চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রলীগের মাস্তানি ও একটি শোক প্রস্তাবের কাহিনি by আবদুল মান্নান

যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার উত্তরাধিকার, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত নিজেদের মধ্যে কোপাকুপি করে, ছাত্রশিবির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সতীর্থের পায়ের রগ কাটে, স্বাধীনতাবিরোধীরা সর্বক্ষণ উল্লাস-নৃত্য করে, কোনো কোনো শিক্ষক নারীঘটিত কেলেঙ্কারির দায়ে চাকরিচ্যুত হন।


বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে বন্ধ আছে এবং এর ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। উল্লেখ্য, পাঁচ মাস ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পূর্ণকালীন উপাচার্য ছাড়া জোড়াতালি দিয়ে চলছে। অনেকের মতে, দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা মিলে একদিন অনেক গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, যা হয়তো বর্তমান প্রজন্মের অনেকের অজানা।
বর্তমান সময়ের তুলনায় কেমন ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি, তা এই প্রজন্মের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি আছে। বর্তমান সময়ে কোনো সভা-সেমিনারে বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অথবা জেলে নিহত চার জাতীয় নেতার নামে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা বা শোক প্রকাশ করা বা শ্রদ্ধা জানানো কোনো সংবাদপত্রে শিরোনাম হয় না; কিন্তু ১৯৮২ সালের ১০ অক্টোবর যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের প্রথম অধিবেশনে আমি প্রথমবারের মতো এই ঐতিহাসিক কাজটি করেছিলাম, তখন সব জাতীয় দৈনিকে প্রথম পৃষ্ঠায় সেই খবরটি বেশ গুরুত্বসহকারে, কোনো কোনোটিতে আট কলামের ব্যানার হেডলাইনে প্রকাশ করেছিল এই শিরোনামে: ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে বঙ্গবন্ধুর নামে শোক প্রস্তাব গ্রহণ’। মনে রাখতে হবে, যখনকার কথা বলছি তখন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম প্রকাশ্যে নেওয়া অনেকটা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং দেশে তখন সামরিক আইন বলবৎ ছিল। বলে নেওয়া ভালো, এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই সামরিক আইন ভেঙে প্রথম রাজপথে মিছিল করেছিলেন এবং তাতে ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দিয়েছিল এবং তা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছিল।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমকে ১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ১৯ এপ্রিল থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ডা. বদরুদ্দোজার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই খুব অবাক হয়েছিলেন। ড. খান এমনিতে খুবই সজ্জন ব্যক্তি, স্বল্পভাষী কিন্তু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায় তা তাঁর তেমন একটা ছিল না। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা যে উল্লাস-নৃত্য করে তা তাঁর প্রশ্রয়ে শুরু হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। ড. আবদুল আজিজ খান একটি কারণে প্রশংসা পেতে পারেন এবং তা হচ্ছে তিনিই প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে শিক্ষক ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এরপর সিনেটে মনোনীত সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হন। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়া নিহত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। সংবিধান স্থগিত করা হয় এবং দেশে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সভার প্রথম ঘোষিত তারিখ ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। ঠিক দুই দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ কারণবশত উল্লেখ করে সভা স্থগিত করে দেয়।
পরিবর্তিত এজেন্ডা নিয়ে ১৯৮২ সালের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে (বর্তমানে শহীদ মোজ্জামেল মিলনায়তন, এবং পরিত্যক্ত) বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। শুরুতে উপাচার্য খুবই একটি অনুজ্জ্বল, সংক্ষিপ্ত এবং অত্যন্ত সাদামাটা স্বাগত ভাষণ দেন। এরপর সিনেট সদস্যরা সিনেট অধিবেশন ডাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে উপসামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরে ধরনা দিয়েছিলেন, তার জন্য উপাচার্যকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। এঁদের মধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আলমগীর সিরাজউদ্দিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, অধ্যাপক জিয়াউন্নাহার খান, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্, শহীদুল আমিন চৌধুরী, এস এম ফজলুল হকের নাম উল্লেযোগ্য। সেসব অন্য প্রসঙ্গ।
