাস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডির ওপরই অধিক হওয়া সত্ত্বেও অতিথিদ্বয়ের মধ্যে 'বাঙালি' প্রণব মুখার্জিই বাজিমাৎ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত বলেই জানতাম। তিনি রবীন্দ্র এবং সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানমালার ভেতর দিয়ে ভিন্ন সত্তায়ও নিজকে প্রকাশ করেছেন। তিনিও তার ভারতীয় অতিথির সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং উপনিষদভিত্তিক রবীন্দ্রদর্শনেও ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করেছেন। তবে প্রণব বাবু বেরসিকের মতো ছন্দপতন ঘটিয়েছেন সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ টেনে, যদিও তিনি তার উল্লেখ মুনশিয়ানার সঙ্গেই করেছেন। বলেছেন যে তারা ভারতীয়রাও সীমান্তে অব্যাহত বাংলাদেশি হত্যায় চিন্তিত। এতটাই যে, তারা সীমান্তরক্ষীদের ঘড়হ-খবঃযধষ হাতিয়ারে সজ্জিত করার কথা ভাবছেন। অথবা সীমান্তে সন্ধ্যার পর সান্ধ্য আইন বলবৎ রাখার কথাও বিবেচনায় রয়েছে। তাহলে কি সীমান্তে বাংলাদেশি দেখা মাত্র তাকে গুলি করার বিএসএফের অধিকার অপরিবর্তিতই থাকবে?
প্রয়াত কৃষ্ণস্বামী সুব্রামানিয়াম, যিনি ভারতের স্ট্র্যাটেজির গুরু বলে অভিহিত হতেন, একাধিকবার বলতে শুনেছি যে অস্ত্র থাকলেই তা ব্যবহৃত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত সব রকম হাতিয়ারের ব্যবহার নির্ভর করে সম্পর্কের ওপর। ইউরোপের অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে তিনটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত দেশ আছে, কিন্তু তারা কখনও পারমাণবিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি।
যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ও কন্ট্রোলকে উপেক্ষা করে অস্ত্রের প্রয়োগ প্রবণতা তখন জন্মে, সম্পর্ক যখন সম্ভবত একপক্ষের 'হৃদয়ের টানের' ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments