ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণ-মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!
বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী ইতিমধ্যে বহুভাবে উচ্চারিত-পুনরুচ্চারিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমও বারবার জানিয়েছে, ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু পানির স্তরের ক্রমাবনতি ঠেকানোর জন্য আদতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এসেছে কি-না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কেননা দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই।
নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগও। ফলে বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী অনুসরণ করলে পানি সংকট অদূর ভবিষ্যতে নগরবাসীকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলবে। এখন গবেষকরা বলছেন, শুধু স্তর নেমে যাওয়াই নয়, নতুন সমস্যা হিসেবে ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণও ছড়িয়ে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঢাকার পানি সরবরাহ পরিস্থিতিতে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। সাধারণভাবে যে কোনো জনপদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বিশেষভাবে বড় শহরের জন্য মাটির নিচের পানি অনেকটা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মতোই মূল্যবান। পৃথিবীব্যাপী শহরগুলো চেষ্টা করে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে ভূ-উপরিভাগের পানি বা বিশেষ উপায়ে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে তা ব্যবহার করতে। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে ভয়াবহ ব্যতিক্রম ঘটেছে। এখানে শহরের ভেতর ও বাইরের জলাধারগুলো ক্রমাগত শিল্প ও মানবিক বর্জ্যে দূষিত হয়েছে। বহু জলাধার ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ফলে উপরিভাগে পানির সঞ্চয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলো দূষণে এতটাই আকীর্ণ হয়েছে যে, শোধন করার পরও এগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত থেকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় অনেকটা নিরুপায় হয়েই ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে। একটি গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ঢাকায় মোট সরবরাহকৃত পানির ৯০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে। মাত্র ১০ শতাংশ আসে উপরিভাগের উৎস থেকে। এরপরও মোট প্রয়োজনের মাত্র ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। আর এটি করতে গিয়ে প্রতিদিন ২১০০ মিলিয়ন লিটার পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করতে হয়। এ হিসাব ২০০৫ সালের। এখন চাহিদা অনেক বেড়েছে। একটি হিসাব অনুসারে ২০৩০ সাল নাগাদ দৈনিক চাহিদা বেড়ে ৪৯৯০ মিলিয়ন লিটার হবে, তখন ওয়াসা মাত্র ১৯৭১ মিলিয়ন লিটার সরবরাহ করতে পারবে। এখনই ঢাকা শহরে পানির জন্য নগরবাসীকে যে কষ্ট সইতে হয়, আগামীতে তা কত ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমান ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে গত এক দশকেই পানির স্তর ৩৫ মিটার নেমে গেছে। পানির স্তর এখন ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬১ মিটারেরও নিচে। ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়ার সঙ্গে পানির এই উৎস নিয়ে যেমন সংশয় বেড়েছে, তেমনি শহরকে নানা সমস্যায় ফেলেছে। এখানকার ভূমি স্থায়ী কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে সময়ের প্রহর গুনছে। অনাগত এসব সমস্যার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো দূষণ। গবেষকরা বলছেন, উপরিভাগের দূষিত জলাধারের পানি মাটির স্তর চুইয়ে নিচের পানিকে দূষিত করে তুলছে। এ অবস্থায় অচিরেই নিচের পানিও ব্যবহার অনুপযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। নগরের জন্য এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি করবে। সমাধান হিসেবে, বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে তা ব্যবহার ও ভূগর্ভে সঞ্চারিত করার পরামর্শ এসেছে। বিকল্প হিসেবে এটি নিশ্চয়ই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সঞ্চিত পানি বিপুল চাহিদার কতটুকু পূরণ করতে পারবে, সে প্রশ্নও জরুরি। বিকল্প উপায়ে পানি সঞ্চয়ের সঙ্গে তাই আবশ্যিকভাবে জলাধার সংরক্ষণ, সংস্কার জরুরি। ঢাকার নদী ও জলাশয়গুলোকে অবিলম্বে শোধন ও সংস্কারের ব্যবস্থা না করলে আসন্ন ভবিষ্যতে হয়তো এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে আমাদের রাজধানী শহর।
No comments