প্রথম দিন দীর্ঘ সময় ধরে যেসব বিষয় আলোচনা হয় তার সবগুলোই ছিল অ্যাজেন্ডা-বহির্ভূত এবং তীব্র সমালোচনামূলক। সিনেটে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সদস্যরা থাকলেও আলোচনা কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ বা শালীনতা অতিক্রম করেনি।
১০ অক্টোবরের অধিবেশনটা শেষ হওয়ার আগে মূল অ্যাজেন্ডার শুধু একটি অ্যাজেন্ডা উত্থাপিত হয় এবং তা ছিল শোক প্রস্তাব। সাধারণত শোক প্রস্তাব সিনেটের সভাপতি, অর্থাৎ উপাচার্য উত্থাপন করেন। কিন্তু সেদিন তা করা হয়নি। না হওয়ার কারণ অন্য কিছু নয়, স্রেফ অজ্ঞতা। অ্যাজেন্ডাটি ঘোষণা করা হলে আমি ত্বরিত মাইক নিয়ে আমার শোক প্রস্তাবটি পড়তে শুরু করি। বলা বাহুল্য, প্রস্তাবটি আমি আগে থেকেই প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। তবে বাস্তব কারণেই আমাকে একটু কৌশলী হতে হয়েছিল। শুরুতেই আমি ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করি। পরবর্তী সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে জিয়াউর রহমানের নামেও শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করি জেলে নিহত চার জাতীয় নেতার নাম; কর্নেল তাহের, জেনারেল খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুর, মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম। আমার উত্থাপিত শোক প্রস্তাবে কেউ দ্বিমত করেননি। এরপর বিভিন্নজন আরও অনেক নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য পেশ করেন। গোল বাধে, যখন জাতীয় অধ্যাপক এবং আইপিজিএমআরের (পিজি) মহাপরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম একাত্তরের পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অন্যতম সহযোগী ও ঘাতক ফজলুল কাদের চৌধুরীর নাম শোক প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেন। এই নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সিনেট অধিবেশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং সিনেট সদস্যরা তাঁদের নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে সিনেটে এই নামটি উচ্চারিত হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন সিনেটর শহীদুল আমিন চৌধুরীকে (চট্টলতত্ত্ববিদ জনাব আবদুল হক চৌধুরীর ছেলে) দেখিয়ে বলেন, শহিদুল আমিন ফকা চৌধুরীর বাসভবন গুডস হিলে একাত্তর সালে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। তাঁর উপস্থিতিতে তো আমরা এই ব্যক্তির নামে এই সিনেটে শোক প্রস্তাব নিতে পারি না। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হামিদা বানু (বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদের বোন) একটি আবেগঘন বক্তৃতা করেন এবং বলেন, যে ব্যক্তিটি স্বাধীন বাংলাদেশের এক বা দুই নম্বর শত্রু, তাঁর নামে আমরা কীভাবে এখানে শোক প্রস্তাব নিই? একই বিষয়ে চমৎকার একটি বক্তব্য দেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আজকে আমাদের ঠিক করতে হবে, এটা কি পাকিস্তানের একটি সিনেটে বসে কথা বলছি, নাকি স্বাধীন-সার্বভৌম লাখ লাখ বীরের রক্তস্রোতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বসে কথা বলছি?’ এরপর ডা. নুরুল ইসলাম ফকা চৌধুরীর নামটি শোক প্রস্তাব থেকে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি বলেন, তাঁর শোক প্রস্তাবের কারণে যাঁদের তিনি আঘাত দিয়েছেন তাঁদের কাছে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। এর পরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেটের প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ হয়।
পরদিন দেশের সব প্রিন্ট মিডিয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে বঙ্গবন্ধুর নামে নেওয়া শোক প্রস্তাবটিই শুধু গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেনি, একই সঙ্গে ফকা চৌধুরীর নামে শোক প্রস্তাব নিতে ব্যর্থ হওয়ার সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পর চট্টগ্রাম বিপণিবিতানে আমাকে একান্তে পেয়ে ফকা চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর বাবার নামে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে শোক প্রস্তাব নিতে বাধা দেওয়ার কারণে কিছুটা হেনস্তা করার চেষ্টা করলে এ প্রসঙ্গে আমার দৃঢ় অবস্থান দেখে কেটে পড়েন। এত দিন পর দেশের অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্তে বা ক্রান্তিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তার জন্য গর্ব বোধ করি। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কতজনের সেই দৃঢ় মানসিকতা প্রদর্শন বা সাহসী ভূমিকা নেওয়ার ক্ষমতা আছে? আরও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যে ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে সেদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শোক প্রস্তাব নিতে দেওয়া হয়নি, সেই নিন্দিত ব্যক্তিটির নামে একটি ছাত্রাবাস করার প্রস্তাবও কিছুদিন আগে একটি মহল থেকে করা হয়েছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.